‘আমার স্বামী যখন ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তখন আমি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বর্তমানে ছয় মাসের মেয়েই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে মেয়ের নাম রাখা হয়েছে সাবরিনা বিনতে সিদ্দিক। আমার স্বামী দেশের মানুষের বৈষম্য দূর করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন, আমি ও আমার সন্তান যেন বৈষম্যের শিকার না হই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সমকালকে কথাগুলো বলছিলেন সাদিয়া খাতুন।
গত বছরের ২০ জুলাই ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন নূরে আলম সিদ্দিক। এ ঘটনার মাত্র ছয় মাস আগে ১২ জানুয়ারি তাদের বিয়ে হয়। নিজ বাড়ি গৌরীপুর উপজেলায় হলেও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কোনাপাড়া মাদ্রাসায় চাকরি করতেন সিদ্দিক। এই এলাকায় চাকরির সুবাদে বিয়ে করেন সাদিয়া খাতুনকে। স্বামীর স্মৃতি কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না তিনি।
সাদিয়া বলেন, সারাদেশে আন্দোলন যখন শুরু হচ্ছে, তার প্রথম দিন থেকেই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল নূরে আলম সিদ্দিকীর। ১৮ ও ১৯ জুলাই আন্দোলনে যাওয়ার পর ভয় ঢুকে যায় মনে। এর ঠিক পরদিন গৌরীপুরের কলতাপাড়ায় আন্দোলনে অংশ নিলে পুলিশ সদস্যরা কাছ থেকে গুলি করে মেরে ফেলে তাঁকে। ওইদিন তাঁর সঙ্গে আরও দু’জন শহীদ হন।
স্বামী নিহত হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে চলে আসেন সাদিয়া। বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। বাবা ও ভাই কোনো রকম উপার্জন করে চালিয়ে নিচ্ছেন। তাদের খোঁজখবর নেন না শ্বশুর-শাশুড়ি। সরকারি যা সহযোগিতা করা হয়েছে, তার অধিকাংশ টাকা তারা নিয়ে গেছেন বলে দাবি সাদিয়ার। তিনি বলেন, ‘সন্তান জন্মদানের জন্য আমি যখন হাসপাতালে ভর্তি, তখন জুলাই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা দেয় সরকার। আমি ভেবেছিলাম আমার শ্বশুরের কাছে সরকার সরাসরি টাকা দিলেও আমার সন্তানের জন্য কিছু টাকা দেবেন। পরে তারা আমাকে কিছুই দেননি।’
জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকেও আন্দোলনে নিহতদের অনেক আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১ টাকাও পাননি বলে জানান সাদিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আজ যদি আমার স্বামী থাকত, তাহলে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এসব কথা শুনতে পেয়ে সাদিয়া খাতুনের পাশে দাঁড়ান। সর্বশেষ জেলা পরিষদ থেকে অনুদানের ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার চেক তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে। সাদিয়ার দাবি, শহীদ পরিবারকে সঞ্চয়পত্রের ১০ লাখ টাকা যেন প্রকৃত ওয়ারিশ শনাক্ত করে বণ্টন করে দেওয়া হয়। এই টাকা যদি তাঁর সন্তান না পায়, তবে তাঁকে ভরণপোষণ করা কঠিন হয়ে যাবে।
সাদিয়ার ভাই মাহমুদুল হাসান শামীম বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন। নিজের সংসারের খরচ জোগানোর আগে স্বামীহারা বোনের কথা চিন্তা করেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, সরকার যেন প্রতিটি শহীদের পরিবারের দায়িত্ব নেয়। প্রশাসনের প্রতি তাঁর আহ্বান, ‘যাদের কারণে আপনারা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছেন, তাদের যেন স্মরণে রাখেন।’
বিচার দেখে যেতে চান শহীদ বিপ্লবের বাবা
গৌরীপুরের কলতাপাড়া বাজারের বাসিন্দা বাবুল মিয়া। ২০ জুলাই বাড়ির পাশে আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে মারা যান তাঁর ছেলে বিপ্লব হাসান। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে আছেন তিনি। ছেলে হত্যার বিচার দেখে যাওয়াই তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা। উপজেলা সদরে ছোট একটি চাকরি করতেন বিপ্লব হাসান। ঘটনার দিন সকালে নাশতা খাওয়ার জন্য মায়ের কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে ঘর থেকে বের হন তিনি। এরপর ফেরেন লাশ হয়ে। পরে বাবুল মিয়া ছেলে হত্যার ঘটনায় ১১ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সদস্য সচিব মোহাম্মদ আল নূর আয়াশ জানান, জুলাই আন্দোলনে ময়মনসিংহ জেলার ৪১ জন বাসিন্দা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শহীদ হয়েছেন। সরকার এখন পর্যন্ত তাদের আশানুরূপ আর্থিক সহযোগিতা করতে পারেনি। শহীদ পরিবারের প্রতিটি সদস্য যাতে সচ্ছলভাবে চলতে পারেন, সে ব্যাপারে কাজ করছেন তারা।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অভ য ত থ ন আম র স সরক র উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পের বহুল আলোচিত বিগ বিউটিফুল বিলে কী আছে

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ গতকাল বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নতুন কর ও ব্যয় বিল (ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল নামে পরিচিত) পাস করেছে। এর আগে গত মঙ্গলবার বিলটি উচ্চকক্ষ সিনেটেও মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে পাস হয়। বিলটির পক্ষে–বিপক্ষে সমানসংখ্যক ভোট পড়ায় রিপাবলিকান সিনেটর ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স টাইব্রেকিং ভোট দেন।

প্রসঙ্গত, প্রতিনিধি পরিষদে ২১৮-২১৪ ভোটের ব্যবধানে বিলটি পাস হয়েছে। পরে এতে সই করেন স্পিকার মাইক জনসন। আলোচিত বিলটি কংগ্রেসে পাস হওয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য বড় জয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিলটি নিয়ে ট্রাম্পের নিজ দলেও প্রবল বিরোধিতা ছিল। শেষ পর্যন্ত বিলটি পাস হওয়ায় রিপাবলিকান পার্টির জ্যেষ্ঠ সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এখন তিনি সই করলেই বিলটি আইনে পরিণত হবে।

বহুল আলোচিত এই বিলে কী আছে? ট্রাম্পের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় থাকা বিলটির চূড়ান্ত খসড়া থেকে জেনে নেওয়া যাক মূল বিষয়গুলো:

স্থায়ী হচ্ছে বড় করছাড়

প্রথম মেয়াদে ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প ‘ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন পাস করেন। এটি কর হ্রাস করে ও করদাতাদের জন্য আয়কর থেকে ছাড় (স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন) বাড়ায়। যদিও এর সুবিধা উচ্চ আয়ের মানুষরাই বেশি পান। সুবিধা চলতি বছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালের পর বাতিল হওয়ার কথা ছিল। তবে নতুন বিল এটি স্থায়ী করছে।

এ ছাড়া ২০২৮ সাল পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন আরও বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড় ব্যক্তি করদাতাদের জন্য ১ হাজার ডলার, পরিবারপ্রধান (হেড অব হাউসহোল্ড) হলে ১ হাজার ৫০০ ডলার ও দম্পতিদের জন্য ২ হাজার ডলার।

ওভারটাইম ও টিপসের ওপর করছাড়

এই বিলের আওতায় নতুন কিছু ক্ষেত্রে করছাড় যুক্ত হচ্ছে। তবে সেগুলো শুধু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা পর্যন্তই বহাল থাকবে। তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, এবার টিপস ও ওভারটাইম আয়ের ওপর করছাড় দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি গাড়ি কেনার জন্য নেওয়া ঋণের সুদও কর থেকে ছাড় পাবে।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের তাড়াতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট’ সংস্থাকে ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলার দেওয়া হচ্ছে বন্দিশিবির পরিচালনার জন্য।

৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য অতিরিক্ত ছয় হাজার ডলার করছাড় রাখা হয়েছে। তবে এমন বয়সীদের একক আয় ৭৫ হাজার ডলারের বেশি বা যৌথভাবে দেড় লাখ ডলারের বেশি হলে এ ছাড় প্রযোজ্য হবে না। এসব ছাড় ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট মেয়াদের শেষ বছর, অর্থাৎ ২০২৮ সালের শেষে উঠে যাবে।

অভিবাসী বহিষ্কারে বিপুল বরাদ্দ, সীমান্তে নতুন দেয়াল

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের তাড়াতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট’ (আইস) সংস্থাকে ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলার দেওয়া হচ্ছে বন্দিশিবির পরিচালনার জন্য। এসব অভিবাসীদের বহিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনায় আরও ১৪ বিলিয়ন (১ হাজার ৪০০ কোটি) ডলার ও ২০২৯ সালের মধ্যে নতুন ১০ হাজার এজেন্ট নিয়োগে কয়েক বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া মেক্সিকো সীমান্ত বরাবর নতুন প্রতিরক্ষাকাঠামো তৈরিতে ৫০ বিলিয়ন (৫ হাজার কোটি) ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দেয়াল নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

কমছে মেডিকেইড ও খাদ্যসহায়তা

নতুন বিলের ব্যয় কমাতে রিপাবলিকানরা যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রধান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাজেটে ছাঁটাই করেছেন। এ দুটি কর্মসূচি হলো ‘মেডিকেইড’ (দরিদ্র ও প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা) ও ‘সাপ্লিমেন্টাল নিউট্রিশন অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম’ বা স্ন্যাপ (খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি)।

দুটি ক্ষেত্রেই বাজেট কমানোর পাশাপাশি নতুন কাজের শর্তও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি প্রায়োরিটিজ’–এর হিসাবে, এসব পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা হারাতে পারেন এবং প্রতি পাঁচ স্ন্যাপ গ্রহীতার একজন, অর্থাৎ ৮০ লাখ মানুষ খাদ্যসহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

বাতিল হচ্ছে সবুজ জ্বালানির কর–সুবিধা

জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকার সময় পরিবেশবান্ধব যানবাহন ও প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহ দিতে যে কর–সুবিধা চালু হয়েছিল, ট্রাম্পের নতুন বিলে তার অনেকটাই তুলে নেওয়া হচ্ছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির করছাড় এ বছরই শেষ হবে। বাড়িঘরের উন্নয়নে পরিবেশবান্ধব বা বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি কিনতে যে ভর্তুকি পাওয়া যেত, তা–ও বাদ দেওয়া হচ্ছে।

বিলে শুরুতে উইন্ড ও সোলার প্রজেক্টের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপের প্রস্তাব ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিনেট সদস্যরা তা বাতিল করেছেন।

‘মেডিকেইড’ ও ‘স্ন্যাপ’ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা হারাতে পারেন এবং প্রতি পাঁচ স্ন্যাপ গ্রহীতার একজন, অর্থাৎ ৮০ লাখ মানুষ খাদ্যসহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় করছাড় (সাল্ট)

স্টেট অ্যান্ড লোকাল ট্যাক্স বা ‘সাল্ট’–এ করছাড় কতটা দেওয়া হবে, তা বিলের অন্যতম বিতর্কিত বিষয়। অনেক মার্কিনকে ফেডারেল ট্যাক্সের পাশাপাশি নিজ নিজ অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় ট্যাক্সও দিতে হয়। ডেমোক্র্যাট-শাসিত অঙ্গরাজ্যগুলোর কয়েকজন রিপাবলিকান প্রতিনিধি সাল্টে করছাড়ের সীমা ১০ হাজার ডলার থেকে বাড়িয়ে ৪০ হাজার ডলার না করা পর্যন্ত বিলে নিজেদের সমর্থন দেননি। প্রতিনিধি পরিষদে এ দাবি মানা হলেও সিনেটের রিপাবলিকানরা জানিয়েছেন, এটি সাময়িক ব্যবস্থা।

সিনেটের পদক্ষেপ অনুযায়ী, ২০২৮ সাল পর্যন্ত সাল্টে ছাড়ের সর্বোচ্চ সীমা ৪০ হাজার ডলার থাকবে।

বিল পাস হওয়ার পর প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসনসহ রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের উচ্ছ্বাস

সম্পর্কিত নিবন্ধ