দাউদের জীবনযাপন ছিল ওর নিজের মতো
Published: 27th, April 2025 GMT
আজ সকাল সাতটা-আটটার দিকে জার্মানি প্রবাসে নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার, আমাদের দাউদের মৃত্যুর খবর পেলাম। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। দাউদ আমার বন্ধু। আমি তো ওকে কবি-সাহিত্যিক হিসেবে দেখতাম না। বন্ধু হিসেবেই দেখি।
দাউদের ছোট ভাই জাহিদ হায়দার আমাকে কদিন ধরেই বলছিল যে মনটা শক্ত করুন। ডাক্তার বলে দিয়েছে, দাউদ আর ফেরত আসবে না। আমি তাই প্রস্তুত ছিলাম একরকম। কষ্টটা কম করে গেছে আশা করি। ওর জ্ঞান ফিরেছিল। কথা বলতে পারেনি।
দাউদ এত কথা বলত, এত এত কথা! আমরা এত আড্ডা-গল্প দিয়েছি। ১৯৬৯ সাল থেকে। হাসান ফেরদৌস আর দাউদ খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা একই পাড়ার। ঢাকার মালিবাগ মোড় এলাকার।
একসঙ্গে একটা পত্রিকা করতাম আমরা। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিল হাসান ফেরদৌস। আমিও ছিলাম সম্পাদনা পর্ষদে। আরেকজন মারা গেছে আমাদের বন্ধু তৌফিক খান মজলিশ, সেও ছিল। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকজন। যেমন ওয়াসি আহমেদ।
তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাউদ চলে গেল। দুর্দান্ত কবিতা লিখত দাউদ। কবিতা লিখে কীভাবে বিখ্যাত হতে হয়, তা ও জানত। এ নিয়ে আমরা ওকে ঠাট্টাও করতাম। ওর প্রথম কবিতার বইটা যখন ছাপা হলো, সেই কবিতার বইয়ের জন্য পুরস্কার পেল। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ও। পুরস্কার পাওয়ার পরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে একটা সংবর্ধনার ব্যবস্থা করি আমরা দাউদের জন্য। সেখানে লোকজন অনেক প্রশংসা করেছে। শওকত ওসমান অনেক দীর্ঘ এক আলোচনা করেছিলেন দাউদের কবিতা নিয়ে। এটা একটা বিরাট পাওয়া। তিনি আমাদের ‘স্যার’ ছিলেন ঢাকা কলেজে।
পরবর্তী সময় দাউদ দৈনিক ‘সংবাদ’-এ যোগ দিল সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। সেই কম বয়সী দাউদ। সবার কাছে লেখার জন্য যোগাযোগ করত। আমিই খুব একটা লিখিনি।
দাউদ সজ্জন মানুষ ছিল। খুবই সজ্জন। এরপর সে লিখল তার সেই কবিতাটা— ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়’। ওটাই ওর কাল হলো। খুব বিখ্যাত হলো বটে। কিন্তু বিরাট ঝামেলাও শুরু হলো। আমরা তাও প্রতিবাদ করেছিলাম যে এ তো কবির লেখা, কবিতাই। আহমদ ছফা, ছফা ভাই আমাদের সঙ্গে শামিল ছিলেন সে সময়। গুণদা, নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন। কবি-সাহিত্যিকেরা মিলে একটা প্রচেষ্টা নিয়েছিল তখন।
দাউদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। এখন যেমন আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়, সে রকম নয়। প্রিভেনটিভ কাস্টডি। যাতে দাউদের ক্ষতি না হয়। দাউদের পরিবার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী সাহেবের পরিচিত ছিল। বৃহত্তর পাবনার লোক ওরা।
তখন বলা হলো যে নিরাপদ হয় দাউদ যদি দেশ ছেড়ে চলে যায়। দাউদ দেশ ছেড়ে চলে গেল। প্রথমে কলকাতায়, পরে নানা স্থান ঘুরে জার্মানি।
তারপর তো আর দেখা হয় না। কিন্তু আমাদের যোগাযোগ ছিল। তখনকার দিনে তো যোগাযোগব্যবস্থা এখনকার মতো এত সুলভ ছিল না, এত কিছুও ছিল না। তারপরও ছিল যোগাযোগ।
একবার কলকাতায় গিয়েছিলাম। ১৯৭৮ সালের পরে। দাউদ তখন লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাসায় থাকত। ওইখানে নিয়ে গেল। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তাঁর স্ত্রী বোধ হয় আমেরিকান ছিলেন। ওই সময় আরও অনেকের সঙ্গেই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল দাউদ। দাউদ আমাদের নাটক দেখাতেও নিয়ে গেল। আমরা গিয়ে নাটক দেখলাম। চা-কফি খেলাম। তারপর আরও কয়েকবার দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে। তখনই বুঝেছিলাম, ও খুব কষ্টে আছে। দেশে ফিরতে পারছে না, এইটাই হচ্ছে প্রধান কষ্ট। তবে রাজনৈতিক পরিবর্তন যখন হলো, পঁচাত্তরের পরে, দেশে এসেছিল কয়েকবার। আমার সঙ্গে যে সব সময় দেখা হয়েছে, তা না। শেষে তো নির্বাসনেই চলে গেল।
দাউদের জীবনযাপন ছিল ওর নিজের মতো। কখনো এখানে, কখনো ওখানে। কোথাও স্থির তো সে ছিল না। বিলেতে থাকল, আমেরিকায় থাকল। এরপর জার্মানিতে চলে গেল। হয়তো কোনো জায়গায় নিরাপদ বোধ করছিল না সে।
আমার মনে আছে, গুন্টার গ্রাস যখন কলকাতায় এসেছিলেন, দাউদ তাঁর সঙ্গে অনেক ঘুরেছে কলকাতায়। আমাকে গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন যে ‘দাউদ এত সজ্জন, যা-ই চাই না কেন ও একটা ব্যবস্থা করে দেয়।’
এরপর দাউদ চলে গেল জার্মানি। হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে হয়তো তার যোগাযোগটা বেশি ছিল। আমার সঙ্গে ফোনে, মাঝেমধ্যে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কথা বলতাম। পুরোনো বন্ধুদের আড্ডা-ফাজলামো যেমন হয় আরকি। ওর সঙ্গে আর সিরিয়াস আলাপ কিসে!
জীবনে ওর অনেকগুলো আঘাত ছিল। একটা অ্যাকসিডেন্টের মধ্যে পড়ে গেল। সেই তার শরীর খারাপের শুরু। সম্প্রতি ওর ভাই জাহিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শুনলাম যে ও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিল। আগেও ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছে, দুবার নাকি তিনবার। সেই ক্যানসার তো ছিলই। একবার স্ট্রোক করে পড়ে গেল।
তো এই বয়সে এসে আর টিকে থাকা কঠিন। কখনোই সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করত না দাউদ। থাকত একা। কে তাকে দেখাশোনা করবে?
এই যে তেরো তলা থেকে বারো তলা পর্যন্ত সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল! ডাক্তার ওকে জিজ্ঞেস করেছিল যে তোমাকে কি কেউ আক্রমণ করেছে? ওকে কে আক্রমণ করবে?
লোকজন ওর ছবি পাঠাত আমার কাছে। হাসপাতালে শুয়ে আছে। বড্ড খারাপ লেগেছে তা দেখে! এই উচ্ছল বাচাল মানুষটা নীরব হয়ে গেছে। আমি হয়তো মনের দিক থেকে তখনই মেনে নিয়েছি যে দাউদ আর থাকবে না।
আজকে সকালবেলা শুনলাম যে দাউদ নেই। এই বয়সেও মানুষের এত কষ্ট হতে পারে, এটা আমি ভাবিনি। আমাদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে হাসান ফেরদৌস দেশের বাইরে। মনজুরুল হক জাপানে চলে গেল। ওয়াসির সঙ্গে তো আজকাল যোগাযোগও হয় না। আমি আছি নতুন বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের সঙ্গে।
উনিশ শ উনসত্তরের আগে সাহিত্যের যে ধারাবাহিকতা ছিল, তার একটা অংশ দাউদ। দাউদ অনেক ভালো কবিতা লিখেছে। কিন্তু সেগুলোর কথা মানুষ বলে না। দাউদের ‘পাবলিক-পার্সোনালিটি’ বড় হয়ে গেল ওর কাব্য-ব্যক্তিত্বের চেয়ে।
দাউদের মৃত্যুতে কী আর বলি! পাঠক ওর কবিতা পড়লেই বুঝতে পারবেন, কেমন কবি ছিল আমার বন্ধু দাউদ হায়দার।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র বন ধ আম দ র কলক ত
এছাড়াও পড়ুন:
চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
চিনি আর লবণ– দুটিই সাদা ও ঝকঝকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক হলেও তাদের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সরল অথচ গভীর সত্যটি আমাদের চারপাশের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আজ যখন মানুষ শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখোশ পরে এগিয়ে আসে, আমরা বুঝতে পারি না– কে চিনি, কে লবণ। এই বিভ্রমের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তার ফলে সমাজে জন্ম নিচ্ছে ভাঙন, ক্ষয় ও ব্যথার করুণ কাব্য।
শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে প্রতারণার ছায়া আজ সমাজের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বন্ধুত্বের আবরণে, কখনও আত্মীয়তার মোড়কে, আবার কখনও নির্ভরতার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের বারবার আহত করে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন বা পারিবারিক জীবন– বিশ্বাসের অবক্ষয়ের নির্মম চিত্র আজ সর্বত্র বিদ্যমান। সবচেয়ে আপন বলে যার হাত ধরেছি, সেই হাত কখন যে ছুরি হয়ে ফিরে আসে– বলা দুষ্কর।
সম্প্রতি রাজধানীর উপকণ্ঠে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে। বৃদ্ধ মা তাঁর তিন সন্তানকে অকুণ্ঠ বিশ্বাস করে সব সম্পত্তি লিখে দেন। সন্তানরা কথা দিয়েছিল– শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের পাশে থাকবে। কিন্তু দলিলের কালি শুকানোর আগেই মাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের চোখের জল তখন ছিল মূল্যহীন; সম্পদের নেশাই ছিল মূল।
অন্যদিকে দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধু ব্যবসার আড়ালে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে রাতের অন্ধকারে। এসব গল্প আজ প্রতিটি নগর-পল্লীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্পর্কের পবিত্রতা আজ যেন লোভ ও মুনাফার কাছে নতজানু।
বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা কোনো দাগের মতো নয়, যা সময়ের সঙ্গে মুছে যায়। বরং এটি মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। একজনের আঘাত শুধু তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; ছড়িয়ে পড়ে সমাজজুড়ে। গড়ে ওঠে এক অবিশ্বাসের দেয়াল, যেখানে একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সম্পর্কের উষ্ণতা ক্রমে ঠান্ডা হতে হতে বরফে পরিণত হয়, যা গলাতে লাগে যুগের পর যুগ।
ভোগবাদী সভ্যতা মানুষকে করে তুলেছে আত্মকেন্দ্রিক। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার সংকট এবং তাৎক্ষণিক লাভের মোহে সম্পর্কও আজ মুনাফার মাপে মাপা হয়। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রেম– সবকিছু যেন পরিণত হয়েছে একেকটি চুক্তিতে। ‘কে কতটা কাজে লাগবে’– এই প্রশ্নই আজ সম্পর্কের মানদণ্ড। তবে সব আলো নিভে যায়নি। অন্ধকার যত গভীর হোক, এক টুকরো মোমবাতি গোটা ঘর আলোকিত করতে পারে। এই সংকটময় সময়ে আমাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক হতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবেগের তাড়নায় নয়, বিবেকের আলোয় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। শিশুর মনে শৈশব থেকেই সততা, বিশ্বস্ততা ও মানবিকতার বীজ বপন করতে হবে। পরিবারই হচ্ছে ব্যক্তিত্ব গঠনের মূল কেন্দ্র। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে সমাজে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা পায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। তবু এই অন্ধকারে কিছু আলোকবর্তিকা রয়েছেন, যারা এখনও বিশ্বাসের মানদণ্ডে অবিচল। যাদের জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, অপরের কল্যাণে নিবেদিত। সংকটে পাশে দাঁড়ানো, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলানো– এটাই তাদের ধর্ম। এরা প্রমাণ করে– বিশ্বাস এখনও বিলুপ্ত হয়নি পুরোপুরি। শুধু খুঁজে নিতে জানতে হবে।
পরিশেষে, চিনি ও লবণের বাহ্যিক সাদার ভ্রম নয়, আসল স্বাদ বোঝার সক্ষমতা অর্জন করাই আজ সময়ের দাবি। মানুষকে তার কার্যকলাপের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে; বাহ্যিক মোহের ফাঁদে পা না দিয়ে। অন্ধবিশ্বাস নয়– সচেতন, বিবেকবান বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে সম্পর্কের ভিত।
মুহাম্মদ ইমাদুল হক প্রিন্স: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়