নেত্রকোনার দুই উপজেলায় গ্রামবাসীর মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, আহত ৮৫
Published: 2nd, April 2025 GMT
নেত্রকোনার খালিয়াজুরী ও কেন্দুয়া উপজেলার পৃথক দুই এলাকায় গ্রামবাসীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ৮৫ জন আহত হয়েছেন।
আজ বুধবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত খালিয়াজুরীর গাজীপুর ইউনিয়নের পাঁচহাট (বড়হাটি) ও কেন্দুয়ার বলাইশিমুল ইউনিয়নের বলাইশিমুল-ছবিলা গ্রামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, খালিয়াজুরীর গাজীপুর ইউনিয়নের পাঁচহাট (বড়হাটি) গ্রামের একটি রাস্তায় কাজ করাকে কেন্দ্র করে আলী জাহান ও শরিফ মিয়ার লোকজন এবং পারভেজ মিয়ার লোকজনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এর জেরে আজ দুপুরে সংঘর্ষে জড়ান দুই পক্ষের লোকজন। দুই পক্ষের কয়েক শ লোক বল্লম, টেঁটা, ঢালসহ দেশি অস্ত্র নিয়ে গ্রামের খোলা মাঠে সংঘর্ষে জড়ান।
সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ৪৫ জন আহত হন। তাঁদের মধ্যে সালাম ও মোস্তাকিম নামের দুজনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিরা খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ স্থানীয় চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসা নিচ্ছেন।
খালিয়াজুরী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মকবুল হোসেন বলেন, রাস্তায় কাজ করাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কিছু লোক আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি।
এদিকে কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমুল ইউনিয়নের বলাইশিমুল (দক্ষিণ পাড়া) গ্রামের তাহাজ্জত মিয়া ও ছবিলা গ্রামের এজহারুল মিয়ার মধ্যে ঈদের দিন বিকেলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কথা-কাটাকাটি হয়। এর জেরে আজ দুপুরে দুই গ্রামবাসী মাইকিং করে জড়ো হয়ে দেশি অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। সংঘর্ষ দফায় দফায় বিকেল পর্যন্ত চলে। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষ চলাকালে ছয়টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ৪০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহত আকাশ মিয়াকে প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া মুসলিম উদ্দিন, সাখাওয়াত হোসেন, সাইদুর রহমান, সফিকুল ইসলামসহ আটজনকে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ স্থানীয় চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসা নিচ্ছেন।
কেন্দুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর স থ ত র ল কজন স ঘর ষ খবর প উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর আনন্দিপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২২) ছোটবেলা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর একাধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এক সময় রক্তের জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে ওঠে। মানুষ বিনা স্বার্থে রক্ত দিতে চাইতেন না। ২০১৬ সাল থেকে পরিবারটিকে রক্তের জন্য আর কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মামুনের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সম্প্রতি মামুনের মা মাজেদা বেগম অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘পোলার রক্তের লাইগ্গা মাইনষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। মানুষ টাকা ভিক্ষা চায়, আর আমি মানুষের কাছে আমার পোলার জন্য রক্ত ভিক্ষা করছি। শইল্যে রক্ত না ভরলে আমার পোলা মইরা যাইতো।’
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তি, জরুরি বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা কিডনি আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয় রক্তের। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারও কাছে প্রয়োজনমাফিক রক্ত না পেয়ে অনেকেই ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তদাতাকে খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ এই কাজেই তাঁদের আনন্দ বলে জানান ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী।
শুধু রক্তদান নয়, সমাজ পরিবর্তনে নানা কাজও করে চলেছে তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। তবে এর দু-এক বছর আগেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী মমিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ এলাকায়।
সম্প্রতি মমিনুর রহমান বলেন, ‘শুধু রক্তের অভাবে একটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না, এই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। ময়মনসিংহে রক্তদান নিয়ে কাজ করে—এমন কোনো সংগঠন ছিল না। তখন স্থানীয়ভাবে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৩৯ জনকে নিয়ে প্রথম সভা করি। পরে সেখান থেকে রক্তদানের এই সংগঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ওই সভা হয়েছিল, তাই সংগঠনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’। ‘আর্তের মুখে হাসি ফোটানোই হয় যদি মানবতা, তবে তার শ্রেষ্ঠ সেবক হলো প্রতিটি রক্তদাতা’, এই স্লোগান সামনে রেখে শুরু হয় এর যাত্রা।
সংগঠনটি থেকে জানানো হয়েছে, রক্তদাতা তরুণেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনটির একটি কমিটি ও ফেসবুক পেজ আছে। এর মাধ্যমে কিংবা মুঠোফোনে খবর পেয়েই রক্ত দিতে ছুটে যান তরুণেরা। তরুণদের তৎপরতায় দিন দিন সংগঠনটির পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিজেরা রক্তদান করেন এবং রক্তদানে অন্য তরুণদের উৎসাহিত করেন। ২০ বারের বেশি রক্ত দিয়েছেন, এমন রক্তদাতা আছেন ৮০ জন, যার ৬০ জনই শিক্ষার্থী। শুধু ময়মনসিংহ শহরেই ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন সংগঠনটির তরুণেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। অন্যদের উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ রক্তের কারণে মারা যাবে, এটি কখনো হতে পারে না। তাই অসুস্থ জটিল রোগীর খবর পেলেই রক্ত দিতে যাই। রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই।’
সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সুমন রাহাত। স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আবিদুর রহমান বলেন, ‘যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরা আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেন। অথবা রক্তের প্রয়োজন ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাস দেখলেই আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করে রক্তের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচিয়ে আনন্দিত হই। আমরা মানুষ বাঁচানোর এই আনন্দ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রক্তের জন্য মানুষ যেন না মরে, এটিই আমাদের লক্ষ্য।’