চট্টগ্রামে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। আক্রান্তদের অনেকে ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। বাসায় থেকে কেউ কেউ এক থেকে দুই সপ্তাহ ধরে নিচ্ছেন চিকিৎসা। জুলাই মাসের শুরু থেকেই ভয়ংকর হচ্ছে পরিস্থিতি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত বছরের জুন মাসের তুলনায় এবার জুনে আক্রান্ত চার গুণ বেশি। আক্রান্তের হার বাড়লেও মশা মারতে যেন গরজ নেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। তারা এখনও রুটিন কাজে ব্যস্ত।
বাসিন্দাদের অভিযোগ মশার অত্যাচার বেড়েছে বহুগুণ, তবে ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না কাউকে। এদিকে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে দিনের পর দিন বিভিন্ন স্থানে জমে থাকছে পানি। এতে বাড়ছে মশার প্রজনন। এমন পরিস্থিতিতে আক্রান্তের হার বাড়তে থাকায় বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ছয় মাসের মধ্যে জুনে সর্বোচ্চ ১৭৬ রোগী শনাক্ত হয়েছে। জানুয়ারিতে ৭০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৮, মার্চে ২২, এপ্রিলে ৩৩ এবং মে মাসে ১১৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এবার জুনে আক্রান্ত গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালের জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছিল ৪১ জন, ২০২২ সালে ছিল ১৯ জন। চলতি জুলাই মাসের প্রথম পাঁচ দিনেই আক্রান্ত হয়েছে অর্ধশত।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিচালিত এক জরিপে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে নগরের ছয়টি এলাকাকে ‘লাল’, পাঁচটিকে ‘হলুদ’, সাতটিকে ‘নীল’ এবং চারটি এলাকা ‘সবুজ’ তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে এসব এলাকায়ও মশক নিধন কার্যক্রম দৃশ্যমান না হওয়ার অভিযোগ বাসিন্দাদের।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা.
নগরীর চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা ডেঙ্গু আক্রান্ত মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘কয়েকদিন পর পর বাসার চারপাশ নিজেরা পরিষ্কার করি। মশারি ছাড়া ঘুমাই না। এর পরও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছি। দিন-রাতে সমানতালে বেড়েছে মশার অত্যাচার। কিন্তু গত তিন মাসেও মশার ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। ঘরে আছে শিশু সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মা। কখন যে কে আক্রান্ত হয়, সেই দুশ্চিন্তায় কাটছে বেশির ভাগ সময়।’
বাকলিয়া এলাকার গৃহিণী শিমলা আক্তার বলেন, ‘পরিচিত বেশ কয়েকজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। বাসায় রয়েছে দুই শিশু সন্তান। তাই নিজেরাও উদ্বিগ্ন। এলাকার চারপাশে ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। কিছু স্থানে নিয়মিত জমে থাকে পানি। এতে ভন ভন করে মশা। এসব দেখার যেন কেউ নেই।’ কর্নেল হাট এলাকার বাসিন্দা মো. আলমগীর বলেন, ‘গণমাধ্যমে দেখি মেয়র অনেককে নিয়ে বিশেষ ক্রাশ অভিযান উদ্বোধন করছেন। কিন্তু বাস্তবে তো মশা মারতে এত তোড়জোড় দেখি না।’
চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘একই ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে মশার মধ্যে রেজিস্টেন্স তৈরি হয়। এজন্য আমরা যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাভিত্তিক নতুন মশা নিধন সমাধান বায়োলজিক্যাল লার্ভিসাইড বিটিআই পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করছি। শুধু সিটি করপোরেশনের ওপর দায় চাপিয়ে না দিয়ে প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে। ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো কমিশনার না থাকা সত্ত্বেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’ সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘জুলাইয়ের শুরু থেকে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এজন্য মশা মারার বিকল্প নেই। কারণ সঠিক সময়ে মশা মারতে না পারলে আক্রান্তের হার বেড়ে যাবে। কিছুদিন ধরে রোগী বাড়ছে হাসপাতালে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে রোগীর চাপ বাড়ছে। প্রতিদিন আউটডোরেও অনেক রোগী আসছেন। এদের মধ্যে অনেককে ভর্তি করতে হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই মশার বিস্তার রোধ করতে হবে।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, জমে থাকা স্বচ্ছ পানিই এডিস মশার প্রজননের উপযুক্ত ক্ষেত্র। ডাবের খোসা, প্লাস্টিক বোতল বা পলিথিনে এক মিলিলিটার পানি জমে থাকলেও সেখানে মশার লার্ভা জন্ম নিতে পারে। চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত এক জরিপে ৩৭ শতাংশ বাড়িতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। বাসাবাড়ির আশপাশে এবং বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত প্রায় ৩৬ শতাংশ ছোট-বড় পাত্রে মিলেছে লার্ভার প্রজননকেন্দ্র। নগরের বেশির ভাগ স্থানে
ছোট-বড় পাত্র ও নালায়, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ড্রাম, নারিকেলের খোসাসহ বিভিন্ন অংশে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকছে পানি।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গর্ভধারণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না ৭৭ শতাংশ নারী
দেশের ৭৭ শতাংশ নারীর সন্তান নেওয়ার বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বিশ্বে এই হার ৬৬ শতাংশ। দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সংকট, সামাজিক চাপ নারীর প্রজনন স্বাধীনতাকেও সীমাবদ্ধ করেছে।
এসব তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর বার্ষিক প্রতিবেদনে।
সোমবার রাজধানীর গুলশান-২ এ অবস্থিত জাতিসংঘ ভবনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রতিবেদনটি অনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এ বছরের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী প্রজননবিষয়ক সমস্যার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ইউএনএফপিএ ১৪টি দেশের ১৪ হাজার মানুষের ওপর এ জরিপ চালিয়েছে। বাংলাদেশের অংশটি বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন থেকে তথ্য নিয়েছে।
অনুষ্ঠানে ইউএনএফপিএ এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি মিস ক্যাথরিন ব্রিন কামকং প্রতিবেদনটির গুরুত্বর্পূণ অংশ তুলে ধরেন। বৈশ্বিক ও জাতীয় জনসংখ্যা প্রবণতা ও উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ বিষয়ে মূল দিকনির্দেশনা উঠে আসে তার বক্তব্যে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৪৫ শতাংশ মানুষ কাঙ্ক্ষিত পরিবারের আকার বা সন্তান সংখ্যা অর্জন করতে পারবেন কি না অনিশ্চয়তা রয়েছে। আর যাদের বয়স ৫০ বছর বা তার বেশি, তাদের মধ্যে ৩১ শতাংশ মনে করেন, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তানের তুলনায় কম সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই প্রায় ৩৭ থেকে ৩৮ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তান পেয়েছেন। একই ধরনের পারিবারিক আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, বাস্তব জীবনের নানা প্রতিবন্ধকতা অনেকের পক্ষে সেই লক্ষ্য পূরণকে ব্যাহত করছে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রধানত চার বাধার কারণে এসব জনগোষ্ঠী সন্তান কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তান নিতে পাচ্ছে। এদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ মানুষ অর্থনীতি সংকটে থাকার কারণে সন্তান নিতে পাচ্ছেন না। ২৪ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে সন্তান নিতে পাচ্ছেন না। ২৪ শতাংশ ভালোসঙ্গীর কারণে সন্তান ধারণে পিছিয়ে রয়েছে। ১৯ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে সন্তান নিতে চান না।
ইউএনএফপিএ প্রতিবেদনে বলা হয়, সমস্যা এখন অধিক জন্ম অথবা জনসংখ্যা হ্রাস নয় আসল সংকট হচ্ছে সন্তান নেয়ার স্বাধীনতা ও প্রজনন অধিকার নিয়ে। বলছে, বিশ্বের অনেক মানুষ, বিশেষ করে নারী ও তরুণরা, এখনও তাদের প্রজনন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের স্বাধীনতা পান না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সংকট আরও প্রকট। অনেক নারীই এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না কখন সন্তান নেবেন, কীভাবে নেবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও কিশোরী মাতৃত্ব এখানকার বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে প্রতি তিন নারীর একজন কখনো না কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১১ শতাংশ নারী এখনও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ২৫ শতাংশ নারী নিজের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না এবং ২৪ শতাংশ নারী যৌন সম্পর্কে অসম্মতির অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না।
জাতিসংঘ প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং বলেন, ‘এ বছরের প্রতিবেদন প্রচলিত ‘অতিরিক্ত’ বা ‘অপর্যাপ্ত’ জন্মসংখ্যার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। আসল সংকট হচ্ছে প্রজনন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার অভাব। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় নারী ও তরুণেরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কাঠামোগত বাধার কারণে নিজেদের প্রজনন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না।”
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বর্তমানে যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং বাজেটের ২ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে, সেটি বাড়িয়ে যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ করতে হবে। এতে করে প্রয়োজনীয় প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, দক্ষ মিডওয়াইফ ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
চলুন আমরা এমন একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি, যেখানে প্রজনন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোকে সমর্থন করা হবে, বিচার নয় আর প্রতিটি মানুষ যেন স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে নিজের জীবনের পরিকল্পনা করতে করতে পারবে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৫ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৫৭ লাখ, যার অর্ধেকই নারী। দুই-তৃতীয়াংশ (প্রায় ১১ দশমিক ৫ কোটি মানুষ কর্মক্ষম বয়সে রয়েছেন, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের একটি সুযোগ। তবে একই সঙ্গে ৭ শতাংশ মানুষ (১ কোটি ২০ লাখ) ৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত চাপেরও ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরী (১০-১৯ বছর) জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ। আর ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি, যা ২৮ শতাংশ।
প্রতিবেদনটি আরও বলা হয়, বিশ্বজুড়ে মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত সন্তানসংখ্যা অর্জন করতে পারছেন না। কেউ সন্তান নিতে চেয়েও সময়মতো পারেননি, কেউ আবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মা হয়েছেন। এমনকি একই ব্যক্তি দুই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন যা প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় কাঠামোগত দুর্বলতার দিকেই ইঙ্গিত করে। এই সংকট উচ্চ ও নিম্ন উভয় প্রজনন হারের দেশগুলোতেই বিদ্যমান।