হরমুজ প্রণালি কী, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান কি তার ‘ট্রাম্প কার্ড’ ব্যবহার করবে
Published: 15th, June 2025 GMT
বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি রপ্তানি পথ হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি বিবেচনা করছে ইরান, দেশটির এক আইনপ্রণেতার এমন মন্তব্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ইরান সত্যিই প্রণালিটি বন্ধ করলে বিশ্বজুড়ে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হতে পারে।
ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান সংঘাতের মধ্যে প্রভাবশালী আইনপ্রণেতা ইসমাইল কোসারি ইরানি বার্তা সংস্থা আইআরআইএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে শুধু জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কৌশলগত জলপথটি কী ও কেনই-বা তা বিশ্ববাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে জানা যাক:
হরমুজ প্রণালি কোথায়হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগরে যাওয়ার একমাত্র সামুদ্রিক প্রবেশপথ। এর এক পাশে ইরান, অন্য পাশে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের মোট জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ এ পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। সংস্থাটি একে ‘বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথ’ বলে বর্ণনা করেছে।এ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে, প্রণালিটি পারস্য উপসাগরকে সরাসরি ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে এবং সেই পথ ধরে জাহাজগুলো আরব সাগরে তথা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণযুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের মোট জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ এ পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। সংস্থাটি একে ‘বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথ’ বলে বর্ণনা করেছে।
প্রণালিটির সবচেয়ে সরু অংশ ৩৩ কিলোমিটার (২১ মাইল) চওড়া। তবে এর মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচলের পথটি আরও সরু, যা যেকোনো সময় হামলা বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
আরও পড়ুনইরানে হামলা নিয়ে ট্রাম্প শিবিরে বিভক্তি, যুক্তরাষ্ট্রও কি সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে২ ঘণ্টা আগেঅতীতে কী ঘটেছিল১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চলা ইরান-ইরাক যুদ্ধে উভয় পক্ষই উপসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছিল। তখন এ সংঘাত ‘ট্যাংকার যুদ্ধ’ নামে পরিচিতি পায়। তবে হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি কখনো বন্ধ হয়নি। যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হন।
হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা মানে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পকেটে চাপ দেওয়া। আবার এর জবাবে ট্রাম্প প্রশাসনও সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধের পদক্ষেপ এখনই না নিলেও কোসারির মন্তব্যে বোঝা যায়, জাহাজ চলাচলের পথে হামলার হুমকি দিয়ে নিজেদের কূটনীতিতে তাস খেলতে চাইছে তারা।সাম্প্রতিক কালে ২০১৯ সালে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনার সময় আরব আমিরাতের ফুজাইরাহ উপকূলে হরমুজের কাছাকাছি চারটি জাহাজে হামলা হয়। ওয়াশিংটন এ ঘটনায় তেহরানকে দায়ী করলেও ইরান তা অস্বীকার করে।
চলমান উত্তেজনায় নতুন শঙ্কাযুদ্ধ বা সংঘাতে জাহাজ চলাচলের পথে হামলা করাটা দীর্ঘদিনের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলা। যেমন ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা বাব আল-মানদেব প্রণালির কাছে বিভিন্ন জাহাজে হামলা চালাচ্ছে। এটি আরব উপদ্বীপের অন্য প্রান্তে লোহিত সাগরে প্রবেশের পথ।
যদিও হুতিদের ওই হামলায় বিশ্ববাণিজ্যে প্রভাব পড়েছে, তবে লোহিত সাগর এড়িয়ে আফ্রিকা ঘুরে বিকল্প পথে জাহাজগুলোর চলাচল সম্ভব হচ্ছে। পথটি দীর্ঘ হলেও নিরাপদ।
কিন্তু পারস্য উপসাগর থেকে সাগরপথে কিছু রপ্তানি করতে হলে হরমুজ প্রণালি ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এ কারণে এটি বন্ধ হলে পুরো বিশ্ববাজারেই তেলের ঘাটতি দেখা দেবে, যা মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে প্রভাব ফেলবে এমন সব রাষ্ট্রেও, যারা উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে তেল আমদানি করে না।
আরও পড়ুনইরান–ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা রূপ নিতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে১২ ঘণ্টা আগেহরমুজ বন্ধ করা কি ইরানের পক্ষে সম্ভবইরানের আইনপ্রণেতা কোসারির ওই হুমকির পরও হরমুজ বন্ধ করার সক্ষমতা বা রাজনৈতিক ইচ্ছা আদৌ ইরানের আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত বলে মনে করা হচ্ছে। ওয়াশিংটনের সামরিক নৌবহর এ অঞ্চলে আগে থেকেই অবস্থান করছে।
কয়েক দিন ধরে ইসরায়েল ইরানে যে দফায় দফায় হামলা চালাচ্ছ, তার লক্ষ্য—সেনাঘাঁটি, বসতি এলাকা, এমনকি পারমাণবিক স্থাপনা। জবাবে ইরানও শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে ইসরায়েলকে সহায়তা করছে। তবে তারা সরাসরি ইরানে হামলা চালায়নি ও ইসরায়েলি হামলায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়েছে। একইভাবে ইরান এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সেনা বা স্বার্থে সরাসরি আঘাত করেনি।
অর্থনৈতিক চাপ ও রাজনৈতিক বার্তা
হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা মানে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পকেটে চাপ দেওয়া। আবার এর জবাবে ট্রাম্প প্রশাসনও সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধের পদক্ষেপ এখনই না নিলেও কোসারির মন্তব্যে বোঝা যায়, জাহাজ চলাচলের পথে হামলার হুমকি দিয়ে নিজেদের কূটনীতিতে তাস খেলতে চাইছে তারা।
আরও পড়ুনকয়েক দশকের ছায়া যুদ্ধ থেকে এবার প্রকাশ্য সংঘাতে ইসরায়েল ও ইরান১৩ জুন ২০২৫সম্প্রতি কী ঘটেছে২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইরান হরমুজ প্রণালির কাছাকাছি একটি কনটেইনার জাহাজ জব্দ করে। এর আগে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের এক হামলায় এ অঞ্চলে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ উত্তেজনা চলার মধ্যে সীমিত পরিসরে ইসরায়েলে হামলা চালায় ইরান।
পরে ইসরায়েলও ইরানে পাল্টা হামলা চালায়। সাম্প্রতিক কালে চিরবৈরী দেশ দুটির মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও ভয়ানক সামরিক সংঘাত।
আরও পড়ুনইরান ও ইসরায়েল: আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় কে এগিয়ে১৩ জুন ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র জ ইসর য় ল র সবচ য়
এছাড়াও পড়ুন:
ফেব্রুয়ারিতে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার প্রধান উপদেষ্টার
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আজ বুধবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য (এমইপি) মুনির সাতোরির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
প্রতিনিধিদলকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করেছি। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ফেব্রুয়ারির শুরুতে, রমজানের ঠিক আগে।’ তিনি উল্লেখ করেন, জনসাধারণ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে নির্বাচনী উৎসাহ বাড়ছে। কারণ, দীর্ঘদিন পর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দশকের বেশি সময় পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন আবার শুরু হয়েছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও উৎসবমুখর।’ তিনি বলেন, কিছু শক্তি এখনো নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে, তবে অন্তর্বর্তী সরকার নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, তরুণ ভোটাররা এবার রেকর্ড সংখ্যায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। কারণ, ১৫ বছরের বেশি সময় পর অনেকেই প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন। তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সূচনা বয়ে আনবে। এটি আমাদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে—জাতির জন্য এক নতুন যাত্রা।’
ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা ও ইউরোপীয় আইনপ্রণেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অব্যাহত সমর্থন ও চলমান রোহিঙ্গা মানবিক সংকট নিয়ে মতবিনিময় করেন।
আগামী নির্বাচন বাংলাদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন ইউরোপীয় আইনপ্রণেতারা। এক আইনপ্রণেতা প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সরকারের গত ১৪ মাসের ‘অসাধারণ’ প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।
এক ডাচ আইনপ্রণেতা মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ কতিপয় দেশের মধ্যে অন্যতম, যেখানে ‘ঘটনাগুলো সঠিক পথে এগোচ্ছে।’
প্রধান উপদেষ্টা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য বাড়তি তহবিল প্রদানের আহ্বান জানান।
বিশেষ করে সম্প্রতি অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্কুলগুলো আবার চালু করতে সহায়তা প্রদানের অনুরোধ জানান প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ শ্রম সংস্কারগুলো তুলে ধরে বলেন, এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশ–ইইউ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।