দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এবার চীনের বাজারে প্রবেশ করল দেশীয় আম। বুধবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সাতক্ষীরা ও যশোর অঞ্চলের আম নিয়ে ১০ টনের প্রথম চালানটি চীনে যায়। দীর্ঘ প্রস্তুতি ও নানা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণের পর কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাস্তবায়িত হয় এই কাঙ্খিত রপ্তানি। এ উপলক্ষে বিমানবন্দরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশি আমের চীনে রপ্তানি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও গভীর করবে। এটি শুধু একটি আম রপ্তানির ঘটনা নয়, বরং দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। আশা করি, চীনের ভোক্তারা বাংলাদেশের আমের স্বাদ উপভোগ করবেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের পেয়ারা ও কাঁঠাল রপ্তানির সম্ভাবনাও ইতোমধ্যে বিবেচনায় নিয়েছে চীন। খুব শিগগির আরও কিছু কৃষিপণ্য সে দেশের সুপার মার্কেটগুলোতে স্থান পাবে। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, কৃষি সচিব ড.
সকালে রাজধানীর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে আম রপ্তানি কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, রপ্তানির অন্যতম প্রধান বাধা উচ্চ বিমান ভাড়া। কৃষিপণ্য রপ্তানি টেকসই করতে এ ব্যয় কমানো জরুরি। এজন্য বিমান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে ডিও লেটার পাঠানো হবে। তিনি কৃষি সচিবকে রপ্তানিকারকদের সঙ্গে নিয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ে আলোচনায় বসার পরামর্শ দেন।
কৃষি সচিব বলেন, আমাদের আম এখন বিশ্বের ৩৮টি দেশে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও বিস্তার ঘটানো হবে। শুধু প্রবাসী নয়, বিদেশি ক্রেতাদের কাছেও বাংলাদেশি আম পৌঁছানোর মতো সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে।
রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দিতে ২০২২ সালের জুলাই থেকে পাঁচ বছরমেয়াদি একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান জানান, কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, গাছের পরিচর্যা ও প্যাকেজিং প্রক্রিয়ায় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যার ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে আম উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে সপ্তম হলেও রপ্তানির তালিকায় এতদিন পিছিয়ে ছিল দেশটি। এবারের সফল রপ্তানির নেপথ্যে ছিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পিত উদ্যোগ, গুণগত মান রক্ষা, আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা বোঝা এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কূটনীতির সমন্বিত প্রয়াস।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, এ সফলতা শুধু আম নয়, অন্যান্য কৃষিপণ্যের জন্যও আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন দরজা খুলে দেবে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়লে কৃষকের আয় যেমন বাড়বে, তেমনি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারও সমৃদ্ধ হবে।
৬৭ কোটি টাকার আম যাবে বিদেশে
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীর চার জেলার চাষিরা চলতি মৌসুমে ৬ হাজার ৮৯২ কোটি টাকার আম বিক্রি করবেন। এর মধ্যে বিদেশে রপ্তানি হবে ৬৭ কোটি টাকা মূল্যের ৬ হাজার ৭২০ টন আম। ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এসব আম রপ্তানি হবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
কানে স্বীকৃতি পাওয়া মানে শুধু সম্মান নয়, একটা দিকনির্দেশনাও: রাজীব
আদনান আল রাজীব। নির্মাতা। ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শাখায় বিচারকদের রায়ে ‘স্পেশাল মেনশন’ পেয়েছে তাঁর নির্মিত সিনেমা ‘আলী’। প্রথমবারের মতো কান উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে স্বীকৃতি পেল সিনেমাটি। কানে আলীর সাফল্য ও আগামী ভাবনা নিয়েই কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘আলী’ পেল স্পেশাল মেনশন। কেমন লাগছে?
এটা আমাদের জন্য অবশ্যই বিশেষ। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্যও। আপনারা জানেন, প্রথমবারের মতো আমাদের জন্য এটা অনেক বড় একটা অর্জন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটা অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় মানুষ ভালোভাবে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ খুঁজছে। এ পুরস্কারটি জিতে আমরা কিছুটা হলেও সেটাই দিতে পেরেছি। এটা দেশের মানুষের মাঝে একটা আশার সঞ্চার যেমন ঘটাবে, তেমনি বাংলাদেশ নিয়ে একটা ইতিবাচক ধারণাও তৈরি করবে। অন্যদিকে কান উৎসবকে সিনেমার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আসর বলা হয়। সেখানে নিজের নামের পাশাপাশি দেশের নাম এক সঙ্গে উচ্চারিত হতে দেখা স্বপ্নের চেয়েও বড় কিছু। যখন শুনলাম আমাদের চলচ্চিত্রটিকে ‘স্পেশাল মেনশন’ দেওয়া হয়েছে, তখন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা। পুরোটাই স্বপ্নের মতো। মনে হচ্ছিল, ডুবে যাচ্ছি, আবার ভেসে উঠছি। বোঝানো যাবে না, হার্টবিট (হৃৎস্পন্দন) বেড়ে গিয়েছিল। তারপর যখন পুরো হল করতালিতে ফেটে পড়ল– সেই মুহূর্তটা সারাজীবন মনে রাখার মতো একটি বিষয়।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এমন একটি স্বীকৃতি পেল, আপনার অভিমত কী’
এমন কিছু অর্জন করব, এটা কখনোই ভাবিনি। আমি শুধু শৈল্পিক মাধ্যমে গল্পটি বলতে চেয়েছিলাম, যেটা আমি সব সময়ই চেষ্টা করি। কী বলব আসলে বুঝতে পারছি না। আমি এটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। শুধু এটাই বলব, এটা আমার জীবনের জন্য অনেক বড় একটা অর্জন। এমনকি দেশের জন্যও।
বিয়ের পর এমন সাফল্য…
[হাসি] আমার তো মনে হচ্ছে, বউ [মেহজাবীন চৌধুরী] আমার জন্য লাকি চার্ম। বিয়ের পরই ভাগ্য খুলে গেছে। প্রথম ভাগ্যটাই খুলল কান উৎসবে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এবারই প্রথম কান উৎসবের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বিভাগের মূল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের কোনো ছবি জায়গা করে নিয়েছে। এরপর যখন সিনেমাটি ‘স্পেশাল মেনশন’ পেল, সেটিও ভ্যাগ্য। কারণ এখানে আরও অনেক দেশের সিনেমা দেখানো হয় আগামী দিনে ইনশাআল্লাহ আরও বড় কিছুই হবে বলে মনে হচ্ছে।
সিনেমাটি কাদের উৎসর্গ করতে চান…
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন। যারা অনেক কিছু বলতে চান, কিন্তু বলতে পারেন না নানা চাপের কথা মাথায় রেখে। আমি সেই সব মানুষদের সিনেমাটি উৎসর্গ করেছি, যারা নানা চাপে কথা বলতে পারেন না। বলা যেতে পারে আমার এই সিনেমাটি মূলত কণ্ঠস্বর জাগ্রত করা নিয়েই। যার মধ্য দিয়ে ভাঙা হয় নানা বাধা-বিপত্তি, মানুষের আত্মাকে কথা বলতে উৎসাহ জোগায়। প্রশ্ন করতে শেখায়, ‘তুমি কে?’ তাদের কথাই উঠে এসেছে আমার গল্পে।
ফিলিপাইনের সহ-প্রযোজনা ছাড়া ‘আলী’ নির্মাণ করা যেত না?
ফিলিপাইনের যারা আমার সিনেমাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা সবাই আমার বন্ধু। আপনারা জানেন, বাংলাদেশে পোস্টের কাজের ভালো সুযোগ নেই, যে কারণে একসঙ্গে আমরা কাজটি করেছি। তাদের ছাড়া এটা অসম্ভব ছিল।
‘আলী’ সিনেমার পেছনের গল্প কী? কী অনুপ্রেরণা ছিল?
‘আলী’ একটি ছোট ছেলের গল্প, কিন্তু তার ভেতরে আছে অনেক বড় একটা বাস্তবতা– মানবিকতা, হারিয়ে ফেলা এবং ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। গল্পটা একরকম আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেও এসেছে। আমি বিশ্বাস করি, যত ব্যক্তিগত একটি গল্প হয়, সেটি ততই সর্বজনীন হয়ে ওঠে। দর্শকরা বিভিন্নভাবে সংযোগ তৈরি করেন। এটাই মনে হয় ‘আলী’র শক্তি।
আপনি প্রথমবার কানে অংশ নিয়েই স্বীকৃতি পেলেন। এ অর্জন কি আপনাকে ভবিষ্যতের জন্য সাহস জোগাবে?
অবশ্যই। কানে স্বীকৃতি পাওয়া মানে শুধু সম্মান নয়, একটা দিকনির্দেশনাও। একটা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে যাওয়া মানে হলো বিশ্বব্যাপী দর্শকের কাছে পৌঁছানো। এখন মনে হচ্ছে– হ্যাঁ, আরও সাহস নিয়ে, আরও আন্তরিকভাবে গল্প বলা উচিত।
‘আলী’র নির্মাণে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল?
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এক ঝাঁক নতুন শিল্পী নিয়ে কাজ করা। কিন্তু সেখানেই সবচেয়ে বড় আনন্দটাও ছিল। তারা এতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পারফর্ম করেছে যে, ক্যামেরার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে চরিত্রগুলো। এ ছাড়া, বাজেট সীমাবদ্ধতা ছিল, লোকেশন ব্যবস্থাপনা কঠিন ছিল, কিন্তু আমাদের টিমের আন্তরিকতায় সবকিছু সহজ হয়ে গেছে।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আপনার ভাবনা কী?
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শুধু ‘প্রস্তুতির প্ল্যাটফর্ম’ না– এটাই নিজে এক শক্তিশালী মাধ্যম। অল্প সময়ে একটা গভীর বার্তা দেওয়া যায়। আমাদের দেশের তরুণ নির্মাতাদের এই মাধ্যমে আরও বেশি এগিয়ে আসা উচিত।
ভবিষ্যতে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা আছে?
অবশ্যই আছে। ‘আলী’র সাফল্য আমাকে আরও সাহস দিয়েছে বড় পরিসরে কাজ করার জন্য। স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করছি। তবে আমি তাড়াহুড়ো করতে চাই না। ভালোভাবে প্রস্তুত হয়ে, সঠিক গল্পটা নিয়ে বড় পর্দায় আসতে চাই।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কোথায় দাঁড়িয়ে?
আমার মনে হয়, আমরা এখন একটা রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের নির্মাতারা সাহসী, বৈচিত্র্যময় এবং আন্তরিক। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এখন শুধু দরকার ধারাবাহিকভাবে ভালো কাজ করে যাওয়ার। কানে ‘আলী’র মতো সিনেমা সম্মান পেলে সেটা অন্যদের জন্য পথ দেখাবে।