হাওর এলাকায় বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে সুনামগঞ্জের ৬টি উপজেলায় ২০২২ সালে ১৮টি বজ্রনিরোধক দণ্ড (লাইটনিং অ্যারেস্টার) স্থাপন করা হয়েছিল। এতে সরকারের কোটি টাকার ওপরে ব্যয় হয়। এসব দণ্ড কোথায় কীভাবে আছে, কেউ খোঁজ রাখেন না। এরও আগে ২০১৮ সালের দিকে সরকারি উদ্যোগে হাওরে তালগাছ লাগানো হয়েছিল। এখন সেসব গাছের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
হাওরে বজ্রপাত থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; কিন্তু কোনো প্রকল্পই সফলতার মুখ দেখেনি। ফলে বজ্রপাতে প্রাণহানির তালিকা প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছেন ২৪ জন। এর মধ্যে কৃষক ১৩, জেলে ৬, মাঝি ২, ছাত্র ২ ও ১ জন নারী। আগের পাঁচ বছরে জেলায় বজ্রপাতে ৬৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এবার এপ্রিল ও মে মাসেই মৃত্যু হয়েছে বেশি। এ সময় হাওরে ধান কাটা হয়। মাঠে ব্যস্ত থাকতে হয় কৃষকদের।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, সুনামগঞ্জে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বজ্রপাত বেশি হওয়ায় প্রাণহানির ঘটনাও এ সময় বেশি ঘটে। দায়সারা নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও কোনো কাজে আসেনি।
হাওরে বজ্রপাত থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; কিন্তু কোনো প্রকল্পই সফলতার মুখ দেখেনি। ফলে বজ্রপাতে প্রাণহানির তালিকা প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে।বজ্রনিরোধক দণ্ডের খোঁজ রাখেনি কেউ
বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে ২০২২ সালে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৮টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এগুলো স্থাপনের পর আর কেউ খোঁজ নেয়নি। এখন যন্ত্রগুলো সচল আছে কি না, কেউ জানে না।
বজ্রনিরোধক দণ্ডের চারপাশের নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎকে সহজে মাটিতে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। এতে ওই স্থানে কোনো প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে না। সুনামগঞ্জে স্থাপন করা বজ্রনিরোধক দণ্ডগুলোর পরিসর ছিল চারদিকে ১১০ মিটার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব বজ্রনিরোধক দণ্ড হাওরে স্থাপন করার কথা থাকলেও বেশির ভাগই স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কিংবা অন্য কোনো ভবনের ছাদে, বাজারে অথবা রাস্তার পাশে।
তালিকা ধরে সরেজমিন দেখা গেছে, বিশ্বম্ভরপুরের সলুকাবাদ ইউপি কার্যালয় ভবন ভাদেরকেট বাজারের পাশে অবস্থিত। এই বাজার থেকে উপজেলার করচার হাওরের দূরত্ব দুই কিলোমিটারের বেশি। কাগজপত্রে লেখা, বাজারে ওই দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।
কিন্তু বাজারে গিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে এটির হদিস পাওয়া যায়নি। পরে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে কথা বলে জানা গেল, এটি তাদের ভবনের ছাদে আছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা মো.
এই উপজেলার আরেকটি যন্ত্র বিশ্বম্ভরপুর বাজারের কথা বলে স্থাপন করা হয়েছে উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের ‘মুজিবপল্লিতে’। শুধু এই উপজেলায় নয়, অন্য উপজেলাগুলোর চিত্রও একই।
তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক বজ্রপাত থেকে রক্ষায় সহায়ক বলে মনে করা হয়। তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। তালগাছের বাকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। এ কারণে বজ্রপাত থেকে রক্ষায় তালগাছ রোপণে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে।তালগাছের অস্তিত্ব নেই
২০১৮ সালে সারা দেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জেও সরকারিভাবে তালগাছ রোপণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় ৪০ হাজার তালগাছ রোপণ করা হয়। কিন্তু এখন এসব তালগাছের কোনো অস্তিত্ব নেই। এগুলো রোপণের পর আর কোনো পরিচর্যা করা হয়নি। ফলে এ প্রকল্পের কোনো ফল হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক বজ্রপাত থেকে রক্ষায় সহায়ক বলে মনে করা হয়। তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। তালগাছের বাকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। এ কারণে বজ্রপাত থেকে রক্ষায় তালগাছ রোপণে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে।
আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি, আরও কীভাবে করা যায়। দ্রুততম সময়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মানুষের কাজে পৌঁছানো গেলে মানুষও তত দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবেন। এতে ঝুঁকি কমবেজেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াচার ‘আশ্রয়স্থলে’ উপকার পাচ্ছেন মানুষ
বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানো, দুর্যোগে নিরাপদ আশ্রয় ও কাজের সময় বিশ্রামের কথা চিন্তা করে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে জেলে-কৃষকদের জন্য চারটি লাইটনিং শেড (আশ্রয়স্থল) নির্মাণ করা হয়। ২০২৩ সালে লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্পের মাধ্যমে এগুলো নির্মাণ করা হয়। ১৮ ফুট উচ্চতা ও মাঝখানে ৯ ফুটের পাকা মেঝে রয়েছে এতে। রাখা হয়েছে বিশুদ্ধ পানি, টয়লেটের ব্যবস্থা। এসবের প্রতিটি নির্মাণ করতে ১২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে প্রাণহানি নিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া সচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছেন। বজ্রনিরোধক দণ্ডগুলো কাজ করছে কি না, খোঁজ নেবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি কারা কীভাবে স্থাপন করেছিল, এখন কীভাবে আছে, সেটি খোঁজ নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি, আরও কীভাবে করা যায়। দ্রুততম সময়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মানুষের কাজে পৌঁছানো গেলে মানুষও তত দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবেন। এতে ঝুঁকি কমবে।’
সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত সুনামগঞ্জে
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার তথ্য বলছে, সারা বিশ্বে মার্চ থেকে মে—এই তিন মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জে। স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে ২০১৭ সালের দিকে এই গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বায়ুদূষণ, বায়ু–মাটির তাপ বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু কারণে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু সুনামগঞ্জের ওপরে এসে মেঘালয় পর্বতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই শুষ্ক বাতাসে তাপমাত্রা বেশি। এখানে জমে থাকা উষ্ণ মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বজ্রপাত বেশি হয়। হাওরে গত ৩০ বছরে ৬০ শতাংশ জলাভূমি পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ জন্য মানুষও দায়ী।
বজ্রপাত থেকে জীবন রক্ষায় প্রযুক্তির বাইরে গিয়ে কীভাবে ঝুঁকি কমানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে বলে মনে করেন সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন।
অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলামের মত হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে দ্রুত বার্তা পৌঁছাতে হবে। এটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হচ্ছে। এতে প্রাণহানি কমেছে। সাধারণ মানুষের মুঠোফোনে বার্তা দেওয়া। যত দ্রুত বার্তা যাবে, ততই প্রাণহানি কমবে। একই সঙ্গে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দায়সারা কোনো পদক্ষেপ বা প্রকল্প নয়, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক, গবেষকসহ সবাইকে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। এতে প্রায় ৮০ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন মগঞ জ র সরক র র প রকল প ল ইসল ম রক ষ য় হয় ছ ল উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
টেকনাফে নিখোঁজের ৩২ ঘণ্টা পর জেলের লাশ উদ্ধার
কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার ৩২ ঘণ্টা পর এক জেলের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁর নাম মোহাম্মদ ইসমাইল (২৪)। আজ শুক্রবার বেলা দুইটার দিকে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের বাহারছড়া সমুদ্র উপকূল থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
মোহাম্মদ ইসমাইল টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়া এলাকার মৃত আবুল হাশেমের ছেলে।
সাবরাং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুস সালাম জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার দিকে নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ গোলারচর এলাকায় মাছ শিকারে যান ইসমাইল। এ সময় ভেসে যান তিনি। আশপাশের লোকজন ও জেলেরা নাফ নদী ও আশপাশের এলাকায় খোঁজাখুঁজি করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। আজ দুপরে সাবরাং ইউনিয়নের বাহারছড়া ঘাট এলাকায় লাশ ভাসতে দেখে পুলিশকে খবর দেন স্থানীয় লোকজন। পরবর্তী সময়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশটি উদ্ধার করে।
এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন জানান, মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া জেলে ইসমাইলের পরিবারের সদস্যরা লাশটি শনাক্ত করেছেন। তাঁদের কাছে লাশটি হস্তান্তর করা হয়েছে।