৬ মাস ধরে চালক নেই অ্যাম্বুলেন্স সেবাও বন্ধ
Published: 7th, April 2025 GMT
কয়েক বছর আগে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে গ্যারেজে। অপর দুটি সচল থাকলেও তার চালক নেই। ছয় মাস আগে সবশেষ চালক বদলি হলে হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ বলছে, অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ থাকায় রোগীর দুর্ভোগের বিষয়টি তারা একাধিকবার মৌখিক ও লিখিতভাবে ওপর মহলে জানালেও কোনো সুরাহা হয়নি। এমন বেহাল দশা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবাগ্রহীতাদের আধুনিক চিকিৎসার জন্য পর্যায়ক্রমে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া ওই তিনটির মধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্স অনেক আগেই অচল হয়ে গ্যারেজবন্দি আছে। অপর দুটি সচল অ্যাম্বুলেন্সের বিপরীতে মাত্র একজন চালকের পোস্টিং ছিল। ওই চালককেও গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর অন্যত্র বদলি করা হয়। এর পর থেকেই হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স সেবা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চালক না থাকায় সচল দুই অ্যাম্বুলেন্স পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এদিকে অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ থাকায় হাসপাতালটিতে সেবা নিতে আসা মুমূর্ষু রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রোগী পরিবহনে দুর্ভোগের পাশাপাশি অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউই কথা রাখেননি। সবশেষ গত মার্চ মাসের উপজেলা মাসিক সভায় ইউএনও এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এর সমাধান করবেন বলে কথা দিলেও এখন পর্যন্ত তারা সেটি বাস্তবায়ন করেননি।
গত শনিবার হাসপাতালটিতে গেলে দেখা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে কিছু মানুষ জটলা করে আছেন। এগিয়ে গিয়ে জানা যায়, তাদের একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাইরে পাঠাতে হবে। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাচ্ছেন না। ওই রোগীর স্বজন পৌর এলাকার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সুবল দাস জানান, তাঁর জামাই কৃষ্ণ দাস গলায় আঘাত পেয়েছেন। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে আনা হলে ডাক্তাররা রোগী দেখে রেফার করেছেন জরুরিভাবে তাঁকে বাইরের হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু চালক নেই বলে তারা হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করতে পারছেন না। এ অবস্থায় স্বজনরা বাধ্য হয়ে বেশি টাকা দিয়ে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেছেন। কলেজপাড়া এলাকার সুশান্ত মালি নামে আরেক ভুক্তভোগী জানালেন, প্রতিনিয়ত এমন ভোগান্তির শিকার হন অনেকেই। তিনিও কিছুদিন আগে এমন পরিস্থিতিতে পড়েন। পরে বেশি টাকা দিয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে রোগীকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের চালক নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও শিশির কুমার ছানা বলেন, হাসপাতালে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স চালক নিয়োগের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা.
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেদারুল ইসলাম বলেন, জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির দ্রুত সমাধানে তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দিয়েছেন। জনদুর্ভোগ লাঘবে প্রয়োজনে শিগগির তিনি বিকল্প ব্যবস্থা নেবেন।
ঝিনাইদহ জেলা সিভিল সার্জন ডা. কামরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবহিত আছেন। বর্তমানে নতুন কোনো চালকের পোস্টিং হচ্ছে না। তার পরও কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দ্রুতই একজন চালকের পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগ নেবেন তিনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স কর মকর ত ব ষয়ট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ