১.

উত্তরবঙ্গের বড়াল একটি ব্যতিক্রমী নদ। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদ–নদী উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। পক্ষান্তরে বড়াল মূলত পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় গঙ্গা (পদ্মা) থেকে উৎপত্তি হয়ে এই নদ নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণমুখী অগ্রসর হয়ে হুরসাগর নদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাঘাবাড়ীর কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

বড়ালের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি পদ্মা ও যমুনার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী নদ; অন্তত আগে তা–ই ছিল। এই নদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি রাজশাহী বিভাগের বিশাল চলনবিলের প্রধান নদ।

উত্তর থেকে প্রবাহিত প্রায় সব নদ–নদী, যেমন আত্রাই, নাগর, শিবা, বারনাল, করতোয়া, গুমানী, হুরসাগর আলাদাভাবে কিংবা অন্য নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বড়াল নদের সঙ্গে মিশেছে। ফলে চলনবিলকে বিশাল সংরক্ষণ জলাধার হিসেবে ব্যবহার করে পদ্মা-যমুনার প্রবাহের উচ্চতার ভারসাম্য রক্ষাকারী নদ ছিল বড়াল।

একদা প্রমত্ত এই নদ দিয়ে পালতোলা বড় বড় সওদাগরি নৌকা চলাচল করত। বড়াল গোটা চলনবিল এলাকাকে সজীব রাখত, কৃষির জন্য পানি জোগাত এবং বহু প্রজাতির মাছের আধার হিসেবে কাজ করত। শুধু রাজশাহী বিভাগের জন্য নয়, গোটা পদ্মা-যমুনা অববাহিকার জন্যই বড়ালকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

২.

নদ–নদীর বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের ভ্রান্ত নীতি ও পদক্ষেপের মাধ্যমে এই নদকে আক্ষরিক অর্থেই বলা যেতে পারে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ১৯৮৪ সালে; যখন বড়ালের উৎসমুখে মাত্র তিন কপাটবিশিষ্ট একটি স্লুইসগেট নির্মিত হয়, যার সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩০ ফুটের মতো। মুক্তাবস্থায় বড়ালের মুখের প্রশস্ততা ছিল ৫০০ ফুটের মতো এবং তা দিয়ে বর্ষাকালে পদ্মার গড়ে প্রায় ২০ হাজার কিউসেক পানি বড়াল নদে প্রবেশ করত।

স্লুইসগেট নির্মাণের পর এর পরিমাণ দ্রুতই গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার কিউসেকে হ্রাস পায়। স্বল্প প্রশস্ততার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই স্লুইসগেটের পাটাতনের উচ্চতা, যা ছিল ১০ দশমিক ২ মিটার (পিডব্লিউডি)। ফলে পদ্মার পানি উচ্চতার কারণেও বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং স্লুইসগেটের মুখে পলিপতন ঘটে। অচিরেই পদ্মা নদী থেকে বড়াল নদ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ শুধু চারঘাটে স্লুইসগেট বানিয়েই সন্তুষ্ট হয়নি, ১৯৯৫ সালে তারা আটঘরিতে (যেখানে বড়াল নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে নন্দকুজা নামে একটি শাখানদী উত্তর দিকে প্রবাহিত হয় সেখানে) আরও দুটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। তার মধ্যে পাঁচ কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট নন্দকুজার দিকে এবং এক কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট মূল বড়ালের দিকে। একটি নদীর ওপর এক কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট নির্মাণ করা যায়, তা ভাবতেও অবাক লাগে এবং দেখলে কান্না পায়!

এসব স্লুইসগেট বড়াল হত্যার প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করে। আটঘরি থেকে বড়াইগ্রাম পর্যন্ত বড়াল নদ সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় এবং সেখান থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদের ওপর মাটির অনেকগুলো আড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়, যার ফলে নদটি কতগুলো বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়।

এভাবেই এককালের জীবন্ত বড়াল একটি ‘মৃত’ নদে পরিণত হয়। জনগণে এটাকে নাম দেয় ‘মরা বড়াল’।

বলা বাহুল্য, নদ হত্যার এ প্রক্রিয়ায় পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহযোগী হয় স্থানীয় অসাধু রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীরা, যারা এই সুযোগে নদের জমি দখল করে, বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত নদে মাছ ধরার ইজারা নেয় এবং বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ থেকে মুনাফা অর্জন করে।

৩.

নদের এ ‘অকালমৃত্যু’র পর বড়ালপারের সাধারণ জনগণের মনে ক্ষোভ আর দুঃখের সীমা থাকে না। তাঁরা ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং অন্যান্য পরিবেশ ও নদী রক্ষা সংগঠন তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে।

তাদের প্রচেষ্টায় বড়াল নদের বিষয়টি সরকারের নদীবিষয়ক টাস্কফোর্সের আলোচ্যসূচির (এজেন্ডা) মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। টাস্কফোর্সের সভাপতিসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তারা একাধিকবার বড়াল এলাকা পরিদর্শ করেন। জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁরা স্থানীয় জনগণকে বড়াল নদ অবমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।

২০১৩ সালে ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’-এর উদ্যোগে বড়ালের পাড় ধরে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০১৯ সালে সরকারকে ‘বড়াল নদের প্রবাহকে বাধামুক্ত করার’ আদেশ দেন।   

উচ্চ আদালতের এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মরা’ বড়ালের ওপর নির্মিত মাটির চারটি আড়িবাঁধ অপসারণ করে সেখানে সেতু নির্মিত হয়। কিন্তু সমস্যার উৎস, তথা চারঘাট ও আটঘরির স্লুইসগেটগুলো অপসারিত হয় না।

পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পদ্মার সঙ্গে বড়ালের উৎসমুখে ১ হাজার ৮০০ মিটার দীর্ঘ মাটি খনন করে। কিন্তু চারঘাটের স্লুইসগেটের কারণে এই মাটি খনন কোনো স্থায়ী প্রভাব রাখতে পারে না। এর কারণ, পলিপতনে খনন করা অংশ পুনরায় ভরাট হয়ে যায়। 

নদী রক্ষা করতে চাওয়া সংগঠনগুলো বড়াল নদসংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আদেশ পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্সের সভায় চাপ সৃষ্টি করে। এরপর পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আমলাতান্ত্রিক কূটবুদ্ধির আশ্রয় নেয়। তারা যুক্তি দেখায়, স্লুইসগেটগুলো অপসারণ করার আগে এর অভিঘাত কী হতে পারে, তা নির্ণয়ের জন্য সমীক্ষা সম্পাদন প্রয়োজন।

এভাবে বড়াল অবমুক্তকরণের গোটা প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। জানানো হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) দ্বারা এরূপ একটি সমীক্ষা সম্পাদন করবে।

৪.

প্রায় ১০ বছর পর ২০১৮ সালে আইডব্লিউএম ‘বড়াল অববাহিকার পানিসম্পদ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে পরিবেশ ও সামাজিক অভিঘাতের মূল্যায়নসহ বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’র প্রতিবেদন পেশ করে।

এ সমীক্ষায় জানানো হয়, শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি বড়ালে প্রবাহিত করার প্রয়াস সমীচীন নয়। কারণ, ফারাক্কার প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানিসীমা অত্যন্ত নিচে নেমে যায়।

এ রকম অবস্থায় আইডব্লিউএমের মূল সুপারিশ হলো শুধু পদ্মার বর্ষাকালীন প্রবাহ আরও বেশি হারে বড়ালের দিকে প্রবাহিত করা। তবে এটা করার জন্য আইডব্লিউএম এক অভিনব সুপারিশ করে। সেটা হলো, চারঘাটের বর্তমান স্লুইসগেটের পাশে আরেকটি দুই কপাটের রেগুলেটর নির্মাণ করা।

বড়াল অববাহিকার জনগণের দাবি হলো স্লুইসগেট অপসারণ এবং এই দাবির জন্য তাঁরা প্রায় ২০ বছর ধরে সংগ্রাম করছেন। এর চেয়েও
বড় কথা, উচ্চ আদালত যেখানে বড়ালের প্রবাহকে বাধামুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে আইডব্লিউএমের সুপারিশ হচ্ছে আরও স্লুইসগেট বানাও!

লক্ষণীয়, আইডব্লিউএম জানায়, বড়ালের বিষয়ে সুপারিশে পৌঁছানোর জন্য ১০টি সম্ভাব্য পরিস্থিতি শনাক্ত করা হয় এবং এগুলোর মধ্যে ৮ নম্বর পরিস্থিতিকে সবচেয়ে ভালো মনে করা হয়। কিন্তু এই ১০টি পরিস্থিতির মধ্যে একটিতেও চারঘাট স্লুইসগেট অপসারণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

মূল যেটা জানার বিষয় ছিল (চারঘাট স্লুইসগেট অপসারণ করার অভিঘাত কী হবে), সেটাই এই সমীক্ষায় পরীক্ষা করা হয়নি। তা না করে আইডব্লিউএম পাউবোর জন্য ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তুত করে দিয়েছে।

এ অর্থের একটি বড় অংশ নির্ধারিত হয়েছে নদী খননের জন্য। তার মধ্যে রয়েছে ‘মরা’ বড়ালের ১১০ কিলোমিটার খনন। তার সঙ্গে আরও যোগ করা হয়েছে মুসাখান ও নারদ নদের আংশিক খনন। কিন্তু খননের সুফল স্থায়ী হবে না, যদি না বড়াল নদে পদ্মার বর্ষাকালীন প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়।

লক্ষণীয় হলো, নদের মুখ যদি পর্যাপ্তরূপে উন্মুক্ত করা না যায়, তাহলে পদ্মার বর্ষাকালীন প্রবাহ বড়ালে পৌঁছাবে না। তার জন্য প্রয়োজন চারঘাটের স্লুইসগেট অপসারণ করে নদের আদি প্রস্থভিত্তিক (কমপক্ষে ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের) সেতু নির্মাণ।

আরও যা লক্ষ করার মতো বিষয়, আইডব্লিউএম প্রস্তাবিত নতুন রেগুলেটরের পাটাতনের উচ্চতা হবে ৯ দশমিক ২ মিটার। ফলে এটাও বড়ালের প্রবেশদ্বারে পলিপতন ঘটাবে এবং বড়ালের সমস্যার নিরসনে কোনোই অবদান রাখবে না।

৫.

আইডব্লিউএম বিভিন্ন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে যদি চারঘাটে কোনো রেগুলেটর না থাকে, তাহলে ২৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হবে। এটা দ্বারা আইডব্লিউএম বাংলাদেশের পানি সমস্যার মূল চরিত্র অনুধাবনে ব্যর্থতার স্বাক্ষর দিয়েছে এবং ওলন্দাজদের দ্বারা আরোপিত পোল্ডার পন্থার অন্ধ অনুকরণ করছে।

এই ‘পোল্ডার পন্থা’ গোটা চলনবিলকে বিপর্যস্ত করেছে। এই পন্থার অনুসরণে চলনবিলের উত্তর ভাগে আত্রাই ও বারনাই নদের অববাহিকায় নির্মিত পোল্ডার এ, বি, সি এবং ডি চলনবিলের স্বাভাবিক চরিত্রকে বিনষ্ট করেছে। দক্ষিণে পাবনা সেচ প্রকল্পের নামে বড়াল অববাহিকার দক্ষিণ ভাগকে ইছামতী নদীসহ অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। পূর্বে ব্রহ্মপুত্র ডান তীর রক্ষা বাঁধের নামে আটটি নদীর সংযোগ রুদ্ধ করার মাধ্যমে চলনবিলের দিকে যমুনার প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে।

পোল্ডার পন্থাভিত্তিক এই সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে চলনবিল আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে (বাংলাদেশের জন্য ওলন্দাজদের পোল্ডার পন্থার অসারতা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন লেখকের সাম্প্রতিক বই বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন: বর্তমান ধারার সংকট ও বিকল্প পথের প্রস্তাব এবং ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ: পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার)।

বর্ষাকালে বিল প্লাবিত হবে—এটাই প্রত্যাশিত এবং প্রয়োজন। জনগণ এই প্লাবনের পক্ষে এবং সে জন্যই তাঁরা চারঘাটের রেগুলেটরের অপসারণ চান। পরিতাপের বিষয়, এই সহজ যুক্তি আইডব্লিউএমের গবেষকেরা বুঝতে সক্ষম হননি! 

৬.

নদী বা পানিসম্পদের বিষয়ে আসলে যুক্তির চেয়ে বৈষয়িক স্বার্থই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে যে কেউ বলতে পারেন, পাউবো এবং আইডব্লিউএম পরস্পরের বৈষয়িক স্বার্থ রক্ষায় ‘যত্নবান’। পাউবো আইডব্লিউএমকে বিরাট বাজেটের সমীক্ষা প্রণয়নের কাজ দেয়। বিনিময়ে আইডব্লিউএম এমন সব সুপারিশ ‘উপহার’ দেয়, যা পাউবোকে বিরাট বাজেটের প্রকল্প প্রণয়নের সুযোগ করে দেয়। বৈষয়িক স্বার্থের এই বেড়াজালে নদী ও জনগণের স্বার্থ তাই গৌণ হয়ে যায়।

ধারণা করা হয়েছিল, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এ বিষয়ে কিছু পরিবর্তন আসবে। জনগণের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে। গণ-অভ্যুত্থানের ফলে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে বড়াল রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সুহৃদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অন্তর্ভুক্তি বড়াল অববাহিকার জনগণের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু এরপরও বড়ালের অবমুক্তি বিষয়ে গত ৯ মাসে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। তাহলে আমাদের আশা কি শেষ পর্যন্ত দুরাশায় পরিণত হবে?

ড. নজরুল ইসলাম অধ্যাপক, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ল ইসগ ট ন র ম ল দ শ পর ব শ ট স ল ইসগ ট স ল ইসগ ট র ন র ম ণ কর চলনব ল র বর ষ ক ল ন র জন য প রব হ ত ম ক ত কর র প রব হ অবম ক ত জনগণ র নদ র স ত কর র বড় ল র পদ ম র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ইসলামের ইতিহাসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ

মদিনার মসজিদে নববিতে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। একদল সাহাবা জড়ো হয়েছেন, তাঁদের কণ্ঠে ন্যায়বিচারের দাবি। তাঁরা খলিফার কাছে তাঁদের অভিযোগ তুলে ধরছেন, কিন্তু তাঁদের হাতে তরবারি নেই—আছে কোরআন। এই দৃশ্য ইসলামি ইতিহাসের একটি চিরন্তন ছবি। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, যা মুসলিম সমাজের ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতীক, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে। মিছিল, সংলাপ, প্রতীকী অভিযোগ, মসজিদে সমবেত দোয়া—এসব ছিল মুসলিমদের অধিকার আদায়ের শান্তিপূর্ণ অস্ত্র। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামের ইতিহাসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ধর্মীয় শিকড়, খেলাফতের যুগে এর প্রাথমিক রূপ এবং এর সামাজিক তাৎপর্য অনুসন্ধান করব।

ন্যায়ের জন্য কথা বলার আহ্বান

ন্যায়বিচার ইসলামের মূল শিক্ষার অন্যতম। কোরআন বলে, ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাক্ষী হও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১৩৫)

এই আয়াত মুসলিমদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে উৎসাহিত করে, এমনকি তা শাসকের বিরুদ্ধে হলেও। মহানবী (সা.) ছিলেন এই শিক্ষার জীবন্ত উদাহরণ। তিনি জনগণের অভিযোগ শুনতেন এবং তাদের কথা বলার অধিকার রক্ষা করতেন। একটি হাদিসে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং দুর্বল ও প্রয়োজনীয়দের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে বিচ্ছিন্ন করবেন।’ (সুনানে তিরমিজি: ১,৪১০; আবু দাউদ: ২,৯৪৮; মুসনাদে আহমদ: ২১,৫৮৪)

রাশিদুন খলিফারা এই শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর মদিনার মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি তোমাদের দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম নই। যদি আমি ভালো করি, তবে আমাকে সাহায্য করো; আর যদি আমি ভুল করি, তবে আমাকে সংশোধন করো।’ (ইমাম মালিক, মুয়াত্তা, ২/৮৮১, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৮৫)

এই বক্তব্য জনগণকে শাসকের তদারকি ও সংশোধনের অধিকার দিয়েছিল। ইমাম মালিক (৭১১-৭৯৫ খ্রি.) বলেন, ‘এই শর্ত ছাড়া কেউ ইমাম হতে পারে না।’ (আল-কুরতুবি, তাফসিরুল কুরতুবি, ৫/২১২, কায়রো: দারুল কুতুব, ১,৯৬৪)

এই ধর্মীয় শিকড় মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করেছিল। প্রতিবাদ ছিল ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ (ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেওয়া)-এর অংশ, যা মুসলিমদের ধর্মীয় দায়িত্ব।

আরও পড়ুনসাবধানী মানুষের নয়টি গুণ০৭ মে ২০২৫

খিলাফত যুগে প্রতিবাদের প্রথম রূপ

খিলাফতের যুগে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে। এটি কখনো সংলাপ, কখনো সমাবেশ, আবার কখনো প্রতীকী অভিযোগের মাধ্যমে। এই প্রতিবাদগুলো শাসক ও জনগণের মধ্যে একটি গতিশীল সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো:

উমরের (রা.) সংলাপ: মদিনার রাস্তায় খলিফা উমর বিন খাত্তাব (৫৮৪-৬৪৪ খ্রি.) হাঁটছেন। তিনি সাহাবি মুহাম্মদ বিন মাসলামার (মৃ. ৬৬৬ খ্রি.) সঙ্গে দেখা করেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি আমাকে কেমন দেখো?’ মুহাম্মদ (রা.) ছিলেন স্পষ্টভাষী। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাকে শক্তিশালী, ন্যায়পরায়ণ ও বিশুদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে দেখি। তবে আপনি যদি বিচ্যুত হন, আমরা আপনাকে সংশোধন করব, যেমন তীরকে সোজা করা হয়।’ উমর (রা.) হাসলেন এবং বললেন, ‘আল্লাহর প্রশংসা, যিনি আমাকে এমন জাতির মধ্যে রেখেছেন, যারা আমার ভুল সংশোধন করে।’ (ইমাম জাহাবি, তারিখুল ইসলাম, ৩/১২৫, দামেস্ক: দারুল কুতুব, ১৯৮৭)

উসমানের (রা.) সময় প্রতিবাদ: উসমান বিন আফফানের (৫৭৬-৬৫৬ খ্রি.) শাসনামলে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাঁর কিছু নীতি এবং কয়েকজন প্রশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। মদিনায় একদল প্রতিনিধি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। উসমান (রা.) প্রাথমিকভাবে এই প্রতিবাদের অধিকার স্বীকার করেন এবং সাহাবাদের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমি চাই না কেউ আমার জন্য রক্তপাত করুক।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭/২১৮, দামেস্ক: দারুল ফিকর, ১৯৮৮)

উমাইয়া যুগে প্রতিবাদ: উমাইয়া শাসনকালে মুয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ান (৬০২-৬৮০ খ্রি.) তাঁর পুত্র ইয়াজিদের জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারণ করেন, যা সাহাবাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ে। আবদুর রহমান বিন আবু বকর (মৃ. ৬৬৬ খ্রি.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এটি আবু বকর বা উমরের পদ্ধতি নয়, বরং হেরাক্লিয়াস বা কায়সারের পদ্ধতি।’ (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা, ৪/১৮৩, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯৫)

আরও পড়ুন সুরা তাহরিমে রয়েছে মানুষের জন্য কিছু শিক্ষা০২ জুন ২০২৪

একটি গতিশীল সমাজ

ইসলামের ইতিহাসে প্রতিবাদ মুসলিম সমাজের গতিশীলতা ও সংগঠিত কাঠামো প্রকাশ করে। মুসলিম সমাজ ঐক্য, সংঘ ও সম্প্রদায়ের মাধ্যমে সংগঠিত ছিল, যা শাসকদের একক আধিপত্য কঠিন করে তুলেছিল। উলামা ও সুফি সাধকেরা জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিতেন। ইতিহাসের সেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ঐতিহ্য আজও প্রাসঙ্গিক। তবে আধুনিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমরা দেখি, মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের অধিকার দাবি ঠিকই করে, কিন্তু মুসলিম শাসকেরা সব সময় সহনশীল থাকেন না, বরং অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সহিংস উপায়ে দমন করেন। মহানবী (সা.) ও রাশিদুন খলিফারা যেখানে জনগণকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে উৎসাহিত করেছেন, সেখানে মুসলিম শাসকেরা এখন বহুক্ষেত্রে বাক্‌স্বাধীনতা সীমিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে এখন করা প্রতিবাদগুলো মুসলিম সমাজের গতিশীলতা ও ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে ব্যর্থ হয়।

 আল–জাজিরা ডট নেট অবলম্বনে

আরও পড়ুনপার্থিব জাঁকজমক যেন আধ্যাত্মিকতার বাধা না হয়০৭ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সরকার হয়তো স্বৈরাচারের দোসরদের দেশত্যাগের সুযোগ করে দিচ্ছে: তারেক
  • ইসলামী আন্দোলনের হুঁশিয়ারি ‘নৈতিক অবক্ষয়ের চক্রান্ত সফল হবে না’  
  • আ.লীগ নিষিদ্ধ হবে কি না ঠিক করবে জনগণ: মঈন খান
  • নির্বাচনের চার মডেল
  • পাকিস্তানে হামলা ভারতকে বড় দ্বিধায় ফেলেছে
  • মাহফুজ-আসিফকে সরকার থেকে সরে আসা উচিত: তাসনুভা
  • করিডর দেওয়ার আগে বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলের রায় লাগবে: সারজিস আলম
  • ইসলামের ইতিহাসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ
  • সরকার নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর: উপদেষ্টা