জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে কিছু রাজনৈতিক দলের বিরোধিতাকে ‘রহস্যজনক’ মনে করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটি বলছে, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হলে সংস্কারের জন্য প্রয়োজনে গণভোটে যেতে হবে।

আজ বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় দিনের বৈঠক শেষে মৌলিক সংস্কার বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের অবস্থান তুলে ধরেন দলের যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বেলা সাড়ে ১১টায় এ বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে ইসলামী আন্দোলনের দুই যুগ্ম মহাসচিব অংশ নেন। তাঁরা হলেন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ও যুগ্ম মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর এক ব্রিফিংয়ে গাজী আতাউর রহমান বলেন, দেশকে আগামীর যেকোনো স্বৈরতন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করা জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান দাবি। আগামী দিনে আর কোনো স্বৈরাচার যাতে জেঁকে বসতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার হতেই হবে। এতে যদি কোনো রাজনৈতিক দল দ্বিমত করে বা রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমত না হয়, তাহলে এ ধরনের মৌলিক সংস্কারের জন্য গণভোটে যেতে হবে।

গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আজকের বৈঠকে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেছি, কিছু রাজনৈতিক সংগঠন, যারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ও শক্তিশালীকরণের কথা বলত এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপরে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ বন্ধের কথা বলত, তারাও আজ এনসিসি (জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল) গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। কেউ কেউ বলতে চাইছেন, এটা এখন গঠন না করে পরে গঠন করা যেতে পারে। বিশেষ করে বামপন্থী কিছু সংগঠন এমন অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছে।’

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারই শুধু নয়, বরং স্বাধীনতার পরে অতীতের সব সরকারই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত ও দলীয়করণ করেছে বলে অভিযোগ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এই মুখপাত্র। তাঁর মতে, যারা দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে অনাগ্রহী, তারাই কেবল এনসিসি নিয়ে দ্বিমত করতে পারে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

সংবিধান সংস্কারে জগাখিচুড়ির গণভোট

জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেই সুপারিশ ঐকমত্য কমিশন থেকে পাওয়া গেছে। এই সনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো। কারণ, সব কটি সংস্কার প্রস্তাবের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত হতে পারেনি। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর কমিশন যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার অধিকাংশগুলোতেই রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ ভিন্নমত আছে। সেই ভিন্নমতসহ রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করেছে।

আমরা জানি যে গণভোটের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এই সনদ বাস্তবায়ন হবে বা গণভোটের প্রশ্ন কী হবে (জনগণ কোন প্রশ্নের ওপর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেবে), তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে তা পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এই যৌক্তিক প্রশ্নও উঠছে যে কমিশনের প্রস্তাব দেশের রাজনীতিতে নতুন সংকটের সূচনা করল না তো?

ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে গণভোটের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নটি পাওয়া গেছে। প্রশ্নটি এ রকম; ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই প্রশ্ন থেকে ‘খসড়া বিলের’ শব্দ দুটি প্রয়োজনে বাদও দেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে ভিন্নমত যুক্ত হয়েছিল, গণভোটে তা বিবেচনায় না নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। মানে জুলাই সনদের পক্ষে যদি জনগণ ভোট দেন, তবে ভিন্নমতগুলো আর বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।

গণভোটের যে প্রশ্নটি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের সব মানুষ সংবিধান সংস্কারের ৪৮টি প্রস্তাব যথাযথভাবে জেনেবুঝে ভোট দেবেন, এমন না–ও হতে পারে। আর কেউ যদি প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে জেনেবুঝেও থাকেন, তা–ও দেখা যাবে একজন ভোটার হয়তো কিছু সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত আর কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে নয়। এতগুলো সংস্কার প্রস্তাব আসলে শুধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’–এর বিষয় নয়। দেখা যাচ্ছে, আপনাকে হয় ৪৮টি প্রশ্নের সবগুলোর সঙ্গে একমত হতে হবে অথবা সবগুলোকেই না বলতে হবে। গণভোটের প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে এসব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয় না। ঐকমত্য কমিশন হয়তো তাদের করা সংস্কার প্রস্তাবগুলোর পক্ষে বৈধতা আদায় করতে চেয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদ গণভোটে পাস করার চেয়ে গণভোটের মাধ্যমে আগামী সংসদকে জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়াই হতো সবচেয়ে যৌক্তিক। গণভোটের প্রশ্নটি সেভাবে সাজানো যেত।

৮ অক্টোবর প্রথম আলোয় ‘গণভোট অপ্রয়োজনীয়, তবে এরপরও যদি হয়…’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। সেখানে বাংলাদেশের আগের তিনটি গণভোটের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের কোনো প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেছিলাম। রাজনৈতিক দলগুলো এর আগেই গণভোটের ব্যাপারে একমত হয়ে গেছে। তাই ‘এরপরও যদি হয়...’ যুক্ত করে কিছু কথা বলেছিলাম। ‘গণভোটটি হওয়া উচিত জুলাই সনদের যে বিষয়গুলোয় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, তার ওপর এবং একটি প্রশ্নের ভিত্তিতে।’

আরও লিখেছিলাম, ‘সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত নিয়ে গণভোটের কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর এসব ভিন্নমতকে দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে দেখতে হবে। এসব বিবেচনায় নিয়েই জনগণ তাঁর দল বাছাই করবেন। নির্বাচিত দল তার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বিবেচনায় নিয়ে সংবিধান সংশোধন করবে। কারণ, কোনো দলের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া মানে তার অবস্থানের পক্ষেই জনগণ সমর্থন জানিয়েছে।’

জুলাই সনদে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব আছে ৪৮টি। এর মধ্যে না হলেও ৩৬টি প্রস্তাব নিয়ে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত আছে। জুলাই সনদে সেই ভিন্নমতগুলো যুক্ত করে এটা নিশ্চিত করা হয়েছিল যে কোনো রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ভিন্নমতগুলো উল্লেখ করে যদি জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়, তবে তারা তাদের মতো করে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ায় শুধু সংস্কার প্রস্তাবগুলোই আছে। আদেশ অনুযায়ী নির্বাচনের পর সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংবিধান সংস্কার পরিষদকে ‘তফসিল ১–এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ’ অনুসারে সংবিধান সংস্কার করতে হবে।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, কিছু দলের নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও সনদ গণভোটে অনুমোদিত হলে সেভাবেই কার্যকর হবে। এর অর্থ দাঁড়ায় গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জিতে গেলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে।

ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের যে বিষয়গুলোতে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে তার ওপর গণভোট হচ্ছে না। আবার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগও থাকছে না। গণভোটের ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশনের এমন সুপারিশ নিয়ে প্রথম যে প্রশ্ন তোলা যায়, তা হচ্ছে ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর বিষয়গুলো যদি বিবেচনায় নেওয়ার কোনো সুযোগ না থাকে, তবে জুলাই সনদে তা যুক্ত করা হয়েছিল কোন যুক্তিতে?

সংবিধান সংশোধনের কোনো ইস্যুতে জোরালো আপত্তি আছে এবং সেই ইস্যুতে ভিন্নমত জানানো কোনো দল যদি জাতীয় নির্বাচনে জিতে আসে, সেই দলটিকে কি পুরো সনদ বাস্তবায়নে আদৌ বাধ্য করা যাবে? দলটি তো বলতে পারে যে সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে দলের অবস্থান জাতীয় নির্বাচনের আগেই তারা পরিষ্কার করেছে। জনগণ যদি সেই দলকেই নির্বাচিত করে, তাহলে তারা কেন তাদের ঘোষিত অবস্থান অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করার সুযোগ পাবে না?

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন বা প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে পারবেন না—সংবিধানের এমন সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির জোরালো আপত্তি আছে। বিএনপির এই অবস্থানকে অযৌক্তিক এবং সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। কিন্তু ভালো মন্দ যাই হোক এটা দলটির অবস্থান এবং এর ব্যাপারে জুলাই সনদে তাদের ভিন্নমতের কথা লেখা আছে। এখন গণভোটে জুলাই সনদ পাস হলে এবং বিএনপি ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জিতে গেলে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলটিকে এই সংশোধনী দুটি করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা কি আদৌ নিশ্চিত করা সম্ভব?

অন্যদিকে বিএনপি যদি জাতীয় নির্বাচনে জিতে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয় এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে না চায়, তখন গণভোটে বিএনপি এবং এর সমর্থকদের অবস্থান কী হবে? তারা কি জুলাই সনদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে? গণভোট নিয়ে রাজনীতিতে এরই মধ্যে বিভক্তি ও অনৈক্যের সুর বেজে উঠতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে জনমনেও তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি।

আগের লেখায় লিখেছিলাম গণভোট অপ্রয়োজনীয়। সঙ্গে এটাও লিখেছিলাম, ‘গণভোট যদি করতেই হয়, তবে তা হওয়া উচিত জাতীয় নির্বাচনের পর। নির্বাচিত সরকার সংসদে গিয়ে জুলাই সনদের সব দলের একমত হওয়া বিষয় এবং নিজ দলের নোট অব ডিসেন্টের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করে তা রাষ্ট্রপতির সইয়ের জন্য পাঠানোর আগে একটি গণভোট আয়োজন করতে পারে।’

ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলসহ সমাজের নানা পক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খরচ ও পরিশ্রম করে যে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করেছে, তা মনে হচ্ছে গণভোট ইস্যুতে এসে হোঁচট খেতে যাচ্ছে। গণভোটের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত ফলদায়ক কিছু হবে বলে মনে হয় না। বরং জগাখিচুড়ি ধরনের সমাধানের চেষ্টা হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে।

গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ যত বাড়বে, গণভোটের ব্যাপারে মানুষ আগ্রহ হারাবে। এ ধরনের গণভোটে এমনিতেই উপস্থিতির হার খুব কম থাকে, কোনো রাজনৈতিক পক্ষের বর্জনের ডাক পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করে তুলতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘অগ্রহণযোগ্য’ একটি গণভোট জুলাই গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। বাধাগ্রস্ত হতে পারে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ।

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেশের মানুষ ১৭ বছর ধরে নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে: সাইফুল হক
  • জুলাই সনদে সই না করা অংশের দায় নেব না: মির্জা ফখরুল
  • ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে ‘অশ্বডিম্ব’ বললেন সিপিবি সভাপতি
  • যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়াতে সম্মত হয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান: তুরস্ক
  • গণভোটের রায়ে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায় জামায়াত 
  • সংবিধান সংস্কারে জগাখিচুড়ির গণভোট
  • ভোটারদের মনে আস্থা তৈরি করা সরকারের দায়িত্ব