একটি প্রেমের কবিতা
বিনয়কে নিয়ে আজ একটা লেখা তৈরি করা যায়
এটি খাবে ভালো, বাজারি লোকদের কাছে নামটি ওর
দিনপঞ্জিকার মতো জ্বলজ্বলে। পঁচিশ বছর লিখেও এতটা
নাম করা যায় না। বিনয় কর্মকার,
তোমাকে ভীষণ দরকার।
ফ্ল্যাশব্যাক
বিনয়কে দেখা যাবে বটতলার নিচে, সকাল সাতটায়
তার মুখে পৃথিবীর মুখগুলি হাসিয়া বেড়ায়
বিনয়কে পাওয়া যাবে না, রাত বারোটায়
তখন সে চাঁদকোলে ঘুমঘোর যায়
পলিথিন ব্যাগে কাতলা মাছটার সাদা বুকে রোদ লেগে
চিক্ চিক্ করে উঠলেই সে বুঝতে পারে, এই বাবুর
অবশ্যই দরকার আছে। মাত্র দেড় টাকায় বিনয়কে
পাশে পাওয়া যায়। আজকাল যদিও আগের মতো নয়
যতটা বাহাত্তরে ছিল। রিকশা-ভ্যান আর মালগাড়ি
এসে বিনয়কে বিভক্ত করেছে। একচেটিয়া কারবার নেই,
মেয়ে দুটি ডাঙর হয়েছে। বউয়ের শাড়ি আছে তো
ব্লাউজ ছিঁড়েছে, পেটিকোট নেই। একটা হুইল সাবান চাই।
দু’টাকার নারকেল তেল–
এতটুকু সুগন্ধ না হলে কি পাশে শোয়া যায়!
কাট স্ন্যাপ
হাড্ডিসার বিনয় কর্মকার, দ্রুত হাত রাখে চালের বস্তায়
পায়ে হাঁটা গাড়ি যত তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায়;
একটা শ্রমিক বিড়ির পথ, বিড়িটা মাগনা খায়
রোদে পোড়া আর বৃষ্টিভেজা বিনয়।
পথের মধ্যে খালি ব্যাগ হাতে
ছোট মেয়েটা দাঁড়াবে ঘড়িহীন ঠিক বারোটায়;
পথ যত হোক, বিনয়ের পা-গাড়ি দ্রুত চলে যায়
দুপুর গড়াতে থাকে, তার ভার কমে– গোলার দিঘিতে
আরও কিছু আলগা হয়ে যাওয়া সন্ধ্যায়
বউয়ের প্রতীক্ষা কাঁসার প্লেটে
ভাতের মতো জড়ো হয়;
বিনয়কে নিয়ে একটি প্রেমের কবিতা লেখা যায়
গত রাতে তাদের দুজনার ঘটনাসকল
বেওয়ারিশ করেছে নির্লজ্জ চাঁদ উত্তীর্ণ সন্ধ্যায়
অথচ এই ঘটনা একদিন প্রবাদিত হবে!
রানিং স্ন্যাপ
বারান্দাতে বিনয় ঘুমায়, ঘরের মধ্যে মেয়ে
বউয়ের মধ্যে ঘুমায় বিনয় চাঁদের দিকে চেয়ে
এই রাতে আর কী কী লেখা যায়?
একদিন বিনয়ের হাড়গোড় খোঁজা হবে
আমাদের প্রত্নপাড়ায়
(রচনাকাল: ১৯৯৪ সাল)
এই কবিতাটি লিটল কিংবা বিগ কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়নি। আমার প্রথম কবিতার বই উড়ে যাচ্ছ মেঘ-এ এর প্রথম মুদ্রণ। আপনারা নিশ্চয় কবিতা পড়ার পর বুঝে গেছেন যে কবিতাটি বিনয় কর্মকারকে নিয়ে লেখা। আমার অনেক পাঠকবন্ধু ‘কর্মকার’ শব্দটি না পড়ে মনের অজান্তে ‘মজুমদার’ পড়েছে। বিনয় কর্মকার আর বিনয় মজুমদার এক চরিত্র নয়। একজন কুলি। আরেকজন কবি। কবি হিসেবে বিনয় মজুমদার যেহেতু বাংলা ভাষার পাঠক সমাজে উত্তীর্ণ, ফলে বিনয় নামটি শোনার সাথে সাথে মজুমদার বসিয়ে দেয়। আর যারা বিনয় মজুমদারের কবিতা পড়েননি, তারা যখন এই কবিতাটি পড়েন, তখন ঠিকই বিনয় কর্মকার উচ্চারণ করেন। আমি বিনয় মজুমদারকে দেখিনি, তাঁর কবিতা পড়েছি। অবশ্য তাঁর কবিতা পড়ার অনেক অনেক আগেই আমি বিনয় কর্মকারকে দেখেছি। আরামের বিষয় হলো– এরা দুজনই প্রেমিক পুরুষ। একজন কুলি, আরজন কবি। যে বিনয় কুলি, সে প্রেম পেয়েছিল। আর যে বিনয় কবি, সে প্রেমের ব্যর্থতা কুড়িয়েছিল। তবে এ কবিতা বিনয় মজুমদারকে নিয়ে নয় বলে, তাঁর কথা এখানেই সাঙ্গ করি। যদিও শেষ করলেও তাঁর অবশেষ থেকে যায়।
বিনয় কর্মকার একদিন আমার কবিতার খাতায় জায়গা করে নিয়েছিল কীভাবে? তার কারণ আমি নিজেও ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। মানুষের জীবন এমনই এক অব্যাখ্যাত আখ্যান। বিনয় কর্মকারের শারীরিক গঠন ছিল এই প্রকারের– একটা লুঙ্গি মোচড় দিয়ে পরা নাভির নিচে। তার হাড়-মাংস সমান্তরালভাবে সজ্জিত। কোথাও একটু অযথা আধিক্য নেই। আজ আমরা যেসব শরীর বর্ণনা করতে যেয়ে বলি সিক্সপ্যাক বা ষড়রেখা। বিনয়ের শরীরেও সেই সিক্সপ্যাক উন্মুক্ত হয়ে ছিল। শরীরচর্চা করে নয়, জীবিকার জন্য পরিশ্রম করেই এই সিক্সপ্যাকের জন্ম হয়েছিল বিনয় কর্মকারের শরীরে। শীতকালে সে একটি বাবা গেঞ্জি পরত। গরমকালে লুঙ্গি ব্যতীত অন্য কোনো বস্ত্র তাকে পরিধান করতে দেখিনি। চুলগুলো কোঁকড়ানো। গোঁফ ছিল। কিন্তু দাড়ি কামাতেন নিয়মিত। গৈলার বাজারে তিনি একমাত্র কুলি। যাদের সাপ্তাহিক ক্রয়ক্ষমতার প্রাচুর্য ছিল, তারা এক সপ্তাহের বাজার করতেন। আর যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের কাছে বিনয়ের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি যে সময়ের কথা লিখছি, সে সময়ে সাধারণত চাল-আটা কেউ কেউ এক মাসের জন্য ক্রয় করত। চল্লিশ সেরে এক মণ ছিল তখন। বিনয়কে সাধারণত চাল ও আটা বিক্রির গলিতে দেখা যেত, যেখানে একটি বটগাছ ছিল, তার নিচে বসে থাকতেন তিনি। অবশ্য বলতে ভুলে গেছি তার কাঁধে একটি গামছা থাকত, ঘাম মোছার জন্য। যারা এক মণ চালের বস্তা কিনতেন তাদের কাছেই বিনয়ের চাহিদা ছিল। কেউ কেউ এক মণ চাল তার ঘাড়ে তুলে দিয়ে একটি ইলিশ কিংবা বোয়াল মাছ হাতে ঝুলিয়ে দিতেন। এই দেওয়া লোক দেখানোর জন্য! বিনয় মাথায় করে বস্তা বইতেন না। ঘাড়ে বইতেন। সেই দৃশ্য যারা দেখেছেন, তারাই শুধু জেনেছেন, এ কথা যতভাবেই বলি না কেন, বিনয়কে পরিপূর্ণ বলা যাবে না। কারণ বিনয়ের নামটি কে দিয়েছিল, তা কোনোদিন তার কাছে জানতে চাইনি। আমি তখন হাফপ্যান্ট পরা ছোট্ট কিশোর। আমাদের বাড়িতেও বিনয় দা চালের বস্তা পৌঁছে দিতেন। তাকে কোনোদিনই দেখিনি দরাদরি করতে। অনেকেই তাকে ঠকিয়েছে। কিন্তু মাল পৌঁছে দেওয়ার পর, যা টাকাকড়ি দিতেন, তা-ই হাতে তুলে নিতেন। এই দৃশ্য আমি প্রকাশ্যে দেখেছি। এও দেখেছি, যদি কেউ কম দিতেন, কোনো কথা না বলে মুখে এক রকমের তাচ্ছিল্য ভাবের চিত্রকল্প এঁকে চলে আসতেন। ফলে বিনয় দার নামের সার্থকতা সেখানেও দেখেছি।
বিনয় কর্মকার, আমার বিনয় দা এখন আর বেঁচে নেই। তাঁর পরিবার-পরিজন কে কোথায় আছে, তাও জানি না। মনে করি তিনি আমার কবিতায় এখনও বেঁচে আছেন। কত লোক তো অর্থ দিয়ে আত্মজীবনী লিখিয়ে নেন, পরের কালে বেঁচে থাকার আশায়। আসলে তিনি নিজেই এমন একটি কবিতা– আমি যার আত্মজীবনী লিখতে চেয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম– বিনার্থে, অর্থহীনতায়। জীবন এমনই হবে, হয়তোবা কাল যাকে দরকার ছিল চালের বস্তা ঘাড়ে করে পৌঁছে দেবে আমার বারান্দায়, আজ তাকে পেতে চাই মনের উঠোনে। কিন্তু এভাবে কি আর বিনয় কর্মকারকে পাওয়া যায়, কর্মকার পাড়ায়? v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ ল র বস ত ব নয় ম র জন য ব নয় র র ব নয় ব নয় ক ব নয়ক
এছাড়াও পড়ুন:
নারায়ণগঞ্জে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ৫ বিএনপি নেতা বহিষ্কার
নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার উপজেলায় বিএনপির কার্যালয়ের ভাড়া চাওয়ায় দোকান মালিক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে (৫০) পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পাঁচ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
তারা হলেন, উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তোতা মেম্বার, জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খোকন প্রধান, বিএনপি নেতা রাসেল প্রধান, আলম মিয়া ও সাদ্দাম হোসেন।
বুধবার (৩০ জুলাই) রাতে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মামুন মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বহিষ্কারের বিষয়টি জানানো হয়।
আরো পড়ুন:
উপদেষ্টা আসিফের সমর্থকদের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
কুষ্টিয়া প্রেস ক্লাবে বিএনপির অভিযোগ বক্স, যা পাওয়া গেল
এর আগে সকালে আড়াই হাজার উপজেলায় জাহাঙ্গীর ভূইয়া খুন হন। নিহতের ছেলে রাসেল জানান, ৫ আগস্টের পর বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান সুমনের অনুসারী মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তোতা মেম্বার সালমদী বাজারে তার বাবার কাছ থেকে বছরে ৩০ হাজার টাকা ভাড়ায় ৩টি দোকান ভাড়া নেন। এর একটি দোকানে বিএনপির কার্যালয় স্থাপন করেন। বাকি দুটি দোকানের ভাড়া পরিশোধ করলেও যে দোকানে বিএনপির কার্যালয় করেছেন, সেটির ভাড়া পরিশোধ করছিলেন না।
তিনি আরো জানান, আজ বুধবার (৩০ জুলাই) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তার বাবা জাহাঙ্গীর ভূইয়া ভাড়া চাইতে বিএনপি কার্যালয়ে তোতা মেম্বারের কাছে যান। ভাড়া চাইলে তোতা মেম্বার টালবাহানা শুরু করেন। এ সময় উভয়ের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে তার বাবাকে তোতা মেম্বার চড় দেন। এ খবর পেয়ে তোতা মেম্বারের ছেলে খোকন, রাসেল, ভাতিজা সাদ্দাম, আলমসহ কয়েকজন তার বাবাকে বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ঢাকা/অনিক/বকুল