টানা পৌনে ৯ ঘণ্টা সড়ক অবরোধের পর ছয় দফা দাবি পূরণে ঢাকাসহ সারাদেশে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় রেলপথ ব্লকেডের ঘোষণা দিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার রাতে ঘোষিত কর্মসূচিতে বলা হয়, যেসব পলিটেকনিকের পাশে রেলস্টেশন বা রেললাইন নেই, তারা মহাসড়কে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করবে। একই সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনেরও ডাক দিয়েছেন তারা।
কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলা ও গুলি ছোড়ার প্রতিবাদ এবং ছয় দফা দাবি আদায়ে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ে দিনভর অবস্থান কর্মসূচি শেষে এ ঘোষণা দেন কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী। তিনি বলেন, দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার আমরা সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন করব। সেই সঙ্গে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রেলপথ ব্লকেড করা হবে।
এদিকে আজ অনুষ্ঠিত হবে এসএসসির ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির ফলে যানজটসহ বিভিন্ন বিড়ম্বনায় পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবির সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমানকে বদলির দাবি। পরে রাতে তাঁকে সরিয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়।
কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, দিনভর আমরা ঢাকাসহ সারাদেশে সড়ক অবরোধ করেছি। আজকে মানুষের যে ভোগান্তি, সেটাই সামনে আসছে; সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু যৌক্তিক দাবি নিয়ে আমরা রাস্তায় নেমেছি, অথচ আমাদের ভাইদের গুলি করা হয়েছে, রক্ত ঝরেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর যদি কোনো ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা গুলি খেয়ে থাকে, সেটা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেও অধ্যক্ষের নির্দেশে হামলা করা হয়েছে। সরকার আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা অধ্যক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছি।
ছাত্র আন্দোলনের এ প্রতিনিধি বলেন, দেশের উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অনেক। আমরা সরকারকে স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। যদি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, তাহলে সামাল দিতে পারবেন না। দাবি আদায় করেই আমরা রাজপথ ছাড়ব।
এর আগে গতকাল সকাল ১০টার দিকে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবি আদায়ে সাতরাস্তা মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। ঢাকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সারাদেশে জেলায় জেলায় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের যেসব দাবি
তাদের প্রথম দাবি– জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের অবৈধ পদোন্নতির রায় হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি, ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদবি পরিবর্তন এবং মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করতে হবে। ২০২১ সালে রাতের আঁধারে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে বাতিল এবং সেই বিতর্কিত নিয়োগবিধি অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দাবি, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যে কোনো বয়সে ভর্তির সুযোগ বাতিলসহ উন্নত বিশ্বের আদলে চার বছর মেয়াদি মানসম্পন্ন কারিকুলাম নিশ্চিত করে একাডেমিক কার্যক্রম পরবর্তী প্রবিধান থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে সম্পূর্ণ ইংরেজি মাধ্যমে চালু করতে হবে।
তৃতীয়: উপসহকারী প্রকৌশলী ও সমমানের (দশম গ্রেড) পদ চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ও মনোটেকনোলজি (সার্ভেয়িং) থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও যেসব সরকারি, রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিম্নস্থ পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চতুর্থ: কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় পরিচালক, সহকারী পরিচালক, বোর্ড চেয়ারম্যান, উপসচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সব পদে কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত জনবল নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তা আইনানুগভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এ পদগুলোতে অনতিবিলম্বে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল নিয়োগ এবং সব শূন্য পদে দক্ষ শিক্ষক ও ল্যাব সহকারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে।
পঞ্চম: কারিগরি শিক্ষায় বৈষম্য ও দুরবস্থা দূর করার পাশাপাশি দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতে কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।
ষষ্ঠ দাবি, পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগের লক্ষ্যে একটি উন্নতমানের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশাপাশি, নির্মাণাধীন চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (নড়াইল, নওগাঁ, খাগড়াছড়ি ও ঠাকুরগাঁও) পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্পাস ও ডুয়েটের আওতাভুক্ত একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আগামী সেশন থেকে শতভাগ সিটে ভর্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ
শিক্ষার্থীদের দিনভর সড়ক অবরোধের মুখে গতকাল বিকেল সোয়া ৪টার দিকে সাতরাস্তা মোড়ে যান কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শোয়াইব আহমাদ খান এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা। মহাপরিচালক শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে পদোন্নতিতে ‘ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের’ কোনো কোটা রাখা হবে না বলেও জানান।
তবে শিক্ষার্থীরা চান বাস্তবায়ন। ঘোষণা বা শুধু আশ্বাসে সড়ক অবরোধ তুলে না নিয়ে বরং মহাপরিচালককেই অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তারা অধিদপ্তরে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মকর্তাকে মহাপরিচালক নিয়োগের দাবি জানান। আশ্বাসের পরও শিক্ষার্থীরা রাস্তা না ছাড়ায় সন্ধ্যার দিকে সেখান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান কর্মকর্তারা।
কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীরা কী বলছেন
আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শোয়াইব আহমাদ খান সমকালকে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের কেউ ভুল বুঝিয়ে পথে নামিয়েছে। হাইকোর্টের রায় নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তা সত্য নয়। ৩০ শতাংশ পদোন্নতি দেওয়ার কোনো বিষয় রায়ে নেই। তবুও আমরা আপিল করেছি। ইতোমধ্যে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর নামে কোনো পদ থাকবে না।
ছাত্র প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী বলেন, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ঢাকা পলিটেকনিকের অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। তবে বৈঠকে আমরা একমত হতে পারিনি। তারা লিখিতভাবে আমাদের দাবিগুলো মেনে নেননি। তাই আমরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার রেলপথ ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করছি।
ঢাকা পলিটেকনিকের অধ্যক্ষকে বদলি
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান খানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। গতকাল রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে, একই প্রজ্ঞাপনে সাহেলা পারভীনকে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবির চারটি পূরণে সরকার সম্পূর্ণ একমত। দুটি দাবি পূরণে আইনগত বাধা আছে। তার একটি হলো সব পদে কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত জনবল নিয়োগ নিষিদ্ধ করা; কারণ সরকারি পদে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী পদায়ন হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, ২০২১ সালে রাতের আঁধারে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা। কারণ, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেয়ে চার বছর চাকরিকাল পার করার পর তাদের সবাইকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নেই।
সচিবের বক্তব্য
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও দাবি পূরণের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সড়ক অবর ধ আম দ র সরক র গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
আউটসোর্সিং এবং শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন
আধুনিক শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত খাত হলো আউটসোর্সিং। এ খাতের মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অথচ এই শ্রমিকদের অধিকাংশই শোভন কাজের মৌলিক মানদণ্ড থেকে বঞ্চিত। চাকরির স্থায়িত্ব নেই; সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই; নেই সংগঠনের অধিকার– এমন বাস্তবতায় শ্রমিকরা এক অনিশ্চিত ও অনুৎপাদনশীল পরিবেশে দিন কাটাচ্ছেন।
এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি শ্রম সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক-অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প-সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি সুপরিকল্পিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন অধ্যায়ে কাজের স্বীকৃতি, অধিকার, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিয়ে যেসব সুপারিশ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে আউটসোর্সিং খাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে তৎপরতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে সরকারের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ১২৫০টি ঠিকাদারি সংস্থা জনবল সরবরাহ করছে। এর বাইরেও অগণিত অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা, মজুরি, ছুটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার।
অধিকাংশ আউটসোর্সিং শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পান না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার নির্ধারিত মজুরি না দিয়ে বেতন থেকে অবৈধভাবে টাকা কেটে রাখে; উৎসব ভাতা দেয় না; ওভারটাইমের ভাতা দেয় না। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের আউটসোর্সিং নীতিমালায় উৎসব ভাতা ও বৈশাখী ভাতা অন্তর্ভুক্তিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলা যায়, তবে বাস্তবায়ন ও নজরদারি এখনও দুর্বল।
নীতিমালায় নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত কোনো অর্থনৈতিক সুরক্ষা না থাকায় তারা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে অন্তঃসত্ত্বা হলেই চাকরিচ্যুতির শঙ্কা থাকে। বেসরকারি খাতে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। নতুন নীতিমালায় ৪৫ দিনের প্রসূতিকালীন ছুটি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা বিদ্যমান শ্রম আইনের ১১২ দিনের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আউটসোর্সিং শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথ রুদ্ধ। তারা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না। করলে চাকরিচ্যুতির শিকার হন। ফলে শ্রমিকস্বার্থে কোনো সামাজিক সংলাপ বা দরকষাকষির সুযোগ থাকে না।
বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য, ওয়াসা, নিরাপত্তা খাতে কর্মরত হাজার হাজার আউটসোর্সিং শ্রমিক পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। করোনা মহামারিতে তারা সম্মুখ সারিতে থেকেও কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পাননি। শ্রম বিধিমালার ১৬(৩) অনুযায়ী মালিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ দুর্বল।
সে জন্য শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে আউটসোর্সিং শ্রমিকদের জন্য যেসব সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে এ খাতে শোভন কাজের নিশ্চয়তা আসবে। আউটসোর্সিং খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের শোভন কাজ, মৌলিক অধিকার এবং কর্মস্থলে সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
আমি মনে করি, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, করপোরেশন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে আইনের ধারা ও বিধি অনুসরণপূর্বক প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা দরকার। ঠিকাদারের মাধ্যমে সার্ভিস চার্জ বা কমিশনের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ প্রদান নিশ্চিত করা দরকার। যারা ৫-১০ বছর বা তদূর্ধ্ব সময় ধরে কর্মরত থেকে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তাদের শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মূল মালিককে দায়বদ্ধ করা দরকার।
শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত কাজ করতে রাজি না হলে তাদের চাকরিচ্যুত বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। এ বিষয়ে শ্রম পরিদর্শন দপ্তর কঠোর নজরদারি করবে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, দপ্তর ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং বন্ধ করতে হবে। যেসব দপ্তর ও সেবা খাতে ইতোমধ্যে আউটসোর্সিং করা হয়েছে, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থায়ী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা একটাই– শোভন কাজের বাস্তবায়ন। এ খাতের বৈষম্য কমাতে হলে সরকারের নীতিগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ দরকার। একই সঙ্গে সমাজকেও সচেতন হতে হবে, যাতে মানুষ সস্তা সেবার পেছনে শ্রমের শোষণকে গুরুত্ব দিতে শেখে।
মো. মাছুম বিল্লাহ: আইন কর্মকর্তা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর