কবি জসীমউদ্‌দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পাঁচ বছর (১৯৩৮-৪৩) শিক্ষকতা করেছেন। তবে তাঁর এ নাতিদীর্ঘ শিক্ষকতাকাল সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত জসীমউদ্‌দীনের স্মৃতিগ্রন্থ ঠাকুর–বাড়ির আঙিনায় থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার এ এফ রহমান তাঁকে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ অথবা অন্য কোনো নাম–করা লোকের কাছ থেকে যদি কোন ব্যক্তিগত পত্র আনতে পার, তবে এখানে বাংলা-বিভাগে তোমার জন্য কাজের চেষ্টা করতে পারি।’ (ঠাকুর–বাড়ির আঙিনায়, ১৯৬১, গ্রন্থপ্রকাশ, কলিকাতা, পৃ.

৩৬)

এরপর কলকাতায় গিয়ে কবি বাংলা সাহিত্যের দুজন দিকপালের সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু কেউই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জসীমউদ্‌দীনের নিয়োগ সমর্থন করে কোনো পত্র দিতে চাইলেন না। অবশেষে জসীমউদ্‌দীন গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, ভাবলেন, তিনিও হয়তো অন্যদের মতোই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন। কিন্তু কবিগুরুকে জসীমউদ্‌দীন তাঁর বেদনার কথা জানালে তৎক্ষণাৎ কবি তাঁর ব্যক্তিগত সচিব অমিয় চক্রবর্তীকে জসীমউদ্‌দীনের জন্য একটি সুপারিশপত্র লিখে আনার নির্দেশ দিলেন।

জসীমউদ্‌দীনসহ আরও অনেকের রচনায় রবীন্দ্রনাথের সেই সুপারিশপত্রের তথ্য উল্লেখ আছে। কিন্তু পত্রটি অনেকেরই পড়ার সুযোগ হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে জসীমউদ্‌দীনকে নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁদের মতে, সুপারিশপত্রটি অপ্রকাশিত। পত্রটি ইংরেজিতে লেখা। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের রেকর্ড শাখায় সংরক্ষিত আছে। যার বাংলা করলে এমনটা দাঁড়ায়।

উত্তরায়ণ

শান্তিনেকতন, বাংলা

১৩ জুলাই, ১৯৩৬

আমি জানিতে পারিয়াছি যে জনাব জসীমউদ্‌দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার প্রভাষক পদে আবেদন করিয়াছেন এবং আমি প্রত্যাশা করিতেছি যে কর্তৃপক্ষ তাহার যোগ্যতার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করিবেন। তিনি একজন খাঁটি প্রতিশ্রুতিশীল কবি এবং তাহার কবিতার একটি স্বতন্ত্র স্বর রহিয়াছে। বাংলা লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিয়াছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ভারতীয় ভাষার উপর এমএ ডিগ্রি প্রাপ্ত হইয়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সহকারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বাংলা কাব্যসাহিত্যে তাহার অবদান এবং কলকাতায় গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ পুরস্কৃত না হইয়া পারে না।

স্বাক্ষরিত/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

(রবীন্দ্র–ভাষার অনুকরণে অনূদিত)

১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জসীমউদ্‌দীনের জন্য আরেকটি সুপারিশ করেছিলেন। সেটি ছিল ব্যক্তিগতপত্র, সেখানে বিশেষ কোনো সুপারিশ ছিল না। তাই জসীমউদ্‌দীন রবীন্দ্রনাথকে ধরলেন চিঠিতে যেন বাংলায় হাতে লিখে দেন, ‘জসীমউদ্‌দীনের যদি ওখানে কাজ হয় আমি খুশি হব।’ কবি হাসতে হাসতে তা-ই লিখে দিলেন। এই সুপারিশপত্রও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের রেকর্ডরুমে জসীমউদ্‌দীনের ফাইলে সংরক্ষিত আছে। দুটি পত্রের ভাষায় সামঞ্জস্য রয়েছে, তবে দ্বিতীয় পত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা না লিখে কবি স্থানীয় কলেজ কর্তৃপক্ষের কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৬ সালের পত্রটিও ইংরেজিতে টাইপ করা এবং মার্জিনে রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা সুপারিশ—‘জসীমউদ্‌দীনের যদি কাজ পাওয়া সম্ভব হয় খুশি হব—(স্বা.) রবীন্দ্রনাথ’।

রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুপারিশপত্র হাতে নিয়ে কর্মহীন জসীমউদ্‌দীন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, কবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি আসে। অবশেষে কবি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দেখা পেলেন । ১৯৩৭ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় পদার্থ, রসায়ন, ইংরেজি, অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বাংলা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। তারপর ১৯ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার নাজির উদ্দিন আহমদের স্বাক্ষরিত শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিটি এল। সেই বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে জসীমউদ্‌দীন ৩০ আগস্ট তাঁর আবেদনপত্র জমা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পরের দিন, ৩১ আগস্ট, তাঁর আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়। আবেদনের পর যাচাই–বাছাই পর্ব পেরিয়ে ১৯৩৭ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে ড. এনামুল হক ও জসীমউদ্‌দীনকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৩৮-৩৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে জসীমউদ্‌দীনকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সেই খবর রেজিস্ট্রার নাজির উদ্দিন আহমদ ১৯৩৭ সালের ১ ডিসেম্বর একটি চিঠির মাধ্যমে জসীমউদ্‌দীনকে জানান।

কবির জন্য শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, দীনেশচন্দ্র সেন ও খগেন্দ্রনাথ মিত্রও সুপারিশ করেছিলেন। তবে রবি ঠাকুরের সুপারিশে ‘বেকার’ জসীমউদ্‌দীনের ভাগ্যের চাকা বদলে গেল। প্রতি মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় ১২৫ রুপি বেতনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন কবি জসীমউদ্‌দীন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স প র শপত র রব ন দ র র জন য আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

দাসত্বের সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি: শিক্ষা উপদেষ্টা

শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, “বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম যে দাসত্বের সংস্কৃতি চালু করেছিল আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় লেজুরবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”

বুধবার (৩০ জুলাই) সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষের লেভেল-১, সেমিস্টার-১ এ ভর্তিকৃত নবীণ শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।

চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, “জুলাই ২৪ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করেছি। গত ১৭ বছর আমরা আমাদের নাগরিকত্ব সপে দিয়েছিলাম একটি ফ্যাসিবাদ সরকারের কাছে। যারা পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে দাসত্বের চুক্তি করেছিল। আমরা কখনো ভাবিনি এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে।” 

আরো পড়ুন:

কৃষি উপদেষ্টা-চীনা রাষ্ট্রদূত সাক্ষাৎ 

আইএমও কাউন্সিল নির্বাচনে জিবুতির সমর্থন চাইল বাংলাদেশ

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “খুন, আয়নাঘর, বিচারহীনতার মধ্য দিয়ে চলছিল এই বাংলাদেশ। এর থেকে পরিত্রাণ তোমরাই দিয়েছো। ছাত্র-জনতার এই অর্জনকে ম্লান হতে দেওয়া যাবে না।”

‍“নতুন বাংলাদেশে তোমরা নিজেদেরকে আপন স্বকীয়তায় উপস্থাপন করবে, রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে তা তোমরা নির্ধারন করবে। তোমাদের ধৈর্যশীল ও রুচিশীলতার পাশাপাশি উন্নত মনের বিবেকবান ও সুন্দর মনের মানুষের পরিচয় দিতে হবে”, যোগ করেন তিনি। 

উপদেষ্টা বলেন, “পেশিশক্তির ব্যবহার রোধ করতে হবে। সহনশীলতা ও সহমর্মিতার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সহশিক্ষার কার্যক্রমে গুরুত্বারোপের পাশাপাশি সমাজে পিছিয়ে পরাদের এগিয়ে নিতে সহায়তা করতে হবে।”

ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, “নবীন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করে মেলে ধরবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্লোবাল নলেজ বাড়ানোর জন্য বিশ্ব আঙ্গিকে লাইব্রেরিকে উপযুক্ত করতে হবে, যা গবেষণার কাজকে আরো ত্বরান্বিত করবে।”

ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সামিউল আহসান তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিকৃবির ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. আলিমুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. এ.টি.এম. মাহবুব-ই-ইলাহী।

এসময় উপস্থিত ছিলেন- ডিন কাউন্সিলের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মো. নজরুল ইসলাম, প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কাওছার হোসেন, প্রক্টর প্রফেসর ড. জসিম উদ্দিন আহাম্মদ, রেজিস্ট্রার (অ.দা) প্রফেসর ড. মো. আসাদ-উদ-দৌলা।

ঢাকা/নূর/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ