আজ সকাল সাতটা-আটটার দিকে জার্মানি প্রবাসে নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার, আমাদের দাউদের মৃত্যুর খবর পেলাম। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। দাউদ আমার বন্ধু। আমি তো ওকে কবি-সাহিত্যিক হিসেবে দেখতাম না। বন্ধু হিসেবেই দেখি।

দাউদের ছোট ভাই জাহিদ হায়দার আমাকে কদিন ধরেই বলছিল যে মনটা শক্ত করুন। ডাক্তার বলে দিয়েছে, দাউদ আর ফেরত আসবে না। আমি তাই প্রস্তুত ছিলাম একরকম। কষ্টটা কম করে গেছে আশা করি। ওর জ্ঞান ফিরেছিল। কথা বলতে পারেনি।

দাউদ এত কথা বলত, এত এত কথা! আমরা এত আড্ডা-গল্প দিয়েছি। ১৯৬৯ সাল থেকে। হাসান ফেরদৌস আর দাউদ খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা একই পাড়ার। ঢাকার মালিবাগ মোড় এলাকার।

একসঙ্গে একটা পত্রিকা করতাম আমরা। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিল হাসান ফেরদৌস। আমিও ছিলাম সম্পাদনা পর্ষদে। আরেকজন মারা গেছে আমাদের বন্ধু তৌফিক খান মজলিশ, সেও ছিল। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকজন। যেমন ওয়াসি আহমেদ।

তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাউদ চলে গেল। দুর্দান্ত কবিতা লিখত দাউদ। কবিতা লিখে কীভাবে বিখ্যাত হতে হয়, তা ও জানত। এ নিয়ে আমরা ওকে ঠাট্টাও করতাম। ওর প্রথম কবিতার বইটা যখন ছাপা হলো, সেই কবিতার বইয়ের জন্য পুরস্কার পেল। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ও। পুরস্কার পাওয়ার পরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে একটা সংবর্ধনার ব্যবস্থা করি আমরা দাউদের জন্য। সেখানে লোকজন অনেক প্রশংসা করেছে। শওকত ওসমান অনেক দীর্ঘ এক আলোচনা করেছিলেন দাউদের কবিতা নিয়ে। এটা একটা বিরাট পাওয়া। তিনি আমাদের ‘স্যার’ ছিলেন ঢাকা কলেজে।

পরবর্তী সময় দাউদ দৈনিক ‘সংবাদ’-এ যোগ দিল সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। সেই কম বয়সী দাউদ। সবার কাছে লেখার জন্য যোগাযোগ করত। আমিই খুব একটা লিখিনি।

দাউদ সজ্জন মানুষ ছিল। খুবই সজ্জন। এরপর সে লিখল তার সেই কবিতাটা— ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়’। ওটাই ওর কাল হলো। খুব বিখ্যাত হলো বটে। কিন্তু বিরাট ঝামেলাও শুরু হলো। আমরা তাও প্রতিবাদ করেছিলাম যে এ তো কবির লেখা, কবিতাই। আহমদ ছফা, ছফা ভাই আমাদের সঙ্গে শামিল ছিলেন সে সময়। গুণদা, নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন। কবি-সাহিত্যিকেরা মিলে একটা প্রচেষ্টা নিয়েছিল তখন।

দাউদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। এখন যেমন আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়, সে রকম নয়। প্রিভেনটিভ কাস্টডি। যাতে দাউদের ক্ষতি না হয়। দাউদের পরিবার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী সাহেবের পরিচিত ছিল। বৃহত্তর পাবনার লোক ওরা।

তখন বলা হলো যে নিরাপদ হয় দাউদ যদি দেশ ছেড়ে চলে যায়। দাউদ দেশ ছেড়ে চলে গেল। প্রথমে কলকাতায়, পরে নানা স্থান ঘুরে জার্মানি।

তারপর তো আর দেখা হয় না। কিন্তু আমাদের যোগাযোগ ছিল। তখনকার দিনে তো যোগাযোগব্যবস্থা এখনকার মতো এত সুলভ ছিল না, এত কিছুও ছিল না। তারপরও ছিল যোগাযোগ।

একবার কলকাতায় গিয়েছিলাম। ১৯৭৮ সালের পরে। দাউদ তখন লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাসায় থাকত। ওইখানে নিয়ে গেল। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তাঁর স্ত্রী বোধ হয় আমেরিকান ছিলেন। ওই সময় আরও অনেকের সঙ্গেই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল দাউদ। দাউদ আমাদের নাটক দেখাতেও নিয়ে গেল। আমরা গিয়ে নাটক দেখলাম। চা-কফি খেলাম। তারপর আরও কয়েকবার দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে। তখনই বুঝেছিলাম, ও খুব কষ্টে আছে। দেশে ফিরতে পারছে না, এইটাই হচ্ছে প্রধান কষ্ট। তবে রাজনৈতিক পরিবর্তন যখন হলো, পঁচাত্তরের পরে, দেশে এসেছিল কয়েকবার। আমার সঙ্গে যে সব সময় দেখা হয়েছে, তা না। শেষে তো নির্বাসনেই চলে গেল।

দাউদের জীবনযাপন ছিল ওর নিজের মতো। কখনো এখানে, কখনো ওখানে। কোথাও স্থির তো সে ছিল না। বিলেতে থাকল, আমেরিকায় থাকল। এরপর জার্মানিতে চলে গেল। হয়তো কোনো জায়গায় নিরাপদ বোধ করছিল না সে।

আমার মনে আছে, গুন্টার গ্রাস যখন কলকাতায় এসেছিলেন, দাউদ তাঁর সঙ্গে অনেক ঘুরেছে কলকাতায়। আমাকে গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন যে ‘দাউদ এত সজ্জন, যা-ই চাই না কেন ও একটা ব্যবস্থা করে দেয়।’

এরপর দাউদ চলে গেল জার্মানি। হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে হয়তো তার যোগাযোগটা বেশি ছিল। আমার সঙ্গে ফোনে, মাঝেমধ্যে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কথা বলতাম। পুরোনো বন্ধুদের আড্ডা-ফাজলামো যেমন হয় আরকি। ওর সঙ্গে আর সিরিয়াস আলাপ কিসে!

জীবনে ওর অনেকগুলো আঘাত ছিল। একটা অ্যাকসিডেন্টের মধ্যে পড়ে গেল। সেই তার শরীর খারাপের শুরু। সম্প্রতি ওর ভাই জাহিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শুনলাম যে ও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিল। আগেও ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছে, দুবার নাকি তিনবার। সেই ক্যানসার তো ছিলই। একবার স্ট্রোক করে পড়ে গেল।

তো এই বয়সে এসে আর টিকে থাকা কঠিন। কখনোই সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করত না দাউদ। থাকত একা। কে তাকে দেখাশোনা করবে?

এই যে তেরো তলা থেকে বারো তলা পর্যন্ত সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল! ডাক্তার ওকে জিজ্ঞেস করেছিল যে তোমাকে কি কেউ আক্রমণ করেছে? ওকে কে আক্রমণ করবে?

লোকজন ওর ছবি পাঠাত আমার কাছে। হাসপাতালে শুয়ে আছে। বড্ড খারাপ লেগেছে তা দেখে! এই উচ্ছল বাচাল মানুষটা নীরব হয়ে গেছে। আমি হয়তো মনের দিক থেকে তখনই মেনে নিয়েছি যে দাউদ আর থাকবে না।

আজকে সকালবেলা শুনলাম যে দাউদ নেই। এই বয়সেও মানুষের এত কষ্ট হতে পারে, এটা আমি ভাবিনি। আমাদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে হাসান ফেরদৌস দেশের বাইরে। মনজুরুল হক জাপানে চলে গেল। ওয়াসির সঙ্গে তো আজকাল যোগাযোগও হয় না। আমি আছি নতুন বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের সঙ্গে।

উনিশ শ উনসত্তরের আগে সাহিত্যের যে ধারাবাহিকতা ছিল, তার একটা অংশ দাউদ। দাউদ অনেক ভালো কবিতা লিখেছে। কিন্তু সেগুলোর কথা মানুষ বলে না। দাউদের ‘পাবলিক-পার্সোনালিটি’ বড় হয়ে গেল ওর কাব্য-ব্যক্তিত্বের চেয়ে।

দাউদের মৃত্যুতে কী আর বলি! পাঠক ওর কবিতা পড়লেই বুঝতে পারবেন, কেমন কবি ছিল আমার বন্ধু দাউদ হায়দার।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র বন ধ আম দ র কলক ত

এছাড়াও পড়ুন:

সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী

চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।

বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

নিখুঁত নয়

জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।

গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’

জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।

জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।

তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।

আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন

তবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।

ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।

বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’

তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’

কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’

আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।

এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’

আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ