দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট (ফাইভ–জি ভার্সন)
Published: 13th, June 2025 GMT
আপনারা জানেন, চাকরিতে উন্নতি করার নিয়ম কী? রুল হলো দুটি। রুল নম্বর ১. দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট। রুল নম্বর ২. ইফ দ্য বস ইজ রং, সি রুল নম্বর ওয়ান।
আপনার বস সব সময়ই ঠিক। তিনি যা বলবেন, তা-ই ঠিক। এক অফিসে বস প্রতিদিন সকালবেলা কর্মীদের ডেকে কৌতুক শোনান। সবাই একযোগে হেসে ওঠে। যে বেশি জোরে হাসে, তার প্রমোশন, ইনক্রিমেন্ট, বোনাস ইত্যাদি বেশি হওয়ার চান্স থাকে।
কৌতুকগুলো হয় ব্রিটিশ আমলের। যেমন একদিন বস বললেন, শোনেন, একটা কৌতুক বলি। রাজা বললেন, তোমরা যারা বউকে ভয় পাও, সবাই তোমাদের ডান দিকে যাও। সবাই গেল। শুধু একজন গেল বাঁ দিকে।
রাজা বললেন, কী ব্যাপার। তুমি বউকে ভয় পাও না?
হুজুর, আমার বউ বলেছেন, যেদিকে ভিড়, সেদিকে কোনো দিনও যাবে না। তা-ই ডান দিকে যাইনি। বাম দিকে গেছি।
এই কৌতুকের চেয়ে বিরক্তিকর কৌতুক আর হয় না। নারীবিদ্বেষী, সুতরাং পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট। আর এই কৌতুক শোনেনি, বাংলাদেশে একজনও চাকরিজীবী নাই।
সবাই হাসতে লাগল, শুধু আদনান মুকিত ছাড়া। অফিসের সহকর্মীরা বলতে লাগল, কী ব্যাপার, আদনান, তুমি যে হাসলে না।
আদনান বলল, ভাই, আমি সকালেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এসেছি। আজকেই আমার অফিসের শেষ দিন।
তো এই দোর্দণ্ড প্রতাপ বসের নাম বাদল চৌধুরী। লোকে বলে, তার নাম ছিল বাদল মিয়া। তিনি নিজে নিজে চৌধুরী লাগিয়ে নিয়েছেন।
এটা একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থা। এটার মালিক খান অ্যান্ড খান কোম্পানি লিমিটেড। খান সাহেবরা বসেন গুলশানে। ১১ তলা করপোরেট ভবনে। আর এই বিজ্ঞাপনী সংস্থা, যার নাম লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেড, এর অফিস বনানী ১১ নম্বর সড়কে।
খান সাহেবরা সিইও হিসেবে এই বাদল চৌধুরীকে কোত্থেকে যে এনে বসিয়ে দিয়েছেন, তা কেবল আল্লাহ তাআলা জানেন।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ ঢাকা শহরের বিলবোর্ডগুলো ভাড়া দেওয়া। সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে জায়গা ইজারা নেওয়া হয়। তারপর সেখানে বিলবোর্ড বসিয়ে তা ভাড়া দেওয়া হয়। অন্য বিজ্ঞাপনী সংস্থা জায়গাগুলো কেনে। তারা নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন নিজেরাই তৈরি করে।
আর এরা সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনী এজেন্ট। সংবাদপত্রের পাতা বুকিং দিয়ে রাখে। বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন সেখানে ছাপা হয়।
তো এই অফিসের বস বাদল চৌধুরী তার অধীন আবুল বাশার আর দীপ্তি সিনহাকে ডেকে বললেন, আমরা কি কেবল অন্যের বানানো ক্রিয়েটিভ ছাপাব? আমরা নিজেরা কেন বিজ্ঞাপন বানাই না?
স্যার, সেটাতে অনেক ঝামেলা। আবুল বাশার বলল, আমাদের অনেক বড় টিম লাগবে। একদল লাগবে আইডিয়াবাজ। তারা সিগারেট খাবে, হাফপ্যান্ট পরে অফিসে আসবে, তিন দিন আবার আসবে না, তারা আইডিয়া জেনারেট করবে। একদল লাগবে কপি রাইটার। তারপর লাগবে ক্রিয়েটিভ টিম। আইডিয়ার ওপরে ক্রিয়েটিভ বানাবে। ক্যামেরাম্যান লাগবে। টিভিসি বানাতে হলে তো আরেক প্যারা। এডিটিং প্যানেল লাগবে। আর্টিস্ট লাগবে। আজকাল এই প্যারা কেউ নেয় না। সবাই আউটসোর্সিং করে।
বাদল চৌধুরীর হাতে তখন একটা বিলবোর্ডের ডিজাইন। একটা গুঁড়ো সাবানের অ্যাড। সুপার মডেল আনুশকা ভেজা কাপড় পরে সাদা কাপড় ওড়াচ্ছে। বাদল চৌধুরী এই দৃশ্য দেখে পাথর হয়ে গেছেন।
তিনি বললেন, দীপ্তি, আপনি যান। আবুল বাশার আপনি থাকেন।
বাদল চৌধুরীর মাথাভরা টাক। সামনের দাঁত ফাঁকা এবং উঁচু। গায়ের রং সফেদা ফলের মতো। বয়স ৬২। গলার স্বর মেয়েদের মতো। তিনি বললেন, এই মডেলের নাম আপনি জানেন?
জি। আনুশকা চৌধুরী।
চৌধুরী? আমিও তো চৌধুরী।
জি।
আপনি জানেন, আপনার ভাবি আমেরিকা গেছে। বড় ছেলের বউ প্রেগন্যান্ট। তাকে দেখতে গেছে। এরপর আবার আমার মেয়েটারও খবর হয়েছে। আগামী দুই বছর আপনার ভাবি দেশে আসছে না।
জি।
আমি একা একা থাকি। এই রকম মডেল–টডেলরা আমাদের অফিসে আসবে। চা–কফি খাবে। কেউ যদি রেড ওয়াইন খেতে চায়, তা–ও খেতে পারে। কী বলেন!
নিশ্চয়ই।
তাহলে আমাদের কি উচিত নয়, নিজেদের বিলবোর্ডের ডিজাইন নিজেরাই করা!
অবশ্যই স্যার।
সামনে একটা ট্যালকম পাউডারের বিজ্ঞাপন আসার কথা। আমরা সরাসরি কোম্পানিকে বলি। আমাদের ডিজাইন করতে দিক। আমরা হাফ প্রাইসে করে দেব।
সেটা কি স্যার ঠিক হবে? এই এজেন্সি অন্য ক্লায়েন্টের কাছে চলে যাবে। আমরা ব্যবসা হারাব। আবুল বাশার অভিজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে মাস্টার্স। তিনি আপত্তি করেন।
আবুল বাশার, আপনার তিন দিন ছুটি। আপনি দীপ্তিকে পাঠিয়ে দেন।
জি, আচ্ছা।
আবুল বাশার মন খারাপ করে ছুটিতে চলে যান।
দীপ্তি সিনহা!
ইয়েস স্যার।
আপনাকে আমি জেনারেল ম্যানেজার করে দিচ্ছি।
ইয়েস স্যার।
আমরা নিজেরা ফটোশুট করব। ভালো মডেল কে কে আছে?
দীপ্তি ফেসবুক খুলে বাদল চৌধুরীকে মডেল দেখান।
এর নাম কী?
কাকলী বেগম।
ভালো না?
জি, স্যার।
বয়স কম তো? নাকি?
জি স্যার। আইএ পড়ে।
১৮ বছর হয়েছে তো?
জি স্যার।
আচ্ছা। ওকে ডাকেন দেখি। প্রাথমিক আলাপ সারি। কত টাকা চায়, শুধু তো বিলবোর্ডে ছবি যাবে। আর পেপার অ্যাডে।
আচ্ছা, স্যার।
দীপ্তি খুব চেষ্টা করতে লাগলেন কাকলী বেগমের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করার। পারছিলেন না। আবুল বাশারের ছুটি শেষ হলো। তিনি এলেন।
বস বললেন, আবুল বাশার, আপনার চাকরি তো নড়বড়ে। আপনি দেখেন, কাকলীকে পান কি না।
আবুল বাশারের পারঙ্গমতা বেশি। তিনি কাকলীকে রাজি করালেন অফিসে আসতে। তখন ঠিক করা হবে কাকলী কী কী করবেন। কত টাকা অগ্রিম নেবেন।
কাকলী আসবেন বৃহস্পতিবার।
বুধবার বাদল চৌধুরী ডাকলেন আবুল বাশারকে। আবুল বাশার, কালকে আমি অফিসে কী পরে আসব বলেন তো!
স্যার, আপনি স্যুট পরে আসেন। লাল রঙের টাই।
এই গরমের মধ্যে?
সব বড়লোক গরমের মধ্যেও টাই পরেন স্যার।
রাইট।
ফেশিয়াল করব নাকি আজকে?
অবশ্যই স্যার।
পরের দিন, বৃহস্পতিবার সকাল সকাল, গ্রীষ্মের গরমে ঘামতে ঘামতে স্যুট–টাই পরা বাদল চৌধুরী অফিসে এসে হাজির।
তিনি আয়নার সামনে দাঁড়ালেন নিজের বাথরুমে। ভালোই দেখা যাচ্ছে। তিনি হেসে ফেললেন।
অমনি তাঁর দাঁত বেরিয়ে গেল। দাঁত কালো কুচকুচে। পান খাওয়া দাঁত।
তিনি ডাকলেন আবুল বাশারকে। আবুল বাশার, দেখুন তো আমার দাঁত কি ঠিক আছে?
আপনি বলুন স্যার।
ঠিক নাই।
জি স্যার, ঠিক নাই।
এটা ঠিক করতে হবে।
অবশ্যই।
কীভাবে এখনই ঠিক করা যায়?
ডেন্টিস্টের কাছে যান স্যার।
সময় কই। খানিকক্ষণ পরেই তো কাকলী চলে আসবেন।
জি স্যার।
এই সময় তাঁর সামনে হারপিকের ডিজাইন নিয়ে এল মাকসুদ। বলল, স্যার, এইটা ১০ ফিট বাই ৬ ফিট প্রিন্ট দিচ্ছি। যাত্রাবাড়ীতে লাগবে।
বাদল চৌধুরী বললেন, দ্য আইডিয়া।
আবুল বাশার আর মাকসুদ বললেন, দ্য আইডিয়া।
পেয়ে গেছি।
দুজনে বললেন, স্যার পেয়ে গেছেন।
কী পেয়েছি?
স্যার, বললেই বুঝব স্যার।
হারপিক। হারপিক বাথরুমের পুরোনো কালো দাগও দূর করে। মাত্র ১০ মিনিটে। করে কি না বলেন?
করে স্যার।
আমি হারপিক দিয়ে দাঁত মাজব। দুই মিনিট। ব্যস। সব দাগ চলে যাবে। যাবে কি না বলেন?
আপনি যখন বলছেন, অবশ্যই যাবে স্যার।
মাকসুদ আপত্তি করছিল। আবুল বাশার তাকে মোবাইলের ফেসবুকে লেখা আপন স্ট্যাটাসটা পাঠিয়ে দিলেন ইনবক্সে। তাতে লেখা—রুল নম্বর ১.
বস বাদল চৌধুরী ড্রয়ার থেকে ব্রাশ বের করে টয়লেটে ঢুকলেন। হারপিক ওখানেই রাখা। দাঁত মাজলেন আরাম করে। সত্যি দাঁত পরিষ্কার ঝকঝকে হয়ে গেল।
তিনি হাসতে হাসতে নিজের টেবিলে ফিরলেন।
বললেন, একটু একটু জ্বালা করছে। তবে কষ্ট ছাড়া কি কেষ্ট মেলে?
মিনিট দশেকও যায়নি। বাদল চৌধুরীর মুখ, জিব, গাল সব ফুলে উঠতে লাগল। তার মুখ ইনক্রেডিবল হাকের মতো ফুলে যাচ্ছে। তাঁর শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে আসছে।
এই সময় এলেন কাকলী। এই চেহারার একজন মানুষকে দেখে তিনি বললেন, হু ইজ দিস ম্যানিমাল?
আবুল বাশার বললেন, ম্যানিমাল?
মানুষের দেহ, অ্যানিমালের মুখ। হি ইজ আ ডেমন।
কাকলী চলে গেলেন। বাদল চৌধুরীকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। বার্ন ইউনিটে। সেখানে তিনি থাকলেন ১৮ দিন।
১৮ দিন পর তিনি অফিসে আসতে লাগলেন। এক মাস পর অফিস ছুটি দিয়ে তিনি অফিসে দাওয়াত করলেন পেশাদার একজন এস্কর্টকে। অ্যাডাল্টসাইটে ছবি দেখে তিনি একে পছন্দ করেছেন। এক সন্ধ্যা দুজনে রেড ওয়াইন খাবেন। মহিলা নেবেন ১১ হাজার টাকা। ক্যাশ। অগ্রিম।
কিন্তু বাদল চৌধুরী মদ পাবেন কোথায়? এর আগে তিনি এসবের মধ্যে কখনো যাননি।
আবুল বাশার, ভালো রেড ওয়াইন কোথায় পাওয়া যায় জানেন?
না স্যার। দেশে তো এখন অলমোস্ট আয়রন রুল। সব লিকার উধাও হয়ে গেছে। এখন মদ খাবেন না স্যার। আপনার কোনো বন্ধু যদি বিদেশ থেকে ডিউটি ফ্রি ব্যাগে করে হাতে নিয়ে মদ আনে, কেবল সেইটা খেতে পারেন। বাকি সব স্পিরিট। খেলেই মারা পড়বেন। ওই যে স্যার হাইকোর্টের উকিল তরফদার, উনি তো ঢাকার দামি ক্লাবে বসে মদ খেয়ে সাত দিন অজ্ঞান ছিলেন। পরে ওনার একপাশ অবশ হয়ে গেছে।
আপনি কিচ্ছু জানেন না?
জি স্যার।
জি স্যার কী?
কিচ্ছু জানি না।
ওই মেয়েকে যদি ৫ হাজার বাড়িয়ে দিই, সে নিজে রেড ওয়াইন আনতে পারবে না?
আপনি যা বলেন স্যার।
অবশ্যই পারবে।
তাহলে তো পারবেই স্যার।
ঠিক আছে। আমিই ওকে বলে দিচ্ছি। আপনারা সবাই অফিস খালি করে ৫টার মধ্যে চলে যাবেন।
অবশ্যই স্যার।
তাই হলো। অফিস ফাঁকা। ওই মহিলা এলেন। সঙ্গে পানীয়।
তারপরের কাহিনি কহতব্য নয়।
বাদল চৌধুরী জ্ঞান হারালেন। ভদ্রমহিলা তাঁকে জন্মদিনের পোশাকে সাজালেন। তাঁর ছবি তুললেন। তারপর অফিসের মূল্যবান ছোটখাটো জিনিসপাতি, বাদল চৌধুরীর ওয়ালেট, ক্রেডিট কার্ড এবং দুই দুইটা মোবাইল ফোন নিয়ে কেটে পড়লেন।
নাইটগার্ড রাত ১১টায় মুমূর্ষু বাদল চৌধুরীকে একটা চাদরে ঢেকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
তিন দিন পর তাঁর জ্ঞান হলো।
একদিন আবুল বাশারের মোবাইলে ছবি এল হোয়াটসঅ্যাপে। বাদল চৌধুরীর কাপড়ছাড়া ছবি। লেখা, স্যার আমার ফোন ধরছেন না। তাঁকে বলবেন, কিছু টাকা পাঠাতে।
আবুল বাশার গেল তার স্যারের কাছে। স্যার, এই মেয়ে তো ডেঞ্জারাস। একে পুলিশে দিতে হবে। দেখেন কী ছবি পাঠিয়েছে?
সর্বনাশ।
স্যার। আমার প্রমোশনটা ডিউ হয়ে আছে। আপনি কালপরশু একটু দেখেন। আপনি না দেখলে গরিব মানুষ স্যার মারা পড়ব। তবে আমার বন্ধু আছে সাইবার সিকিউরিটিতে। এই মেয়ে এই ছবি তো ডিলিট করবেই, এর পাখা আমি কেটে দেব। জানেনই তো পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।
পারবেন আপনি?
আপনি শুধু বলে দেখেন স্যার পারি কি না। বস ইজ অলওয়েজ রাইট স্যার। আপনার জীবনে কোনো ভুল নাই। থাকতে পারে না।
বলছ?
জি স্যার।
আমি রাইট?
ইয়েস স্যার।
আবুল বাশার সত্যি সত্যি কেঁচো খুঁড়ে অজগর সাপ ধরার ব্যবস্থা করলেন। ওই এস্কর্টের পেছনে ছিল দুর্ধর্ষ গ্যাং। তাঁরা সবাই ধরা পড়ল।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব দল চ ধ র ক ব দল চ ধ র র স য র আম র ড জ ইন অফ স র র অফ স ন ক কল আম দ র বলল ন আইড য় ত রপর আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ