বাংলাদেশে চীনের প্রভাববলয়ে সামঞ্জস্য আনতে কাজ করব
Published: 12th, June 2025 GMT
মার্কিন পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটির শুনানিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি পদের জন্য মনোনীত পল কাপুর। তিনি বলেছেন, তাঁকে চূড়ান্ত করা হলে তিনি এ অঞ্চলে চীনের প্রভাববলয়ে সামঞ্জস্য ফিরিয়ে আনা এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে কাজ করবেন।
ওয়াশিংটনে মঙ্গলবার এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। কমিটি চূড়ান্ত করলে ট্রাম্প প্রশাসনের হয়ে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেখাশোনা করবেন পল কাপুর। বাংলাদেশ-ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো হলো– পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান। তা ছাড়া কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান নিয়ে গঠিত মধ্য এশিয়ায়ও দায়িত্ব পালন করবেন তিনি।
শুনানিতে পল কাপুর বলেন, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (ইন্দো-প্যাসিফিক) স্থিতিশীলতার জন্য শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি বৃহত্তর। তিনি এই অঞ্চলের নিরাপত্তা জোরদার, চীনের প্রভাব মোকাবিলা ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলেন।
পল কাপুর বলেন, ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন নিরাপত্তা স্বার্থকে এগিয়ে নিতে তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনে কাজ করার পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন।
সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সামরিক উত্তেজনা, এ অঞ্চলে চীনের আধিপত্য, আফগানিস্তান সংকটসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন পল কাপুর। দায়িত্ব পেলে তিনি দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বহু অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করতে আমি কাজ করব, যাতে চীনের আধিপত্য মোকাবিলা করা যায়। তাছাড়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানো ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও লাভজনকভাবে গড়ে তোলার কথাও বলেন তিনি।
পল কাপুর বলেন, এই অঞ্চলে প্রযুক্তি শেয়ার ও উদ্ভাবনকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয় জ্বালানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক আরও গভীর করতে মনোযোগ দেবেন তিনি। দুই দেশের অংশীদারিত্বকে তিনি অপার সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নিতে চান।
পাকিস্তান প্রসঙ্গে পল কাপুর বলেন, এমন নিরাপত্তা সহযোগিতা অনুসরণ করা হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে সহায়ক হবে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সম্ভাবনা খুলে দেবে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়া একটি ভয়াবহ সংঘাত এড়িয়ে গেছে। এই সংঘাত থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
একজন ভারতীয় পিতা ও আমেরিকান মায়ের ঘরে নয়াদিল্লিতে জন্ম নেন পল কাপুর। তিনি বড় হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে একজন আমেরিকান শিশু হিসেবে। পল কাপুর বলেন, কখনও ভাবেননি যে নিজ জন্মভূমির অঞ্চলেই তিনি কর্মজীবনে দায়িত্ব পালন করবেন।
শুনানিতে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই পদে মনোনয়নের জন্য তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে কৃতজ্ঞ। এ সময় তিনি পরিবার ও বন্ধুদের অব্যাহত সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পল কাপুর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে পাঠে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। দ্রুতই একজন গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এই অঞ্চল নিয়ে কাজ শুরু করেন। একজন গবেষক হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিবেশ এবং এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ওপর বই ও প্রবন্ধ লেখেন। মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের এই অঞ্চল সম্পর্কে শিক্ষাদানে নিযুক্ত হন।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত কৌশলগত সম্পর্কবিষয়ক প্রকল্প পরিচালনা করেছেন পল কাপুর। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পলিসি প্ল্যানিং স্টাফে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক দায়িত্বও পালন করেছেন।
শুনানিতে বক্তব্যে পল কাপুর বলেন, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অপার সম্ভাবনা বহন করে। সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে এই সম্পর্কগুলো বিকশিত হতে পারে। বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও নিরাপদ, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন পল কাপুর। তিনি আফগানিস্তানে আটক থাকা মার্কিন নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। একইসঙ্গে আফগানিস্তান যাতে আর কখনও সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান।
পল কাপুর বলেন, মধ্য এশিয়ায় তিনি আঞ্চলিক কূটনৈতিক প্ল্যাটফর্ম সি৫+১ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে কাজ করবেন। এক্ষেত্রে তিনি দ্বিপক্ষীয় কাঠামো ব্যবহার করবেন। তাছাড়া জ্বালানি, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ভৌত ও ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতায় ভূমিকা রাখবেন।
শুনানিতে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন মার্কিন পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর জিম রিশ। পররাষ্ট্র সম্পর্কিত এ শুনানিতে অন্যান্য দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে রাষ্ট্রদূত মনোনয়ন এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন তিনি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম র ক ন পরর ষ ট র য ক তর ষ ট র র আফগ ন স ত ন পল ক প র ব ন পল ক প র ক জ করব র জন য ক জ কর করব ন ব ষয়ক
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ