মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভাস্কর্যগুলো ভাঙচুরের পর দর্শনার্থী কমেছে
Published: 4th, April 2025 GMT
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে দর্শনার্থী কমছে। ঈদের ছুটিসহ বিশেষ দিনগুলোতে সাধারণত দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখরিত থাকত কমপ্লেক্স এলাকা। তবে এবারের ঈদের ছুটিতে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি ছিল একেবারে নগণ্য। গত ৫ আগস্ট স্মৃতি কমপ্লেক্সের তিন শতাধিক ভাস্কর্য ভাঙচুরের কারণে দর্শনার্থীরা আগ্রহ হারিয়েছেন বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, স্মৃতি কমপ্লেক্সের ফটকে দুজন আনসার সদস্য বসে আছেন। দু–একজন করে দর্শনার্থী আসছেন। টিকিট সংগ্রহ করে তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করছেন। কমপ্লেক্সের ভেতরের বিভিন্ন অংশে ছুটির দিনের চিরচেনা সেই ভিড় নেই।
ফটকে দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য আবু ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, ৩০০টি ছোট-বড় ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ ছিল ভাস্কর্যগুলো। প্রতিদিন কয়েক হাজার দর্শনার্থী এখানে আসতেন। কমপ্লেক্সের বেশির ভাগ ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সে কারণে এখন দর্শনার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। এম এ জি ওসমানীকে সরকারের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। সেই সরকারের শপথ গ্রহণের স্থান বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করা হয়।
১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে ১৯৯৬ সালে ওই স্থানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্মৃতি কমপ্লেক্সে একটি মানচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরকে উপস্থাপন করা হয়। কমপ্লেক্সে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির স্মারক ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্ট বিকেলে শতাধিক মানুষের একটি দল রড, বাঁশ, হাতুড়ি নিয়ে স্মৃতি কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে। প্রথমে তারা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের মাথার অংশ ভেঙে ফেলে। একই সময়ে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করে ‘১৭ এপ্রিলের গার্ড অব অনার’ ভাস্কর্যটিতে। আরেকটি দল ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ভাস্কর্যগুলোতে আঘাত করে। তবে সেখানে খুব বেশি ভাঙচুর করতে পারেনি তারা। পরে কমপ্লেক্সের মধ্যে দেশের মানচিত্রের আদলে তৈরি করা মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে যুদ্ধের বর্ণনা–সংবলিত ছোট ভাস্কর্যগুলো ভেঙে আশপাশে ছুড়ে ফেলে। আরও একটি দল শহীদ স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকটি ভেঙে নিয়ে যায়। ভাঙচুর হওয়া ভাস্কর্যগুলোর কোনো সংস্কার এখনো করা হয়নি।
ঈদের ছুটির দিনগুলোতে স্মৃতিসৌধ এলাকায় ভিড় লেগে থাকত দর্শনার্থীদের। গতকাল বৃহস্পতিবার মেহেরপুরের মুজিবনগরে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কমপ ল ক স র ম জ বনগর স ভ স কর য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘মুক্তিযোদ্ধা’ সংজ্ঞার রাজনৈতিক জটিলতা কোথায়
সম্প্রতি ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সংজ্ঞা নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা কিছুটা স্তিমিত হওয়ায় এখন কিঞ্চিৎ জটিল একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য রাজনৈতিক নেতাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়ার সংবাদ প্রকাশ, এর ফলে সৃষ্ট তীব্র প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী সময় ‘মিস/ডিজইনফরমেশন’ এবং তালিকায় নাম আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে সেই ক্ষোভের প্রশমন—এ পুরো ঘটনাচক্র প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগ আমাদের জন্য যে বিরাট বয়ান তৈরি করে গেছে, তার প্রতি প্রায় সবার আস্থা ও এর সংকট কতটা গভীর।
সম্ভবত সরকারপন্থী অনেকের ভয় ছিল, এই ‘বাতিল’-এর ঘটনা তাঁদের ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ হিসেবে চিত্রিত করতে পারে। ফলে তাঁরা যখন নিশ্চিত হলেন যে মুজিব, তাজউদ্দীনসহ সবার নাম সংজ্ঞার আওতায় অন্তর্ভুক্ত, তখন তাঁরা স্বস্তি ফিরে পান। কিন্তু এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার রাজনীতি অনুধাবন করতে পারলেই আমরা টের পাব, কীভাবে আমরা আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া গর্তে আটকে আছি।
২.
এ আলোচনার শুরু ১৯৭২ সাল থেকে করা যেতে পারে। সে বছর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ছিল একেবারে স্পষ্ট। ইংরেজিতে প্রদত্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছিল, ‘ফ্রিডম ফাইটার মিনস অ্যানি পারসন হু হ্যাড সার্ভড অ্যাজ আ মেম্বার অব অ্যানি ফোর্স এনগেজড ইন দ্য ওয়ার অব লিবারেশন।’ অর্থাৎ যিনি মুক্তিযুদ্ধে যেকোনো একটি বাহিনীর সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেছেন, তিনিই মুক্তিযোদ্ধা। সেই আদেশে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ ছিল: যাঁরা প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ বা সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত, কিংবা সরকারি পেনশনভোগী বা যাঁদের নিয়মিত আয়ের উৎস আছে, তাঁরা সম্মানী ভাতা বা সুবিধার আওতায় আসবেন না।
এ তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ২০১৮ সালে যখন এ আদেশ রহিত করে ‘পরিমার্জনমূলক যুগোপযোগী’ করার বিল আনা হয়, তখন যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল যে বাহাত্তরের সংজ্ঞার কারণে সব মুক্তিযোদ্ধাকে ভাতা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ উদ্দেশ্য থেকেই স্পষ্ট হয় যে মূলত ‘সম্মানী ভাতা’ দেওয়ার সুবিধার জন্যই আইনটি পুনঃপ্রণয়ন করা হয়েছিল।
২০০২ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে যখন জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) আইন তৈরি হয়, তখনো মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হিসেবে বাহাত্তরের সংজ্ঞাটিই মূল ভিত্তি ছিল। তখন তালিকা মূলত বয়স কমানো-বাড়ানোর মধ্য দিয়ে বৃদ্ধি বা হ্রাস পেত। প্রায় প্রতিটি সরকারই কিছু নতুন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়াত। আবার পরবর্তী সরকার এসে তার কিছু বাতিল করে নতুন নাম যুক্ত করত। কিন্তু সংজ্ঞার মূল মানদণ্ড ১৯৭২ সালের আদেশটিই ছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিতর্ক নতুন মাত্রা পায়। ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীদের অবসরের বয়স বাড়ানোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ নতুন বিতর্কের শুরু হয়। এর রেশ ধরে ২০১৪ সালে জামুকার বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাওয়ার জন্য আটটি নতুন যোগ্যতার কথা বলা হয়। এর মধ্যে ছিল: মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সীমান্ত অতিক্রম করে ট্রেনিং ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত করা, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে ভূমিকা রাখা, বিভিন্ন মুক্তিবাহিনীর (যেমন কাদেরিয়া, হেমায়েত বাহিনী) সদস্য থাকা, প্রথমে ত্রাণশিবিরে থাকলেও পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অথবা মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত গণপরিষদের সদস্য হওয়া এবং শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, সাংবাদিক হিসেবে বা বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অবদান রাখা।
■ ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে যখন জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) আইন তৈরি হয়, তখনো মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হিসেবে বাহাত্তরের সংজ্ঞাই মূল ভিত্তি ছিল। ■ ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলতে এখন শুধু রণাঙ্গনে যুদ্ধ করাকে আর বোঝানো হচ্ছে না; বরং মুক্তিযুদ্ধে বিচিত্র ধরনের ‘অবদান’কেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।২০১৬ সালের নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও বয়স নতুন করে নির্ধারণ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’
এ সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধার পরিধি অনেক ব্যাপক ছিল। সেই সংজ্ঞায় ট্রেনিং ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়া, কোনো বাহিনীর সদস্য হিসেবে সক্রিয় অংশ নেওয়া, নির্যাতনের শিকার নারীরা (বীরাঙ্গনা) যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন বিদেশে অবদান রাখা পেশাজীবীরা, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএ ও এমপিএরা (গণপরিষদের সদস্য), চিকিৎসায় সহায়তাকারী, বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় ও কালচারাল ফ্রন্টে অবদান রাখা কলাকুশলীরাও।
২০১৮ সালে যখন ১৯৭২ সালের আদেশ রহিত করে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন’ এবং ২০২২ সালে যখন ২০০২ সালের জামুকা আইন রহিত করে নতুন আইন তৈরি করা হয়, তখন ২০১৬ সালের এ বর্ধিত সংজ্ঞার কাঠামোই বহাল রাখা হয়। ২০১৮ সালের আইনে আরেকটি জিনিস যুক্ত করা হয়—যুদ্ধ যাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল, অর্থাৎ ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও জামায়াতে ইসলামী এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী’, তাদের নামও তখন যুক্ত করে দেওয়া হয়।
৩.
খেয়াল করে দেখুন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিধি কেবল বয়স দিয়ে নয়, বরং প্রকারেও বেড়েছে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা বলতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করাকে আর বোঝানো হচ্ছে না; বরং মুক্তিযুদ্ধে বিচিত্র ধরনের ‘অবদান’কেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন তোলা হয়নি: রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কেন মুক্তিযোদ্ধা বলার প্রয়োজন দেখা দিল? কেনই-বা শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদদের মতো মুক্তিযুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে হবে? তাঁরা নিজেরা সরকার গঠনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখানে কি তাঁরা নিজেদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন? তাঁরা নিজেরা কি কখনো মুক্তিযোদ্ধা বলে নিজেদের পরিচয় দিতে পারতেন? এই গোঁড়ার প্রশ্নটা তোলার অবকাশ কখনো হয়নি।
যখন মাঠের যুদ্ধ ছাড়াও সব ধরনের অবদানকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হলো, তখনই বিপত্তি ঘটল। সুযোগ-সুবিধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেবল বয়স দিয়ে আর তালিকা বাড়ানো যাচ্ছিল না, তখন সংজ্ঞার ‘প্রকার’ই বাড়াতে হলো। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা বর্গটির মূল অর্থই হারিয়ে গেল। যিনি অস্ত্র হাতে শত্রুর মুখোমুখি হয়েছেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধা; আবার যিনি বিদেশে বসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রেখেছেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধা। এখানে কারও অবদানকে ছোট করা হচ্ছে না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে সবারই অবদান ছিল। কিন্তু সব অবদানকে যদি মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে ফেলা হয়, তাহলে যাঁরা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের পৃথক করা যাবে কীভাবে?
সংজ্ঞার এই পরিধি বাড়ানোর সমালোচনা খোদ আওয়ামী লীগ আমলেই হয়েছিল। ২০১৬ সালেই মেজর (অব.) এ এস এম শামসুল আরেফিন বলেছিলেন, ‘…যেভাবে সহযোগী, লেখক, শিল্পীসহ নানাজন তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন, তাতে একে আর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বলা যাবে না। এটা এখন স্বাধীনতাসংগ্রামীদের তালিকা হয়ে যাচ্ছে।’
২০১৬ সাল থেকে জারি করা সংজ্ঞায় আরও একটি হাস্যকর বিষয় রয়েছে। একদিকে বলা হচ্ছে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া’ যাঁরা লড়াই করেছেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা। আবার অন্যদিকে সেই আহ্বানকারী নেতাকেও মুক্তিযোদ্ধা বলা হচ্ছে। অতিরিক্ত আনুগত্য প্রকাশ ও ইতিহাসে আওয়ামীকরণ ঘটাতে গিয়ে সংজ্ঞার এ অন্তর্নিহিত সংকট কারও চোখে পড়েনি।
৪.
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার যখন ঘোষণা দিল যে তারা বাহাত্তরের সংজ্ঞায় ফিরে যাবে, তখন এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারত। গত কয়েক দশকে মুক্তিযোদ্ধা বর্গের যে বাজে ও অপমানজনক হালত হয়েছে, তা থেকে রেহাই পেতে এ পদক্ষেপ ভালো সমাধান হতে পারত। এমনকি খোদ আওয়ামীপন্থী বলে পরিচিত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনও ২০১৬ সালে বলেছিলেন, ‘১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের যে সংজ্ঞা হয়েছে, সেটাই মানা উচিত।’
কিন্তু এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোর উপস্থাপনা বা ফ্রেমিং নিয়েও একটি কথা বলে নেওয়া দরকার। যখন প্রথম এ আলাপ শুরু হয়েছিল, তখন তারা বলতে পারত, ‘মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বাহাত্তরের অথবা শেখ মুজিবের আমলের সংজ্ঞায় ফিরে যাচ্ছে।’ কিন্তু তা না করে তারা শিরোনাম করল রাজনৈতিক নেতাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাতিল করা নিয়ে। মূল প্রশ্ন, কেন রাজনৈতিক নেতা বা অন্য পেশাজীবীদের মুক্তিযোদ্ধা বলা হবে, তা এবারও এড়িয়ে যাওয়া হলো।
এখানেই আওয়ামী লীগের তৈরি করা জটিলতার গভীরতা বোঝা যায়। প্রথমে তারা অজস্র বর্গ তৈরি করে সবাইকে মুক্তিযোদ্ধার ছাতার নিচে এনেছে; এখন যখন সেই বর্ধিত অংশ বাদ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তখন এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে, যেন তাঁদের অবদানকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। ‘মুক্তিযুদ্ধে অবদান’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা’—এই দুটিকে সমার্থক করে ফেলার সংকটই এখানে প্রকট হয়ে উঠেছে। কেন রাজনৈতিক নেতাসহ সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে হবে, এই মৌলিক প্রশ্ন প্রায় সবাই এড়িয়ে গেলেন। আওয়ামীবয়ানে আমাদের বসবাসের গভীর স্মারক হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও এতে রাজনৈতিক নেতাদের থাকা বা না-থাকা নিয়ে সাম্প্রতিক উদ্বেগ।
সবকিছুকে কীভাবে আওয়ামীকরণ করা হয়েছিল, তার একটি ছোট নজির হতে পারে এই সংজ্ঞার পাঠ। ১৯৭২ সালের সংজ্ঞাটি ছিল নির্ভার ও মেদহীন। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, সবকিছু শেখ মুজিবের নামে করার চেষ্টা করেছে। ১৯৯৬ সালে বলা হলো, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা। ২০১৬ সাল থেকে প্রতিটি আইনে সংজ্ঞার শুরুতেই ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর নাম যুক্ত করা হয়েছে।
২০০২ সালে বিএনপির আমলে যখন জামুকা আইন তৈরি করা হয়, তখন বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণকল্পে’ এটা করা হচ্ছে; কিন্তু ২০২২ সালে সেই আইন রহিত করে যখন নতুন আইন করা হচ্ছে, তখন বলা হচ্ছে, ‘জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখিবার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করিবার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গঠন করিবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে।’
এটি মুক্তিযুদ্ধের ‘দলীয়করণ’ ও ‘আওয়ামীকরণ’-এর স্পষ্ট নজির। শেখ মুজিব একাত্তরে অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন, এটা সত্য। অন্যদিকে সবাই তাঁর আহ্বানেই যুদ্ধ করেছেন, সেটা সত্য নয়। এটা দলীয় বয়ান। যুদ্ধ ছিল বিচিত্র; তার ভাব ও ভঙ্গিমা ছিল বিচিত্র।
৫.
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে তৈরি হওয়া এ সমস্যার জট খোলার পরিবর্তে আমরা সম্ভবত আরেক নতুন আবর্তে পড়তে যাচ্ছি। একদিকে ‘মুজিবনগর সরকার’ নিয়ে একটা ভালো ধোঁয়াশা রেখে দেওয়া হয়েছে। সংজ্ঞায় থাকা মুজিবনগর সরকার নিয়ে যা বলা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, মুজিবনগর সরকার দিয়ে আসলে মুজিবনগর সরকারের কেবল মন্ত্রিসভা বা ক্যাবিনেটকেই বোঝানো হচ্ছে। অন্যদিকে ‘সহযোগী’ নামে নতুন একটি বর্গ তৈরি হলে, তার পরিধিও বাড়তে থাকবে। যদি সুযোগ-সুবিধা সমানই থাকে, যেভাবে বলা হচ্ছে, তাহলে এটি আরেকটি বিতর্কের জন্ম দেবে।
গত পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। যাঁরা যুদ্ধে অংশ নেন, আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হন, রাষ্ট্র অবশ্যই তাঁদের সম্মান জানাবে ও দেখভাল করবে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে যদি আরেকটি ‘সুবিধাভোগী’ বর্গ তৈরি হয়, যা ক্রমাগত আকারে বাড়তে থাকে, তখন জনমনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাসের এ শিক্ষা আমাদের অবশ্যই নেওয়া উচিত। যদিও আমরা জানি, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
● সহুল আহমদ গবেষক
* মতামত লেখকের নিজস্ব