না, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে না

ব্রেট স্টিফেন্স

এটা কঠোর শোনাতে পারে, কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে একটা বড় রকমের অসামঞ্জস্য আছে। ধরুন, যদি ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ও কাজ সত্যিই গণহত্যামূলক হয়; অর্থাৎ তারা যদি গাজাবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য এতটাই নিষ্ঠুর হয়ে থাকে, তাহলে তারা আরও বেশি পরিকল্পিত এবং অনেক বেশি প্রাণঘাতী কেন হয়নি?

কেন মৃতের সংখ্যা লক্ষাধিক নয়। কেন মৃতের সংখ্যা ৬০ হাজারে সীমাবদ্ধ? আর এই সংখ্যা এসেছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। আর এই সংখ্যাটি এসেছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে, যারা যোদ্ধা আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে না।

ইসরায়েলের পক্ষে আরও বেশি ধ্বংস চালানো সম্ভব ছিল না, এমন নয়। তারা অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি। হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার পর এবং ইরানকে দুর্বল করে আরও শক্তিশালী হয়েছে। তারা চাইলে কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই বোমা ফেলতে পারত, কিন্তু সাধারণত গাজাবাসীকে আগেই জানানো হয় কোন এলাকায় হামলা হবে। তারা এমনও করতে পারত যে নিজেদের সেনাদের, যাঁদের অনেকেই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, ঝুঁকিতে না ফেলে কেবল আকাশপথে আক্রমণ চালাত।

এমনও নয় যে গাজায় ইসরায়েলের জিম্মিরা থাকায় তারা হামলা থেকে বিরত থেকেছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা বেশ ভালোভাবেই জানে, কোথায় এসব জিম্মিকে রাখা হয়েছে, আর এটাই একটি কারণ যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া জিম্মিদের খুব বেশি মারা যায়নি। এবং এটা তারা জানে যে হামাস জিম্মিদের জীবিত রাখার পক্ষেই আগ্রহী।

কূটনৈতিক সমর্থনের দিক থেকেও ইসরায়েলের ঘাটতি নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছেন, গাজার সবাইকে এলাকা ছাড়তে হবে এবং বারবার হুঁশিয়ার করেছেন যে হামাস জিম্মিদের ছেড়ে না দিলে গাজায় ‘নরক নেমে আসবে’। 

তাই প্রশ্ন আসে, যাঁরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলছেন, তাঁদের আগে বলা উচিত—মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি কেন নয়? উত্তর খুব সহজ: কারণ, ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে না।

‘গণহত্যা’ শব্দটির একটি নির্দিষ্ট আইনগত এবং নৈতিক ব্যাখ্যা আছে, যা জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী হলো কোনো জাতীয়, জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার ইচ্ছা।

এখানে ‘ইচ্ছা’ এবং ‘গোষ্ঠী হিসেবে’—এই শব্দ দুটি গুরুত্বপূর্ণ। গণহত্যা মানে কেবল অনেক বেসামরিক মানুষ মারা যাওয়া নয়। বরং এটি মানে কেবল কোনো গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা—যেমন হিটলার ও নাৎসিরা কেবল ইহুদি হওয়ার কারণে ইহুদিদের হত্যা করেছে, কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যায় হুতুরা তুতসিদের মেরেছে।

এটা সত্য যে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ অনেক বেশি। ইসরায়েল যেসব কৌশল অবলম্বন করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে—বিশেষত খাবার সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে, যেখানে তারা চেয়েছে হামাসের হাত থেকে খাবারের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে। ইতিহাসে খুব কম সামরিক বাহিনীই এমন আছে, যাদের কোনো না কোনো যুদ্ধে কেউ না কেউ যুদ্ধাপরাধ করেনি। এই তালিকায় ইসরায়েলও পড়ে। 

অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হামবুর্গ ও ড্রেসডেন শহরে বোমা হামলায় লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ মারা গেলেও তাঁরা যুদ্ধের শিকার হয়েছেন। তাঁরা গণহত্যার শিকার নন। কারণ, মিত্রশক্তির লক্ষ্য ছিল জার্মান জাতিকে ধ্বংস করা নয়, বরং নাৎসিদের পরাজিত করা।

ইসরায়েলের সমালোচকেরা গাজায় যে ব্যাপক ধ্বংস হয়েছে, তা তুলে ধরেন। তাঁরা কিছু ইসরায়েলি রাজনীতিকের উসকানিমূলক বক্তব্যও তুলে ধরেন, যেগুলোয় গাজাবাসীকে অমানবিকভাবে চিত্রিত করা হয়।

কিন্তু ৭ অক্টোবরের হামাসের ভয়ংকর হামলার পর এসব ক্ষুব্ধ মন্তব্যকে নাৎসি গণহত্যার পরিকল্পনার (যেমন ওয়ানসি সম্মেলন) সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এবং আমি এমন কোনো প্রমাণ জানি না, যাতে বলা যায় যে ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে গাজাবাসীকে হত্যা করছে।

তবে এটা সত্য যে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ অনেক বেশি। ইসরায়েল যেসব কৌশল অবলম্বন করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে—বিশেষত খাবার সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে, যেখানে তারা চেয়েছে হামাসের হাত থেকে খাবারের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে। ইতিহাসে খুব কম সামরিক বাহিনীই এমন আছে, যাদের কোনো না কোনো যুদ্ধে কেউ না কেউ যুদ্ধাপরাধ করেনি। এই তালিকায় ইসরায়েলও পড়ে। 

কিন্তু ত্রাণ বিতরণে ভুল, অতি সংবেদনশীল সেনা, ভুল টার্গেট কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতিকদের বক্তব্য—এসব দিয়ে ‘গণহত্যা’ প্রমাণ করা যায় না। এগুলো যুদ্ধের স্বাভাবিক ট্র্যাজেডির অংশ।

গাজাকে ঘিরে যে বিষয়টি বিশেষ, তা হলো হামাস যেভাবে যুদ্ধ করছে, তা একেবারেই অপরাধমূলক এবং ঠান্ডা মাথার হিসাব-কিতাব। যেমন ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সময় সাধারণ মানুষ বাংকারে আশ্রয় নেন, আর সেনারা ওপরে থেকে লড়াই করেন। কিন্তু গাজায় এর উল্টোটা। সেখানে হামাস নিজেদের সুরক্ষিত রাখে টানেলের ভেতর আর সাধারণ মানুষ ওপরে থাকেন।

এখানে একটা বিষয় ভেবে দেখা দরকার: একই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র কী করত? ২০১৬-১৭ সালে ওবামা ও ট্রাম্পের অধীন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক সরকারকে সাহায্য করেছিল মসুল শহর দখলমুক্ত করতে। শহরটি তিন বছর ধরে আইএসের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং টানেলে ভরা এক দুর্গে পরিণত হয়েছিল।

নিউইয়র্ক টাইমস–এই প্রকাশিত এক বর্ণনায় বলা হয়েছিল, মার্কিন বিমান হামলায় কখনো কখনো পুরো ব্লক ধ্বংস হয়ে যেত। মসুলের জিদিদেহ এলাকায় এমন এক হামলায় ২০০ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আইএস তখন বেসামরিক মানুষদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করত এবং বেপরোয়া স্নাইপার ও মর্টার হামলা চালাত। ৯ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধ ছিল দুই দলেরই সমর্থনপুষ্ট—রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টি উভয়ের। অনেকে বলেন, এতে প্রায় ১১ হাজার বেসামরিক মানুষ মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছিল বলে মনে পড়ে না।

কিছু পাঠক বলতে পারেন—যদিও এই যুদ্ধ গণহত্যা না হয়, তা–ও এটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে এবং এর এখনই শেষ হওয়া দরকার। এটা যৌক্তিক দাবি এবং বেশির ভাগ ইসরায়েলিও তা বিশ্বাস করেন। কিন্তু তাহলে ‘গণহত্যা’ শব্দটি নিয়ে এত বিতর্ক কেন? বিতর্ক দুটি কারণে।

প্রথমত, অনেক চিন্তাবিদ হয়তো আন্তরিকভাবে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু কিছু লোক এই শব্দ ব্যবহার করেন ইচ্ছাকৃতভাবে ইসরায়েলকে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে তুলনা করার জন্য। এতে শুধু ইসরায়েল সরকার নয়, বরং যেকোনো ইহুদি (যিনি ইসরায়েলকে সমর্থন করেন), তাঁকেও গণহত্যার পক্ষে দাঁড়ানো ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বহু বছর ধরেই ইসরায়েলবিরোধীরা বিভিন্ন মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত অভিযোগ তোলে। ‘গণহত্যা’ শব্দটি এখন সেই একই কৌশলের আরও ভয়ংকর রূপ।

দ্বিতীয়ত, ‘গণহত্যা’ শব্দটি ১৯৪০-এর দশকে তৈরি হয়েছিল এবং এটি এককভাবে ভয়াবহ অপরাধ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দকে যদি আমরা প্রতিটি অপছন্দের সামরিক সংঘাতে ব্যবহার করি, তাহলে ভবিষ্যতের আসল গণহত্যার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলব।

ব্রেট স্টিফেন্স নিউইয়র্ক টাইমস–এর কলাম লেখক

নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধের বিপরীতে একটি সমালোচনামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করে কাতারভিত্তিক আল–জাজিরা। ২৩ জুলাই, ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর য় ইসর য় ল ইসর য় ল র র ক ট ইমস গণহত য র হয় ছ ল অন ক ব ব স কর

এছাড়াও পড়ুন:

সুদানের এল-ফাশের শহরে ‘চরম বিপদে’ বাসিন্দারা: ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস

সুদানের আধা সামরিক বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) কাছে দেশটির এল–ফাশের শহরের পতনের পর সেখানকার বাসিন্দারা ‘চরম বিপদের’ মধ্যে রয়েছেন। তাঁরা শহরটিতে আটকা পড়েছেন। গতকাল শনিবার ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্য চিকিৎসা সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছে।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরএসএফের লড়াই চলছে। গত ২৬ অক্টোবর এল-ফাশের দখল করে নেয় আধা সামরিক বাহিনীটি। শহরটির পতনের পর থেকে সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যা, যৌন সহিংসতা, ত্রাণকর্মীদের ওপর হামলা, লুটপাট এবং অপহরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেখানকার যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুনসুদানে ‘গণহত্যা’ হয়েছে২২ ঘণ্টা আগে

এল–ফাশের শহর থেকে যাঁরা পালিয়ে কাছের তাউইলা শহরে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁরা বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা চালানোর কথা বলেছেন। তাঁদের ভাষ্য, এল–ফাশেরে মা–বাবার সামনে সন্তানদের হত্যা করা হচ্ছে। মানুষজন শহরটি থেকে পালানোর সময় তাঁদের মারধর করা হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাবে, ২৬ অক্টোবর থেকে ‍৬৫ হাজারের বেশি মানুষ শহরটি থেকে পালিয়েছেন।

শনিবার ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছে, এল–ফাশেরের বিপুল মানুষ ‘চরম বিপদের’ মধ্যে রয়েছে। তাদের শহরটি ত্যাগ করতে দিচ্ছে না আরএসএফ ও তাদের সহযোগীরা। সংস্থাটির জরুরি বিভাগের প্রধান মাইকেল ওলিভিয়ার লাচেরিটে বলেন, এল–ফাশের থেকে যাঁরা নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁরা কোথায়? সম্ভাব্য উত্তরটা হলো—তাঁদের হত্যা করা হয়েছে।

গত শুক্রবার জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আরএসএফের হামলায় এল–ফাশেরে কয়েক শ মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে সুদানের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দুই হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব বলেছে, এল–ফাশেরে গণহত্যা অব্যাহত থাকার বিভিন্ন ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।

সুদান ‘মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির’ মধ্যে রয়েছে বলে শনিবার উল্লেখ করেছেন জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহান ওয়েডফুল। বাহরাইনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বেসামরিক লোকজনকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আরএসএফ। এরপরও এমন নৃশংসতার জন্য তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। একই সংবাদ সম্মেলনে সুদানের পরিস্থিতি ‘ভয়ংকর’ বলে উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভেট কুপার।

আরও পড়ুনসুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন৭ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুদানের এল-ফাশের শহরে ‘চরম বিপদে’ বাসিন্দারা: ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস
  • সুদানে গণহত্যার প্রতিবাদে জাবি ও জবিতে মানববন্ধন
  • জুলাইবিরোধী শক্তির শাস্তি দাবিতে ইবিতে বিক্ষোভ
  • সুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন
  • মামদানিকে বারাক ওবামার ফোন, করলেন নির্বাচনী প্রচারের প্রশংসা
  • একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল
  • নিউইয়র্কের এত ইহুদি কেন জোহরান মামদানির পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন
  • সোনার টয়লেট ‘আমেরিকা’ নিলামে উঠছে, সর্বনিম্ন দর কত জানেন
  • ভোটের আগে মামদানি-কুমোর এগিয়ে থাকার লড়াই
  • তিন জরিপে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে মামদানি