সিলেটে পানি বাড়ায় সাদাপাথর বন্ধ ঘোষণা, ঝুঁকিপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র এড়িয়ে চলার পরামর্শ
Published: 2nd, June 2025 GMT
সীমান্তের ওপারে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে সিলেটে কয়েক দিন ধরেই নদ-নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। ওই পরিস্থিতিতে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ সময় পানিকেন্দ্রিক ঝুঁকিপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্রগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া স্থিতিশীল হলেই পর্যটনকেন্দ্রটি খুলে দেওয়া হবে।
স্থানীয় প্রশাসন ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেহেতু নদীকেন্দ্রিক পর্যটনকেন্দ্রগুলো সিলেটে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। তাই বর্ষা মৌসুমই মূলত সিলেট বেড়ানোর উপযুক্ত সময়। তবে এবার মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর কিছু পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে, আবার অন্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। এমন পরিস্থিতিতে পানিকেন্দ্রিক প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় মাঝিরা জানিয়েছেন, গোয়াইনঘাট উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র জাফলং জিরো পয়েন্টে কখনো স্রোতের তীব্রতা বাড়ছে, আবার কখনো কমছে। তবে ভারত থেকে প্রবল বেগে পানি নেমে আসায় পানির গভীরতা বেড়েছে। এতে জাফলংয়ে ভ্রমণকেন্দ্রিক নৌ চলাচল প্রায় সময়ই মাঝিদের বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
গোয়াইনঘাটের ইউএনও রতন কুমার অধিকারী জানান, নদ-নদীতে প্রচুর পানি থাকলেও এখন জাফলংয়ে পানি স্থির ও শান্ত আছে। তাই এ পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ করা হয়নি। মাঝিরা নিরাপদ মনে করলেই নৌ চলাচল শুরু করেন, নতুবা বন্ধ রাখেন।
এদিকে জেলার পানিকেন্দ্রিক পর্যটনকেন্দ্র গোয়াইনঘাটের জলারবন রাতারগুল ও বিছনাকান্দি এবং জৈন্তাপুরের লালাখালে প্রচুর পরিমাণে পানি আছে। তবে কোনো পর্যটনকেন্দ্রই আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেনি স্থানীয় প্রশাসন। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে পানিকেন্দ্রিক ঝুঁকিপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্রগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আগামী বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু হবে পবিত্র ঈদুল আজহার টানা ১০ দিনের সরকারি ছুটি। যেহেতু বর্ষা মৌসুমে সিলেট সবুজ, স্নিগ্ধ ও মায়াবী হয়ে ওঠে, তাই এ সময়ে অনেক পর্যটক সিলেটে বেড়াতে আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছুটি শুরু হওয়ার আগে অতিবৃষ্টি ও ঢল কমে গেলে নদ-নদীর পানিও অনেকেটাই কমে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক আবদুর রহমান রিপন বলেন, ভারী বৃষ্টিসহ নানা কারণে এবারের ঈদের কেনাকাটায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে পর্যটনকেন্দ্রিক স্থানগুলোতে পানি আসায় ঈদের ছুটিতে পর্যটক আসবেন কি না, এ নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হোটেল, রিসোর্ট বুকিংয়ের হারও অনেক কম। তবে পানি নেমে গেলে দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতির আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এ সময়ে পর্যটনবাহী নৌকা চড়া ও পানিতে নামার সময় পর্যটকদের লাইফ জ্যাকেট পরতে হবে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, সাদাপাথর ছাড়া কোনো পর্যটনকেন্দ্রই বন্ধ করা হয়নি। স্রোতের তীব্রতা থাকলে মাঝিরা নিজ উদ্যোগেই পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে বেড়ানোর নৌ চলাচল বন্ধ রাখেন। তবে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার সময় যেহেতু আরও বাকি আছে, তাই এ সময়ে পানি বাড়ার হার দেখে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত অবহিত করা হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন ধ র খ পর স থ ত ল র পর র বন ধ র পর ম নদ নদ হওয় র এ সময়
এছাড়াও পড়ুন:
সেন্ট মার্টিন ভালো নেই, সেন্ট মার্টিনের মানুষ ভালো নেই
অমাবস্যা ও সমুদ্রের নিম্নচাপ একই সময় হওয়ার কারণে উপকূলজুড়ে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। সেখানকার জনজীবনে দুর্ভোগ ও ক্ষতির পরিমাপ এতটা বেশি যে অনুমান করাও কঠিন।
প্রতিবছর বর্ষায় মোটামুটি দু-তিনটি ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু এত ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস কখনো হয়নি। এত তাণ্ডব কখনো দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
২৬ ও ২৭ জুলাই সমুদ্রের নিষ্ঠুর লীলাখেলা দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দ্বীপের প্রায় চারপাশ থেকে হু হু করে ঢুকেছে সমুদ্রের পানি। অনেক দিন এমন পানির তোড় দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
দ্বীপে যা সামান্য কৃষিকাজ হয়, বিশেষ করে ধান চাষ ও সবজি চাষে এবার জলোচ্ছ্বাসের থাবা পড়েছে। লোনাপানি ঢুকে চাষাবাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
সমুদ্রের পাড়ের বাড়ি ও দ্বীপের মাঝখানের নিম্নাঞ্চলে (স্থানীয় ভাষায় মরং বলে) সাগরের পানি ঢোকার কারণে অনেক এলাকায় পানি লবণাক্ত হয়ে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
অনেক বাড়ি ও রিসোর্ট সমুদ্রের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গেছে।
দ্বীপে কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় এবার জলোচ্ছ্বাস পূর্ণমাত্রায় আঘাত করতে পেরেছে! ফলে পুরোপুরি অনিরাপদ দ্বীপটিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।
দ্বীপের ভাঙন শুরু মূলত ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে। ওই দুই ঘূর্ণিঝড় দ্বীপের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ আশপাশের পাথরের স্তূপ নড়বড়ে করে দেয়। ফলে দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রের স্রোত সমুদ্রগর্ভের পরিবর্তে সৈকত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়।
এতে দ্বীপের উত্তর ও উত্তর–পূর্ব পাশে ব্যাপক ভাঙন হয়। উত্তর পাড়া ও ডেইল পাড়া নামের দুটি পাড়া বিলীন হয়ে যায়। বাসিন্দাদের ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গুচ্ছগ্রাম করে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?সেই ১৯৯১ সাল থেকে আজ অবধি দ্বীপের ভাঙন চলমান। কিন্তু কোনো বেড়িবাঁধ নেই। আবার নতুন করে অপরিকল্পিত রিসোর্ট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণেও সৈকতের বালিয়াড়ি ও কেয়া ঝোপ উজাড় হয়েছে। এতে দ্বীপের ঢেউ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের, বিশেষ করে মুরব্বিদের কথায় এবারের মতো জলোচ্ছ্বাস তাঁদের জীবনে দেখেনি। তাঁরা দ্বীপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। আদৌ দ্বীপে অদূর ভবিষ্যতে বসবাস করতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে তাঁদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা মনে করেন, এ রকম আর দু–তিনটি জলোচ্ছ্বাস সহ্য করার মতো শক্তি সেন্ট মাটিনের নেই। দ্রুত স্রোতপ্রতিরোধী বাঁধ নির্মাণ করতে না পারলে সেন্ট মার্টিন ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে!
দ্বীপবাসী মনে করে, একটা টেকসই বেড়িবাঁধ যেটা সচরাচর উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধের মতো না। কারণ, এখানে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান। ফলে কাছিমের ডিম দিতে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়, সেভাবে সৈকত থেকে সমুদ্রের দিকে লম্বালম্বি করে বাঁধ দিয়ে স্রোত সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিতে হবে। দক্ষিণ ভারতে এ রকম বাঁধ অনেক কার্যকর প্রমাণিত।
পাশাপাশি দ্বীপের মানুষের আয়ের বিকল্প কর্মসংস্থান বা আয়ের উৎস সৃষ্টি করে পর্যটননির্ভরতা কমাতে হবে। একটা আবাসন নীতিমালা করে দ্বীপে পরিবেশবান্ধব বাড়ি ও ইকো রিসোর্ট করতে উৎসাহিত করতে হবে। যত্রতত্র রিসোর্ট করা বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত রিসোর্ট কমিয়ে ফেলতে হবে আর যেসব রিসোর্টের বিরুদ্ধে আইনি বাধা আছে, সেগুলো উচ্ছেদ করতে হবে।
সৈকত, জঙ্গল, খাল ও জলাভূমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজনে কিছু জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে বা ক্ষতিপূরণ হলেও সৈকতের ১০০ ফুট পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং সে জমিতে বনায়ন করতে হবে। ঝাউগাছের পরিবর্তে ভাঙনপ্রতিরোধী কেয়াগাছ, নারকেল ও সাগরলতা রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?
তৈয়ব উল্লাহ, আন্দোলনকর্মী ও সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা