গাজা নিয়ে ‘গণহত্যামূলক সাংবাদিকতা’ করছে নিউইয়র্ক টাইমস
Published: 26th, July 2025 GMT
না, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে না
ব্রেট স্টিফেন্স
এটা কঠোর শোনাতে পারে, কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে একটা বড় রকমের অসামঞ্জস্য আছে। ধরুন, যদি ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ও কাজ সত্যিই গণহত্যামূলক হয়; অর্থাৎ তারা যদি গাজাবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য এতটাই নিষ্ঠুর হয়ে থাকে, তাহলে তারা আরও বেশি পরিকল্পিত এবং অনেক বেশি প্রাণঘাতী কেন হয়নি?
কেন মৃতের সংখ্যা লক্ষাধিক নয়। কেন মৃতের সংখ্যা ৬০ হাজারে সীমাবদ্ধ? আর এই সংখ্যা এসেছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। আর এই সংখ্যাটি এসেছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে, যারা যোদ্ধা আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে না।
ইসরায়েলের পক্ষে আরও বেশি ধ্বংস চালানো সম্ভব ছিল না, এমন নয়। তারা অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি। হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার পর এবং ইরানকে দুর্বল করে আরও শক্তিশালী হয়েছে। তারা চাইলে কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই বোমা ফেলতে পারত, কিন্তু সাধারণত গাজাবাসীকে আগেই জানানো হয় কোন এলাকায় হামলা হবে। তারা এমনও করতে পারত যে নিজেদের সেনাদের, যাঁদের অনেকেই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, ঝুঁকিতে না ফেলে কেবল আকাশপথে আক্রমণ চালাত।
এমনও নয় যে গাজায় ইসরায়েলের জিম্মিরা থাকায় তারা হামলা থেকে বিরত থেকেছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা বেশ ভালোভাবেই জানে, কোথায় এসব জিম্মিকে রাখা হয়েছে, আর এটাই একটি কারণ যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া জিম্মিদের খুব বেশি মারা যায়নি। এবং এটা তারা জানে যে হামাস জিম্মিদের জীবিত রাখার পক্ষেই আগ্রহী।
কূটনৈতিক সমর্থনের দিক থেকেও ইসরায়েলের ঘাটতি নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছেন, গাজার সবাইকে এলাকা ছাড়তে হবে এবং বারবার হুঁশিয়ার করেছেন যে হামাস জিম্মিদের ছেড়ে না দিলে গাজায় ‘নরক নেমে আসবে’।
তাই প্রশ্ন আসে, যাঁরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলছেন, তাঁদের আগে বলা উচিত—মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি কেন নয়? উত্তর খুব সহজ: কারণ, ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে না।
‘গণহত্যা’ শব্দটির একটি নির্দিষ্ট আইনগত এবং নৈতিক ব্যাখ্যা আছে, যা জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী হলো কোনো জাতীয়, জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার ইচ্ছা।
এখানে ‘ইচ্ছা’ এবং ‘গোষ্ঠী হিসেবে’—এই শব্দ দুটি গুরুত্বপূর্ণ। গণহত্যা মানে কেবল অনেক বেসামরিক মানুষ মারা যাওয়া নয়। বরং এটি মানে কেবল কোনো গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা—যেমন হিটলার ও নাৎসিরা কেবল ইহুদি হওয়ার কারণে ইহুদিদের হত্যা করেছে, কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যায় হুতুরা তুতসিদের মেরেছে।
এটা সত্য যে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ অনেক বেশি। ইসরায়েল যেসব কৌশল অবলম্বন করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে—বিশেষত খাবার সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে, যেখানে তারা চেয়েছে হামাসের হাত থেকে খাবারের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে। ইতিহাসে খুব কম সামরিক বাহিনীই এমন আছে, যাদের কোনো না কোনো যুদ্ধে কেউ না কেউ যুদ্ধাপরাধ করেনি। এই তালিকায় ইসরায়েলও পড়ে।অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হামবুর্গ ও ড্রেসডেন শহরে বোমা হামলায় লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ মারা গেলেও তাঁরা যুদ্ধের শিকার হয়েছেন। তাঁরা গণহত্যার শিকার নন। কারণ, মিত্রশক্তির লক্ষ্য ছিল জার্মান জাতিকে ধ্বংস করা নয়, বরং নাৎসিদের পরাজিত করা।
ইসরায়েলের সমালোচকেরা গাজায় যে ব্যাপক ধ্বংস হয়েছে, তা তুলে ধরেন। তাঁরা কিছু ইসরায়েলি রাজনীতিকের উসকানিমূলক বক্তব্যও তুলে ধরেন, যেগুলোয় গাজাবাসীকে অমানবিকভাবে চিত্রিত করা হয়।
কিন্তু ৭ অক্টোবরের হামাসের ভয়ংকর হামলার পর এসব ক্ষুব্ধ মন্তব্যকে নাৎসি গণহত্যার পরিকল্পনার (যেমন ওয়ানসি সম্মেলন) সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এবং আমি এমন কোনো প্রমাণ জানি না, যাতে বলা যায় যে ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে গাজাবাসীকে হত্যা করছে।
তবে এটা সত্য যে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ অনেক বেশি। ইসরায়েল যেসব কৌশল অবলম্বন করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে—বিশেষত খাবার সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে, যেখানে তারা চেয়েছে হামাসের হাত থেকে খাবারের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে। ইতিহাসে খুব কম সামরিক বাহিনীই এমন আছে, যাদের কোনো না কোনো যুদ্ধে কেউ না কেউ যুদ্ধাপরাধ করেনি। এই তালিকায় ইসরায়েলও পড়ে।
কিন্তু ত্রাণ বিতরণে ভুল, অতি সংবেদনশীল সেনা, ভুল টার্গেট কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতিকদের বক্তব্য—এসব দিয়ে ‘গণহত্যা’ প্রমাণ করা যায় না। এগুলো যুদ্ধের স্বাভাবিক ট্র্যাজেডির অংশ।
গাজাকে ঘিরে যে বিষয়টি বিশেষ, তা হলো হামাস যেভাবে যুদ্ধ করছে, তা একেবারেই অপরাধমূলক এবং ঠান্ডা মাথার হিসাব-কিতাব। যেমন ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সময় সাধারণ মানুষ বাংকারে আশ্রয় নেন, আর সেনারা ওপরে থেকে লড়াই করেন। কিন্তু গাজায় এর উল্টোটা। সেখানে হামাস নিজেদের সুরক্ষিত রাখে টানেলের ভেতর আর সাধারণ মানুষ ওপরে থাকেন।
এখানে একটা বিষয় ভেবে দেখা দরকার: একই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র কী করত? ২০১৬-১৭ সালে ওবামা ও ট্রাম্পের অধীন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক সরকারকে সাহায্য করেছিল মসুল শহর দখলমুক্ত করতে। শহরটি তিন বছর ধরে আইএসের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং টানেলে ভরা এক দুর্গে পরিণত হয়েছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস–এই প্রকাশিত এক বর্ণনায় বলা হয়েছিল, মার্কিন বিমান হামলায় কখনো কখনো পুরো ব্লক ধ্বংস হয়ে যেত। মসুলের জিদিদেহ এলাকায় এমন এক হামলায় ২০০ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আইএস তখন বেসামরিক মানুষদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করত এবং বেপরোয়া স্নাইপার ও মর্টার হামলা চালাত। ৯ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধ ছিল দুই দলেরই সমর্থনপুষ্ট—রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টি উভয়ের। অনেকে বলেন, এতে প্রায় ১১ হাজার বেসামরিক মানুষ মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছিল বলে মনে পড়ে না।
কিছু পাঠক বলতে পারেন—যদিও এই যুদ্ধ গণহত্যা না হয়, তা–ও এটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে এবং এর এখনই শেষ হওয়া দরকার। এটা যৌক্তিক দাবি এবং বেশির ভাগ ইসরায়েলিও তা বিশ্বাস করেন। কিন্তু তাহলে ‘গণহত্যা’ শব্দটি নিয়ে এত বিতর্ক কেন? বিতর্ক দুটি কারণে।
প্রথমত, অনেক চিন্তাবিদ হয়তো আন্তরিকভাবে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু কিছু লোক এই শব্দ ব্যবহার করেন ইচ্ছাকৃতভাবে ইসরায়েলকে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে তুলনা করার জন্য। এতে শুধু ইসরায়েল সরকার নয়, বরং যেকোনো ইহুদি (যিনি ইসরায়েলকে সমর্থন করেন), তাঁকেও গণহত্যার পক্ষে দাঁড়ানো ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বহু বছর ধরেই ইসরায়েলবিরোধীরা বিভিন্ন মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত অভিযোগ তোলে। ‘গণহত্যা’ শব্দটি এখন সেই একই কৌশলের আরও ভয়ংকর রূপ।
দ্বিতীয়ত, ‘গণহত্যা’ শব্দটি ১৯৪০-এর দশকে তৈরি হয়েছিল এবং এটি এককভাবে ভয়াবহ অপরাধ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দকে যদি আমরা প্রতিটি অপছন্দের সামরিক সংঘাতে ব্যবহার করি, তাহলে ভবিষ্যতের আসল গণহত্যার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলব।
● ব্রেট স্টিফেন্স নিউইয়র্ক টাইমস–এর কলাম লেখক
নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধের বিপরীতে একটি সমালোচনামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করে কাতারভিত্তিক আল–জাজিরা। ২৩ জুলাই, ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর য় ইসর য় ল ইসর য় ল র র ক ট ইমস গণহত য র হয় ছ ল অন ক ব ব স কর
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ