গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বাজেটের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। ১৫ বছর ধরে একদিকে বাজেটে শতাংশের হিসাবে বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ধারাবাহিকভাবে খরচ কমিয়ে এনেছিল।

অন্যদিকে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার জন্য গোষ্ঠীগত স্বার্থে আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী, মাফিয়াসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে অপ্রয়োজনীয় ও অস্বাভাবিক খরচ করেছিল জনপ্রশাসন খাতে, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাত, সামরিক খাত, বিদ্যুৎ খাতসহ বেশ কিছু খাতে। একই সঙ্গে নানান অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, পরিবেশবিধ্বংসী এবং জননিরপত্তাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া প্রকল্প হাতে নিয়ে লুটপাটের স্বর্গরাজ্য তৈরি করা হয়েছিল।

অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাট হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে বাজেটের অর্থায়নের সময়, কর আদায়ের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবেই ১৫ বছর ধরে রাঘববোয়ালদের ছাড় দিয়ে আসা হয়েছিল। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির এক হিসাব বলছে যে শুধু ২০২৩ সালেই কর ফাঁকির কারণে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যার অর্ধেকই ছিল ফাঁকি দেওয়া করপোরেট কর।

খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ রয়েছে যে তারা আওয়ামী লীগ আমলের এসব প্রবণতা থেকে বের হয়ে এসে এইবার বাজেট দেবে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নাজুক বাস্তবতায় সেটা তারা কতটুকু করতে পারে কিংবা তারা সেটা আদৌ করতে চায় কি না, সেটা বাজেট দিলেই বোঝা যাবে। কোনো সন্দেহ নেই ওপরে বর্ণিত প্রবণতাগুলো থেকে বের হয়ে বাজেটের প্রয়োজনীয় নানাবিধ সংস্কার করা এখন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই এই মুহূর্তে বাজেটের জন্য সবচেয়ে জরুরি সংস্কার নয়।

আমাদের এখানে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও সেই বরাদ্দ আসলেই কোনো কাজে লাগবে কি না, সেটা বোঝার কোনো উপায় বাজেটে রাখা হয়নি। ফলে বাজেটের ক্ষেত্রে জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর চেয়েও এই মুহূর্তে আসলে যে সংস্কারটি সবার আগে করা দরকার, তা হলো জনগণের কাছে বাজেটের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এর জন্য দরকার সংক্ষিপ্ত মোটাদাগের হিসাব দেওয়ার বদলে বাজেটের প্রতিটি পরিচালন খরচের আদ্যোপান্ত বিস্তারিত হিসাব এবং প্রতিটি প্রকল্পের বিস্তারিত প্রজেক্ট ডকুমেন্ট উন্মুক্ত করা।

আমাদের এখানে বাজেটের হিসাবগুলো আসলে যেভাবে দেওয়া হয়, তাতে পরিচালন ব্যয় এবং উন্নয়ন ব্যয় আলাদা করে দিয়ে, পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি খাতে কতগুলো মোটাদাগের ক্যাটাগরিতে মোট কত খরচ হবে, শুধু সেই হিসাব দেওয়া হয়, আর উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে এডিপিতে কেবল প্রকল্পগুলোর নাম দিয়ে কোন প্রকল্পে কত বরাদ্দ, তার হিসাব দেওয়া হয়।

মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গেলে প্রকল্প ধরে ধরে আরও কয়েকটি ক্যাটাগরিতে মোটাদাগে কিছু হিসাব দেওয়া হয়। তাতেও প্রকল্পের প্রকৃত চেহারা ধরা যায় না। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে দপ্তর ধরে আপাতদৃষ্টে ‘বিস্তারিত’ হিসাব দিলেও আসলে সেই ‘বিস্তারিত’ হিসাব দেখেও প্রকৃত চিত্র বোঝার কোনো উপায় নেই।

অতি ক্ষুদ্র দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে সচিবালয়ে গত দুই অর্থবছরে আসবাব কেনা বাবদ প্রায় এক কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে, প্রশিক্ষণ বাবদ ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এখন জনগণের তো জানা দরকার যে কেন প্রতিবছর সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে আসবাব কিনতে হবে? কিংবা কত দামে কী কী আসবাব কেনা হবে। কিংবা প্রশিক্ষণের নামে আসলে কী হচ্ছে? কতজনকে কী প্রশিক্ষণ দিতে সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় এই ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা দুই বছরে খরচ করল?

সুতরাং বাজেটের বরাদ্দের মধ্যে কতটুকু আসলে অপচয়, কতটুকু আসলে অপ্রয়োজনীয় কিংবা কতটুকু আসলে লুটপাটে যাবে, সেটা বোঝার কোনো সুযোগ জনগণের জন্য রাখা হয়নি। অথচ বাজেটে যে টাকাটা ব্যয় করা হয়, সেটা পুরোটাই জনগণের টাকা। এই টাকা দিয়ে সরকার কী কী করছে, তার প্রতিটা পয়সার হিসাব পর্যন্ত জানার অধিকার জনগণের আছে। কিন্তু সেই অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা হয়েছে দশকের পর দশক ধরে।

কোনো কোম্পানি যখন তার কোনো কর্মচারীকে কোনো কিছু কেনার জন্য টাকা দেয়, তখন সেটি কী করে? প্রদত্ত টাকার প্রতিটা পয়সার হিসাব নেয় না? সেই টাকা দিয়ে কত দরে কী কেনা হলো, সেটা দেখে না? টাকাটা যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিকভাবে ব্যয় করা হয়েছে, সেই হিসাব দেখে না? চাইলেই কি কোম্পানির অধীন কোনো কর্মচারীর পক্ষে বিস্তারিত হিসাব দেওয়ার বদলে মোটাদাগে হিসাব দিয়ে পার পাওয়া সম্ভব? কোম্পানি যদি তার দেওয়া অর্থের প্রতিটি পাই পয়সার হিসাব তার কর্মচারীর কাছ থেকে বুঝে নিতে পারে, তাহলে জনগণ কেন সরকারের কাছ থেকে সেটি বুঝে নিতে পারবে না? সরকারের ‘নিয়োগদাতা’ তো জনগণ।

অন্যদিকে আজ পর্যন্ত বাজেটের এমন কোনো ডেটাবেজ উন্মুক্ত করা হয়নি, যেখানে ন্যূনতম একটা এক্সেল শিটে হলেও এযাবৎকালের সব বাজেটের ডেটা (প্রকৃত অর্থ এবং শতাংশের হিসাবে) থাকবে। ফলে চট করে জনগণ যে বাজেটের সর্বশেষ বরাদ্দের সঙ্গে আগের বরাদ্দের হিসাবগুলোকে তুলনা করবে, তার কোনো সহজ সুযোগ নেই। শুধু তা–ই নয়, বর্তমানে পরিকল্পনা বিভাগের ওয়েবসাইটে কেবল সর্বশেষ বছরের এডিপি দেওয়া। ফলে সংশোধিত প্রকল্পে কতটা ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ল, সেটা জানারও কোনো উপায় জনগণের জন্য নেই। অথচ জনগণের কাছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য এগুলো উন্মুক্ত রাখাও অতীব প্রয়োজন ছিল।

এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে এই যে অস্বচ্ছতা এবং জনগণকে বিস্তারিত হিসাব ও বিবরণ জানতে না দেওয়া, এর কারণটি পুরোপুরি রাজনৈতিক হলেও এটি কেবল আওয়ামী আমলেরই বৈশিষ্ট্য ছিল না। আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই বাজেটের বরাদ্দের বিস্তারিত আদ্যোপান্ত হিসাব জনগণের সামনে কখনোই প্রকাশ করেনি। তার কারণ, তা করলে দুর্নীতি করার, লুটপাট করার কিংবা গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষা করার সুযোগ অনেক কমে আসবে।

মানুষকে যত বেশি তথ্য জানতে দেওয়া হবে, মানুষ তত বেশি করে জবাবদিহি চাইবে, মনিটরিং করবে। সেটা কোনো স্বৈরশাসক কিংবা দুর্নীতিবাজ শাসকেরই পছন্দ হওয়ার কথা না। কিন্তু এই সরকার তো দাবি করে যে তারা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। তাহলে যেটি স্বৈরশাসক বা দুর্নীতিবাজ শাসকদের পছন্দ হওয়ার কথা না, সেটি করতে তো এই সরকারের কোনো সমস্যা হওয়া উচিত নয়। সুতরাং তারা কি এইবার বাজেটের প্রতিটি প্রকল্পের বিস্তারিত ডকুমেন্ট উন্মুক্ত করবে? তারা কি দেবে পরিচালন ব্যয়ের সত্যিকারের বিস্তারিত হিসাব? দিলে এই দৃষ্টান্ত ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারের জন্যও একটা চাপ হিসেবে কাজ করবে। এটি করতে হলে বিন্দুমাত্র অর্থনৈতিক চাপ ইন্টেরিমকে মোকাবিলা করতে হবে না, দরকার শুধু সদিচ্ছা।

মাহতাব উদ্দীন আহমেদ লেখক ও গবেষক, সর্বজনকথা ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র বর দ দ র র জন ত ক উন ম ক ত সরক র র প রকল প জনগণ র র জন য ল টপ ট দরক র কতট ক

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যু সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব: সালাহউদ্দ

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুর সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব।’’

তিনি মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান এলে যেকোনো অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া ঠেকানো যাবে।

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘আগামী নির্বাচনকে যদি অনিশ্চিত করা হয় বা বিলম্বিত করা হয়, তাহলে তার সুযোগ নেবে ফ্যাসিবাদী বা অসাংবিধানিক শক্তি। এর পরিণতি জাতি অতীতে বহুবার ভোগ করেছে। আমরা আবার সে পরিস্থিতি চাই না।’’

অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে পৃথক এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতেই সাংবিধানিকভাবে এই সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সে দেওয়া সেই মতামত এখনো বহাল আছে। এর বিপরীতে সুপ্রিম কোর্ট কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তাই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা আসলে রাজনৈতিক বক্তব্য, এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।’’

সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘‘যেকোনো সাংবিধানিক আদেশ জারি হলে তা আগামীকাল বা পরশু চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আমরা এমন খারাপ নজির জাতির সামনে আনতে চাই না। তাই সমাধানের বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। সবাইকে বিবেচনায় নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।’’

পিআর পদ্ধতি প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের অধিকার আছে। তবে পিআর পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, শেষ পর্যন্ত জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে।’’

তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘‘পিআর পদ্ধতিতে ঝুলন্ত পার্লামেন্টের ঝুঁকি থেকে যায়। তাতে রাষ্ট্র ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ সম্ভব হয় না। আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যেতে পারি না।’’

সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘‘জনগণই হলো সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। এই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বারবার গণতন্ত্রকে সংকট থেকে উদ্ধার করেছে।’’

আগামী সংসদে কিছু মৌলিক বিষয়ে সংশোধনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন তিনি বলেন, ‘‘আমরা কিছু বিষয়ে ইতোমধ্যে একমত হয়েছি। তবে, ঐকমত্য কমিশনের সনদের ভেতরে যেসব পরিবর্তন হবে, সেগুলোতে অবশ্যই গণভোট নিতে হবে।’’

ঢাকা/আসাদ/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যু সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব: সালাহউদ্দ
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
  • রোহিঙ্গা সমস্যায় রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে
  • হুংকার দিয়ে জাতীয় নির্বাচন ঠেকান যাবে না: জাহিদ হোসেন
  • মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন 
  • জামায়াত কীভাবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
  • জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে
  • ফরিদপুরে সীমানা নিয়ে ডিসির চিঠি, এলাকাবাসীর ৫ দাবি
  • জামায়া‌তের তিন‌ দি‌নের কর্মসূচি ঘোষণা