বাজেটের বরাদ্দের কত টাকা অপচয় বা লুটপাট হলো জানব কখন
Published: 30th, May 2025 GMT
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বাজেটের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। ১৫ বছর ধরে একদিকে বাজেটে শতাংশের হিসাবে বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ধারাবাহিকভাবে খরচ কমিয়ে এনেছিল।
অন্যদিকে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার জন্য গোষ্ঠীগত স্বার্থে আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী, মাফিয়াসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে অপ্রয়োজনীয় ও অস্বাভাবিক খরচ করেছিল জনপ্রশাসন খাতে, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাত, সামরিক খাত, বিদ্যুৎ খাতসহ বেশ কিছু খাতে। একই সঙ্গে নানান অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, পরিবেশবিধ্বংসী এবং জননিরপত্তাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া প্রকল্প হাতে নিয়ে লুটপাটের স্বর্গরাজ্য তৈরি করা হয়েছিল।
অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাট হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে বাজেটের অর্থায়নের সময়, কর আদায়ের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবেই ১৫ বছর ধরে রাঘববোয়ালদের ছাড় দিয়ে আসা হয়েছিল। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির এক হিসাব বলছে যে শুধু ২০২৩ সালেই কর ফাঁকির কারণে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যার অর্ধেকই ছিল ফাঁকি দেওয়া করপোরেট কর।
খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ রয়েছে যে তারা আওয়ামী লীগ আমলের এসব প্রবণতা থেকে বের হয়ে এসে এইবার বাজেট দেবে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নাজুক বাস্তবতায় সেটা তারা কতটুকু করতে পারে কিংবা তারা সেটা আদৌ করতে চায় কি না, সেটা বাজেট দিলেই বোঝা যাবে। কোনো সন্দেহ নেই ওপরে বর্ণিত প্রবণতাগুলো থেকে বের হয়ে বাজেটের প্রয়োজনীয় নানাবিধ সংস্কার করা এখন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই এই মুহূর্তে বাজেটের জন্য সবচেয়ে জরুরি সংস্কার নয়।
আমাদের এখানে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও সেই বরাদ্দ আসলেই কোনো কাজে লাগবে কি না, সেটা বোঝার কোনো উপায় বাজেটে রাখা হয়নি। ফলে বাজেটের ক্ষেত্রে জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর চেয়েও এই মুহূর্তে আসলে যে সংস্কারটি সবার আগে করা দরকার, তা হলো জনগণের কাছে বাজেটের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এর জন্য দরকার সংক্ষিপ্ত মোটাদাগের হিসাব দেওয়ার বদলে বাজেটের প্রতিটি পরিচালন খরচের আদ্যোপান্ত বিস্তারিত হিসাব এবং প্রতিটি প্রকল্পের বিস্তারিত প্রজেক্ট ডকুমেন্ট উন্মুক্ত করা।
আমাদের এখানে বাজেটের হিসাবগুলো আসলে যেভাবে দেওয়া হয়, তাতে পরিচালন ব্যয় এবং উন্নয়ন ব্যয় আলাদা করে দিয়ে, পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি খাতে কতগুলো মোটাদাগের ক্যাটাগরিতে মোট কত খরচ হবে, শুধু সেই হিসাব দেওয়া হয়, আর উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে এডিপিতে কেবল প্রকল্পগুলোর নাম দিয়ে কোন প্রকল্পে কত বরাদ্দ, তার হিসাব দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গেলে প্রকল্প ধরে ধরে আরও কয়েকটি ক্যাটাগরিতে মোটাদাগে কিছু হিসাব দেওয়া হয়। তাতেও প্রকল্পের প্রকৃত চেহারা ধরা যায় না। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে দপ্তর ধরে আপাতদৃষ্টে ‘বিস্তারিত’ হিসাব দিলেও আসলে সেই ‘বিস্তারিত’ হিসাব দেখেও প্রকৃত চিত্র বোঝার কোনো উপায় নেই।
অতি ক্ষুদ্র দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে সচিবালয়ে গত দুই অর্থবছরে আসবাব কেনা বাবদ প্রায় এক কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে, প্রশিক্ষণ বাবদ ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এখন জনগণের তো জানা দরকার যে কেন প্রতিবছর সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে আসবাব কিনতে হবে? কিংবা কত দামে কী কী আসবাব কেনা হবে। কিংবা প্রশিক্ষণের নামে আসলে কী হচ্ছে? কতজনকে কী প্রশিক্ষণ দিতে সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় এই ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা দুই বছরে খরচ করল?
সুতরাং বাজেটের বরাদ্দের মধ্যে কতটুকু আসলে অপচয়, কতটুকু আসলে অপ্রয়োজনীয় কিংবা কতটুকু আসলে লুটপাটে যাবে, সেটা বোঝার কোনো সুযোগ জনগণের জন্য রাখা হয়নি। অথচ বাজেটে যে টাকাটা ব্যয় করা হয়, সেটা পুরোটাই জনগণের টাকা। এই টাকা দিয়ে সরকার কী কী করছে, তার প্রতিটা পয়সার হিসাব পর্যন্ত জানার অধিকার জনগণের আছে। কিন্তু সেই অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা হয়েছে দশকের পর দশক ধরে।
কোনো কোম্পানি যখন তার কোনো কর্মচারীকে কোনো কিছু কেনার জন্য টাকা দেয়, তখন সেটি কী করে? প্রদত্ত টাকার প্রতিটা পয়সার হিসাব নেয় না? সেই টাকা দিয়ে কত দরে কী কেনা হলো, সেটা দেখে না? টাকাটা যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিকভাবে ব্যয় করা হয়েছে, সেই হিসাব দেখে না? চাইলেই কি কোম্পানির অধীন কোনো কর্মচারীর পক্ষে বিস্তারিত হিসাব দেওয়ার বদলে মোটাদাগে হিসাব দিয়ে পার পাওয়া সম্ভব? কোম্পানি যদি তার দেওয়া অর্থের প্রতিটি পাই পয়সার হিসাব তার কর্মচারীর কাছ থেকে বুঝে নিতে পারে, তাহলে জনগণ কেন সরকারের কাছ থেকে সেটি বুঝে নিতে পারবে না? সরকারের ‘নিয়োগদাতা’ তো জনগণ।
অন্যদিকে আজ পর্যন্ত বাজেটের এমন কোনো ডেটাবেজ উন্মুক্ত করা হয়নি, যেখানে ন্যূনতম একটা এক্সেল শিটে হলেও এযাবৎকালের সব বাজেটের ডেটা (প্রকৃত অর্থ এবং শতাংশের হিসাবে) থাকবে। ফলে চট করে জনগণ যে বাজেটের সর্বশেষ বরাদ্দের সঙ্গে আগের বরাদ্দের হিসাবগুলোকে তুলনা করবে, তার কোনো সহজ সুযোগ নেই। শুধু তা–ই নয়, বর্তমানে পরিকল্পনা বিভাগের ওয়েবসাইটে কেবল সর্বশেষ বছরের এডিপি দেওয়া। ফলে সংশোধিত প্রকল্পে কতটা ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ল, সেটা জানারও কোনো উপায় জনগণের জন্য নেই। অথচ জনগণের কাছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য এগুলো উন্মুক্ত রাখাও অতীব প্রয়োজন ছিল।
এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে এই যে অস্বচ্ছতা এবং জনগণকে বিস্তারিত হিসাব ও বিবরণ জানতে না দেওয়া, এর কারণটি পুরোপুরি রাজনৈতিক হলেও এটি কেবল আওয়ামী আমলেরই বৈশিষ্ট্য ছিল না। আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই বাজেটের বরাদ্দের বিস্তারিত আদ্যোপান্ত হিসাব জনগণের সামনে কখনোই প্রকাশ করেনি। তার কারণ, তা করলে দুর্নীতি করার, লুটপাট করার কিংবা গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষা করার সুযোগ অনেক কমে আসবে।
মানুষকে যত বেশি তথ্য জানতে দেওয়া হবে, মানুষ তত বেশি করে জবাবদিহি চাইবে, মনিটরিং করবে। সেটা কোনো স্বৈরশাসক কিংবা দুর্নীতিবাজ শাসকেরই পছন্দ হওয়ার কথা না। কিন্তু এই সরকার তো দাবি করে যে তারা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। তাহলে যেটি স্বৈরশাসক বা দুর্নীতিবাজ শাসকদের পছন্দ হওয়ার কথা না, সেটি করতে তো এই সরকারের কোনো সমস্যা হওয়া উচিত নয়। সুতরাং তারা কি এইবার বাজেটের প্রতিটি প্রকল্পের বিস্তারিত ডকুমেন্ট উন্মুক্ত করবে? তারা কি দেবে পরিচালন ব্যয়ের সত্যিকারের বিস্তারিত হিসাব? দিলে এই দৃষ্টান্ত ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারের জন্যও একটা চাপ হিসেবে কাজ করবে। এটি করতে হলে বিন্দুমাত্র অর্থনৈতিক চাপ ইন্টেরিমকে মোকাবিলা করতে হবে না, দরকার শুধু সদিচ্ছা।
মাহতাব উদ্দীন আহমেদ লেখক ও গবেষক, সর্বজনকথা ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র বর দ দ র র জন ত ক উন ম ক ত সরক র র প রকল প জনগণ র র জন য ল টপ ট দরক র কতট ক
এছাড়াও পড়ুন:
কক্সবাজারে ৩৫ পুলিশ সদস্যের পোশাকে থাকবে ‘বডি ওর্ন ক্যামেরা’
কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩৫ জন পুলিশ সদস্যের পোশাকের সঙ্গে ‘বডি ওর্ন ক্যামেরা’ সংযুক্ত করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির এই ক্যামেরার মাধ্যমে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের অডিও ও ভিডিও কার্যক্রম রেকর্ড করা যাবে।
আজ বুধবার দুপুরে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে বিভিন্ন থানা ও ইউনিটের ৩৫ জন পুলিশ সদস্যের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব ক্যামেরা হস্তান্তর করা হয়। বডি ওর্ন ক্যামেরা বিতরণ করেন জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফউদ্দিন শাহীন।
এ সময় পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমরা জনগণের পুলিশ হতে চাই। বডি ওর্ন ক্যামেরা ব্যবহারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, জনগণের আস্থা অর্জন এবং পুলিশের পেশাগত আচরণ পর্যবেক্ষণ সহজ হবে। পর্যটননির্ভর শহর কক্সবাজারে প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তাব্যবস্থার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।’
জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রাথমিকভাবে থানা ও ফাঁড়ির টহল দল, ট্রাফিক ইউনিট, ডিবি এবং বিশেষ অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যদের মধ্যে এই ক্যামেরা বিতরণ করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ইউনিটেও এই প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা হবে।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বডি ওর্ন ক্যামেরার রেকর্ড সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় সার্ভার ও সফটওয়্যার সিস্টেম স্থাপন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ক্যামেরা ব্যবহারে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এই উদ্যোগ পুলিশের পেশাদারত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি মিথ্যা অভিযোগ থেকে সুরক্ষা, তদন্তে স্বচ্ছতা এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে।