এবার কি বড়াল নদের অবমুক্তি সম্ভব হবে
Published: 9th, May 2025 GMT
১.
উত্তরবঙ্গের বড়াল একটি ব্যতিক্রমী নদ। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদ–নদী উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। পক্ষান্তরে বড়াল মূলত পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় গঙ্গা (পদ্মা) থেকে উৎপত্তি হয়ে এই নদ নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণমুখী অগ্রসর হয়ে হুরসাগর নদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাঘাবাড়ীর কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
বড়ালের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি পদ্মা ও যমুনার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী নদ; অন্তত আগে তা–ই ছিল। এই নদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি রাজশাহী বিভাগের বিশাল চলনবিলের প্রধান নদ।
উত্তর থেকে প্রবাহিত প্রায় সব নদ–নদী, যেমন আত্রাই, নাগর, শিবা, বারনাল, করতোয়া, গুমানী, হুরসাগর আলাদাভাবে কিংবা অন্য নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বড়াল নদের সঙ্গে মিশেছে। ফলে চলনবিলকে বিশাল সংরক্ষণ জলাধার হিসেবে ব্যবহার করে পদ্মা-যমুনার প্রবাহের উচ্চতার ভারসাম্য রক্ষাকারী নদ ছিল বড়াল।
একদা প্রমত্ত এই নদ দিয়ে পালতোলা বড় বড় সওদাগরি নৌকা চলাচল করত। বড়াল গোটা চলনবিল এলাকাকে সজীব রাখত, কৃষির জন্য পানি জোগাত এবং বহু প্রজাতির মাছের আধার হিসেবে কাজ করত। শুধু রাজশাহী বিভাগের জন্য নয়, গোটা পদ্মা-যমুনা অববাহিকার জন্যই বড়ালকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
২.নদ–নদীর বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের ভ্রান্ত নীতি ও পদক্ষেপের মাধ্যমে এই নদকে আক্ষরিক অর্থেই বলা যেতে পারে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ১৯৮৪ সালে; যখন বড়ালের উৎসমুখে মাত্র তিন কপাটবিশিষ্ট একটি স্লুইসগেট নির্মিত হয়, যার সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩০ ফুটের মতো। মুক্তাবস্থায় বড়ালের মুখের প্রশস্ততা ছিল ৫০০ ফুটের মতো এবং তা দিয়ে বর্ষাকালে পদ্মার গড়ে প্রায় ২০ হাজার কিউসেক পানি বড়াল নদে প্রবেশ করত।
স্লুইসগেট নির্মাণের পর এর পরিমাণ দ্রুতই গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার কিউসেকে হ্রাস পায়। স্বল্প প্রশস্ততার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই স্লুইসগেটের পাটাতনের উচ্চতা, যা ছিল ১০ দশমিক ২ মিটার (পিডব্লিউডি)। ফলে পদ্মার পানি উচ্চতার কারণেও বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং স্লুইসগেটের মুখে পলিপতন ঘটে। অচিরেই পদ্মা নদী থেকে বড়াল নদ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ শুধু চারঘাটে স্লুইসগেট বানিয়েই সন্তুষ্ট হয়নি, ১৯৯৫ সালে তারা আটঘরিতে (যেখানে বড়াল নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে নন্দকুজা নামে একটি শাখানদী উত্তর দিকে প্রবাহিত হয় সেখানে) আরও দুটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। তার মধ্যে পাঁচ কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট নন্দকুজার দিকে এবং এক কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট মূল বড়ালের দিকে। একটি নদীর ওপর এক কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট নির্মাণ করা যায়, তা ভাবতেও অবাক লাগে এবং দেখলে কান্না পায়!
এসব স্লুইসগেট বড়াল হত্যার প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করে। আটঘরি থেকে বড়াইগ্রাম পর্যন্ত বড়াল নদ সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় এবং সেখান থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদের ওপর মাটির অনেকগুলো আড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়, যার ফলে নদটি কতগুলো বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়।
এভাবেই এককালের জীবন্ত বড়াল একটি ‘মৃত’ নদে পরিণত হয়। জনগণে এটাকে নাম দেয় ‘মরা বড়াল’।
বলা বাহুল্য, নদ হত্যার এ প্রক্রিয়ায় পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহযোগী হয় স্থানীয় অসাধু রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীরা, যারা এই সুযোগে নদের জমি দখল করে, বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত নদে মাছ ধরার ইজারা নেয় এবং বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ থেকে মুনাফা অর্জন করে।
৩.নদের এ ‘অকালমৃত্যু’র পর বড়ালপারের সাধারণ জনগণের মনে ক্ষোভ আর দুঃখের সীমা থাকে না। তাঁরা ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং অন্যান্য পরিবেশ ও নদী রক্ষা সংগঠন তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে।
তাদের প্রচেষ্টায় বড়াল নদের বিষয়টি সরকারের নদীবিষয়ক টাস্কফোর্সের আলোচ্যসূচির (এজেন্ডা) মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। টাস্কফোর্সের সভাপতিসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তারা একাধিকবার বড়াল এলাকা পরিদর্শ করেন। জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁরা স্থানীয় জনগণকে বড়াল নদ অবমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
২০১৩ সালে ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’-এর উদ্যোগে বড়ালের পাড় ধরে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০১৯ সালে সরকারকে ‘বড়াল নদের প্রবাহকে বাধামুক্ত করার’ আদেশ দেন।
উচ্চ আদালতের এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মরা’ বড়ালের ওপর নির্মিত মাটির চারটি আড়িবাঁধ অপসারণ করে সেখানে সেতু নির্মিত হয়। কিন্তু সমস্যার উৎস, তথা চারঘাট ও আটঘরির স্লুইসগেটগুলো অপসারিত হয় না।
পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পদ্মার সঙ্গে বড়ালের উৎসমুখে ১ হাজার ৮০০ মিটার দীর্ঘ মাটি খনন করে। কিন্তু চারঘাটের স্লুইসগেটের কারণে এই মাটি খনন কোনো স্থায়ী প্রভাব রাখতে পারে না। এর কারণ, পলিপতনে খনন করা অংশ পুনরায় ভরাট হয়ে যায়।
নদী রক্ষা করতে চাওয়া সংগঠনগুলো বড়াল নদসংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আদেশ পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্সের সভায় চাপ সৃষ্টি করে। এরপর পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আমলাতান্ত্রিক কূটবুদ্ধির আশ্রয় নেয়। তারা যুক্তি দেখায়, স্লুইসগেটগুলো অপসারণ করার আগে এর অভিঘাত কী হতে পারে, তা নির্ণয়ের জন্য সমীক্ষা সম্পাদন প্রয়োজন।
এভাবে বড়াল অবমুক্তকরণের গোটা প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। জানানো হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) দ্বারা এরূপ একটি সমীক্ষা সম্পাদন করবে।
৪.প্রায় ১০ বছর পর ২০১৮ সালে আইডব্লিউএম ‘বড়াল অববাহিকার পানিসম্পদ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে পরিবেশ ও সামাজিক অভিঘাতের মূল্যায়নসহ বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’র প্রতিবেদন পেশ করে।
এ সমীক্ষায় জানানো হয়, শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি বড়ালে প্রবাহিত করার প্রয়াস সমীচীন নয়। কারণ, ফারাক্কার প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানিসীমা অত্যন্ত নিচে নেমে যায়।
এ রকম অবস্থায় আইডব্লিউএমের মূল সুপারিশ হলো শুধু পদ্মার বর্ষাকালীন প্রবাহ আরও বেশি হারে বড়ালের দিকে প্রবাহিত করা। তবে এটা করার জন্য আইডব্লিউএম এক অভিনব সুপারিশ করে। সেটা হলো, চারঘাটের বর্তমান স্লুইসগেটের পাশে আরেকটি দুই কপাটের রেগুলেটর নির্মাণ করা।
বড়াল অববাহিকার জনগণের দাবি হলো স্লুইসগেট অপসারণ এবং এই দাবির জন্য তাঁরা প্রায় ২০ বছর ধরে সংগ্রাম করছেন। এর চেয়েও
বড় কথা, উচ্চ আদালত যেখানে বড়ালের প্রবাহকে বাধামুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে আইডব্লিউএমের সুপারিশ হচ্ছে আরও স্লুইসগেট বানাও!
লক্ষণীয়, আইডব্লিউএম জানায়, বড়ালের বিষয়ে সুপারিশে পৌঁছানোর জন্য ১০টি সম্ভাব্য পরিস্থিতি শনাক্ত করা হয় এবং এগুলোর মধ্যে ৮ নম্বর পরিস্থিতিকে সবচেয়ে ভালো মনে করা হয়। কিন্তু এই ১০টি পরিস্থিতির মধ্যে একটিতেও চারঘাট স্লুইসগেট অপসারণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মূল যেটা জানার বিষয় ছিল (চারঘাট স্লুইসগেট অপসারণ করার অভিঘাত কী হবে), সেটাই এই সমীক্ষায় পরীক্ষা করা হয়নি। তা না করে আইডব্লিউএম পাউবোর জন্য ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তুত করে দিয়েছে।
এ অর্থের একটি বড় অংশ নির্ধারিত হয়েছে নদী খননের জন্য। তার মধ্যে রয়েছে ‘মরা’ বড়ালের ১১০ কিলোমিটার খনন। তার সঙ্গে আরও যোগ করা হয়েছে মুসাখান ও নারদ নদের আংশিক খনন। কিন্তু খননের সুফল স্থায়ী হবে না, যদি না বড়াল নদে পদ্মার বর্ষাকালীন প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়।
লক্ষণীয় হলো, নদের মুখ যদি পর্যাপ্তরূপে উন্মুক্ত করা না যায়, তাহলে পদ্মার বর্ষাকালীন প্রবাহ বড়ালে পৌঁছাবে না। তার জন্য প্রয়োজন চারঘাটের স্লুইসগেট অপসারণ করে নদের আদি প্রস্থভিত্তিক (কমপক্ষে ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের) সেতু নির্মাণ।
আরও যা লক্ষ করার মতো বিষয়, আইডব্লিউএম প্রস্তাবিত নতুন রেগুলেটরের পাটাতনের উচ্চতা হবে ৯ দশমিক ২ মিটার। ফলে এটাও বড়ালের প্রবেশদ্বারে পলিপতন ঘটাবে এবং বড়ালের সমস্যার নিরসনে কোনোই অবদান রাখবে না।
৫.আইডব্লিউএম বিভিন্ন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে যদি চারঘাটে কোনো রেগুলেটর না থাকে, তাহলে ২৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হবে। এটা দ্বারা আইডব্লিউএম বাংলাদেশের পানি সমস্যার মূল চরিত্র অনুধাবনে ব্যর্থতার স্বাক্ষর দিয়েছে এবং ওলন্দাজদের দ্বারা আরোপিত পোল্ডার পন্থার অন্ধ অনুকরণ করছে।
এই ‘পোল্ডার পন্থা’ গোটা চলনবিলকে বিপর্যস্ত করেছে। এই পন্থার অনুসরণে চলনবিলের উত্তর ভাগে আত্রাই ও বারনাই নদের অববাহিকায় নির্মিত পোল্ডার এ, বি, সি এবং ডি চলনবিলের স্বাভাবিক চরিত্রকে বিনষ্ট করেছে। দক্ষিণে পাবনা সেচ প্রকল্পের নামে বড়াল অববাহিকার দক্ষিণ ভাগকে ইছামতী নদীসহ অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। পূর্বে ব্রহ্মপুত্র ডান তীর রক্ষা বাঁধের নামে আটটি নদীর সংযোগ রুদ্ধ করার মাধ্যমে চলনবিলের দিকে যমুনার প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে।
পোল্ডার পন্থাভিত্তিক এই সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে চলনবিল আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে (বাংলাদেশের জন্য ওলন্দাজদের পোল্ডার পন্থার অসারতা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন লেখকের সাম্প্রতিক বই বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন: বর্তমান ধারার সংকট ও বিকল্প পথের প্রস্তাব এবং ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ: পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার)।
বর্ষাকালে বিল প্লাবিত হবে—এটাই প্রত্যাশিত এবং প্রয়োজন। জনগণ এই প্লাবনের পক্ষে এবং সে জন্যই তাঁরা চারঘাটের রেগুলেটরের অপসারণ চান। পরিতাপের বিষয়, এই সহজ যুক্তি আইডব্লিউএমের গবেষকেরা বুঝতে সক্ষম হননি!
৬.নদী বা পানিসম্পদের বিষয়ে আসলে যুক্তির চেয়ে বৈষয়িক স্বার্থই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে যে কেউ বলতে পারেন, পাউবো এবং আইডব্লিউএম পরস্পরের বৈষয়িক স্বার্থ রক্ষায় ‘যত্নবান’। পাউবো আইডব্লিউএমকে বিরাট বাজেটের সমীক্ষা প্রণয়নের কাজ দেয়। বিনিময়ে আইডব্লিউএম এমন সব সুপারিশ ‘উপহার’ দেয়, যা পাউবোকে বিরাট বাজেটের প্রকল্প প্রণয়নের সুযোগ করে দেয়। বৈষয়িক স্বার্থের এই বেড়াজালে নদী ও জনগণের স্বার্থ তাই গৌণ হয়ে যায়।
ধারণা করা হয়েছিল, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এ বিষয়ে কিছু পরিবর্তন আসবে। জনগণের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে। গণ-অভ্যুত্থানের ফলে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে বড়াল রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সুহৃদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অন্তর্ভুক্তি বড়াল অববাহিকার জনগণের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু এরপরও বড়ালের অবমুক্তি বিষয়ে গত ৯ মাসে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। তাহলে আমাদের আশা কি শেষ পর্যন্ত দুরাশায় পরিণত হবে?
ড. নজরুল ইসলাম অধ্যাপক, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ল ইসগ ট ন র ম ল দ শ পর ব শ ট স ল ইসগ ট স ল ইসগ ট র ন র ম ণ কর চলনব ল র বর ষ ক ল ন র জন য প রব হ ত ম ক ত কর র প রব হ অবম ক ত জনগণ র নদ র স ত কর র বড় ল র পদ ম র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সমাবেশে লোক ভাড়া করে বেশি মাথা দেখানো কী ফল দেয়
গত কয়েক সপ্তাহে রাজধানীতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সভা হয়ে গেল। এখনো হচ্ছে। বড় বড় রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে জুলাই আন্দোলনের ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন ‘সদ্যোজাত’ দল—সবাই, এই আন্দোলন মাসে সভা করেছে।
সরকারও পিছিয়ে নেই, তারাও জুলাই সনদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা করেছে সংসদ ভবনের সামনে। এই মাসটাতে প্রতিটি সভাই জাতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ—বিভিন্ন অঙ্গীকার ও তথ্যে ভরপুর।
যাঁরা সভাগুলোয় যোগ দিয়েছেন বা যাঁরা অন্যভাবে সভাগুলোর প্রতি নজর রেখেছেন, তাঁদের জন্য এতসব গুরুগম্ভীর তথ্য সম্ভবত মনে রাখা খুব সহজ নয়। তবে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, সবার জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জুলাই সনদ নিয়ে নেতারা যা যা বলেছেন, সেগুলো মোটাদাগে সবাই স্মরণ করবেন।
তবে একটা জিনিস সবাই মনে রাখবেন। সেটা হলো ‘হেড কাউন্ট’। কোন দলের সভায় কত লোক হলো, কাদের সভায় রাস্তা কতটুকু উপচে উঠেছিল এবং যানবাহন কতক্ষণ বন্ধ ছিল—এই জিনিসগুলো আলোচনায় এসেছে।
আমাদের রাজনীতিবিদদের দরকার হেড কাউন্ট বা মাথার হিসাব। কারা সভায় কত মাথা আনতে পারলেন, তা দিয়ে জনপ্রিয়তা মাপা হয়ে থাকে। সমাবেশে যত বেশি হেড কাউন্ট, টিভি সংবাদ ও পত্রিকায় জনসভার ছবিও তত ভালো দেখাবে।
তবে জনসভার হেড কাউন্ট দল বিচারে বা জনপ্রিয়তার দৌড়ে যে খুব প্রভাব ফেলে, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের প্রতিটি জনসভায় উপচে পড়া ‘মাথা’ থাকত। কিন্তু জনতার স্বতঃস্ফূর্ত হেড কাউন্টের কাছে তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি।
জনসভায় হেড কাউন্ট জিনিসটা আমাদের রাজনীতিতে অনেক দিন ধরে চলে আসছে। একাত্তরের আগে দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো বাস পাঠিয়ে ডেমরা, তেজগাঁও থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসত। প্রয়োজন হলে কাঁটাবন বস্তি থেকেও লোক আসত। তাতেই ভরে যেত পল্টন ময়দান। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবের সভা ভরাতে বাস-ট্রেনের প্রয়োজন হয়নি, মানুষ নিজেদের উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছিল।
এখন সময় পাল্টে গেছে। সবকিছু এখন ফাইভ স্টারভিত্তিক। দলের কাজকর্ম সব এখন ফাইভ স্টার ভবনে। রাজনৈতিক দলের ইফতার হবে ফাইভ স্টার হোটেলে। নেতাদের গাড়িবহর হবে ১০০টি গাড়িতে। দলের জনসভায় লোক আনানো হবে রেলগাড়িতে।মাওলানা ভাসানী যখন পল্টনে সভা করতেন, তখন অন্য দলের লোকজনও ওখানে যেত। কারণ, তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা সব সময়ে তুঙ্গে ছিল। তাঁর সভায় ডান দিকে টুপি মাথায় তাঁর ভক্ত ও মুরিদেরা থাকতেন, বাম দিকে লাল ঝান্ডা হাতে বা লাল পট্টি কপালে বেঁধে তাঁর রাজনৈতিক অনুসারীরা বসতেন। দক্ষিণপন্থী-বামপন্থী কোনো হাঙ্গামা হতো না। সবাই মন দিয়ে তাঁর সাম্যের বাণী শুনতেন। মাওলানা ভাসানী হেড কাউন্ট নিয়ে কখনো খুব মাথা ঘামাতেন না, যা ভাবতেন তাই বলতেন, আর যা বলতেন তা-ই করতেন।
এখন সময় পাল্টে গেছে। সবকিছু এখন ফাইভ স্টারভিত্তিক। দলের কাজকর্ম সব এখন ফাইভ স্টার ভবনে। রাজনৈতিক দলের ইফতার হবে ফাইভ স্টার হোটেলে। নেতাদের গাড়িবহর হবে ১০০টি গাড়িতে। দলের জনসভায় লোক আনানো হবে রেলগাড়িতে।
জনসভার জন্যও কোনো সীমারেখা নেই। মাঠ-ময়দান, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল চত্বর সবই বৈধ। রাজনৈতিক দলগুলোর অঢেল টাকা। তার কিছুটা সভা-সমিতিতে হেড কাউন্ট বাড়াতে খরচ হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
১৯ জুলাই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মহাসমাবেশ উপলক্ষে বাইরে থেকে সমর্থকদের ঢাকায় আনার জন্য চার জোড়া বিশেষ ট্রেন ভাড়া করা হয়েছিল। ইসলামী আন্দোলনও গাড়ি ও লঞ্চ ভাড়া করে বাইরে থেকে লোক এনে ইদানীং ঢাকায় সভা করেছে। আমির আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সারা দেশ থেকে কয়েক হাজার গাড়ি রিজার্ভ করা হয়েছে।’
আগে ছাত্ররা সভা করত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। বটতলায় সমাবেশ করাটাই ছিল তাদের গর্ব। একুশে যেত শহীদ মিনারে। এখন ছাত্রদের দলগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকে পাল্লা দিচ্ছে। বাস-ট্রেন ভাড়া করে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ‘ছাত্র’ আনছে তাদের ‘ছাত্রসভায়’ যোগ দিতে।
জনসমর্থন দেখাতে রাজধানীতে ৩ জুলাই ছাত্রদল ও এনসিপির পৃথক সমাবেশ হয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে, জনসভায় হেড কাউন্ট বাড়াতে ছাত্রদল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত ২০ বগির বিশেষ ট্রেন ভাড়া করেছে।
আরও পড়ুনসমাবেশটি আগের মতো ছুটির দিনেও হতে পারতো২৮ মে ২০২৫প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ, ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে সারা দেশ থেকে ছাত্র-জনতা আনতে আট জোড়া ট্রেন ভাড়া করেছে সরকার। এসব ট্রেনে করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ছাত্র-জনতাকে ৫ আগস্ট ঢাকায় নিয়ে আসার কর্মসূচি নেওয়া হয়। আট জোড়া ট্রেনের জন্য প্রায় ৩০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও দেশের সব টিভি চ্যানেলে এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে, তবু বাইরের থেকে লোক আনতে হয়েছে। কারণ, সরকারের প্রয়োজন হেড কাউন্ট।
রাজনীতির আরেকটা হেড কাউন্টের বর্ণনা আশা করি এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কিছু রাজনৈতিক দলের সভায় এই হেড কাউন্ট সবার চোখে পড়বে—স্টেজের ব্যানারে একটা ফ্যামিলি ট্রি-এর ছবি। বিএনপির ব্যানারে হেড কাউন্ট থাকে তিন—জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। আওয়ামী লীগের ব্যানারে হেড কাউন্ট দুই—শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা; তৃতীয়জন তারা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি।
এক শ বছর পরে, এই দল দুটির ব্যানারে ফ্যামিলি ট্রি আরও বড় হবে, হেড কাউন্টও স্বভাবত আরও অনেক বাড়বে!
আজকাল আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সবাই পুরোমাত্রায় ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন। নেতাদের আগের দিনের মতো ঢাকার বাইরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সভা-সমিতি করতে দেখা যায় না। সেটাও একটা কারণ হতে পারে ঢাকার সভার হেড কাউন্ট বাড়ানোর। নেতারা যাবেন কেন জনগণের কাছে, জনগণকেই আসতে হবে তাঁদের কাছে! জনগণ হলো রাজনৈতিক দলের হেড কাউন্ট।যুক্তরাষ্ট্রে খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও তাঁর রিপাবলিকান পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কে, তা বলতে পারবেন কি না, সন্দেহ আছে। কারণ, ওদের ব্যানারে কোনো ফ্যামিলি ট্রি নেই।
একক হেড কাউন্টের বিষয়টাও এখন বলা যেতে পারে। শেখ হাসিনার সময় টিভি স্ক্রিনের ওপরের বাঁ দিকের কোনায় শেখ মুজিবের একটা মাথার ছবি প্রায়ই দেখা যেত বছরের প্রায় দশটা মাস। স্বাধীনতা দিবস, ৭ মার্চ, মৃত্যুদিবস, জন্মদিবস, বিজয় দিবস, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগমন দিবস ইত্যাদি সব দিবসে মাসব্যাপী অনুষ্ঠান থাকত। এই একক হেড কাউন্টটা শেখ মুজিবের মর্যাদা বাড়াতে কোনো সাহায্য করেনি।
এখন ইন্টারনেট-যুগে আমাদের শহরে গ্রামে প্রায় প্রতিটি জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ আছে। আমাদের জাতীয় দলের একজন বড় নেতা লন্ডনে বসে প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশে তাঁর সমর্থক ও দলীয় নেতাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি কথা বলছেন। ঢাকার জনসভায়ও তিনি ভার্চ্যুয়ালি যোগ দিয়েছেন।
আরও পড়ুনছাত্রদের নতুন দল কি নতুন রাজনীতি হাজির করতে পারবে২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সুতরাং সশরীর হাজির হয়ে দলের হেড কাউন্ট বাড়াতে হবে, এই যুগে এ ধারণাটা অচল। হেড কাউন্ট বাড়াতে সভাস্থল থেকে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। যার যত সংযোগ এবং প্রতি সংযোগের স্ক্রিনে যত লোক দেখছেন, তার তত হেড কাউন্ট।
রাজনৈতিক দলগুলো ভাড়া করা গাড়িতে বাইরের থেকে লোকজন নিয়ে এসে আরও বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন। যদি কোনো অর্বাচীন প্রশ্ন করে বসেন—বাইরের থাকে আনা লোকগুলোও কি ভাড়াটে? আড়াই কোটি লোকের শহরে হেড কাউন্ট দেখাতে, তাদের শহরের বাইরের থেকে লোক আনতে হবে কেন?
আজকাল আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সবাই পুরোমাত্রায় ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন। নেতাদের আগের দিনের মতো ঢাকার বাইরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সভা-সমিতি করতে দেখা যায় না। সেটাও একটা কারণ হতে পারে ঢাকার সভার হেড কাউন্ট বাড়ানোর। নেতারা যাবেন কেন জনগণের কাছে, জনগণকেই আসতে হবে তাঁদের কাছে! জনগণ হলো রাজনৈতিক দলের হেড কাউন্ট।
সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব