সুন্দরবনে অভিযান দেখে পালালেন জেলেরা, পড়ে রইল কাঁকড়াবোঝাই ট্রলার
Published: 27th, July 2025 GMT
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সুন্দরবনের নদী ও খাল থেকে কাঁকড়া শিকার করে ট্রলারে ভরে ফিরছিলেন একদল জেলে। ট্রলার যখন লোকালয়ের কাছাকাছি, তখন হঠাৎ হাজির বন বিভাগ ও কোস্টগার্ডের যৌথ টহল দল। জেলেরা তড়িঘড়ি করে ট্রলার তীরে ঠেকিয়ে কাঁকড়া ফেলে পালিয়ে যান। পরে পরিত্যক্ত ট্রলার থেকে উদ্ধার হয় ৭৩০ কেজি কাঁকড়া। গতকাল শনিবার বিকেলে কয়রা উপজেলার চরামুখা গ্রামসংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের তীরে এ ঘটনা ঘটে।
আজ রোববার সকালে জব্দ কাঁকড়াগুলো কয়রার বন আদালতে নেওয়া হয়। দুপুর ১২টার দিকে কয়রা বন আদালত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আদালত ভবনের পুরোনো একটি কক্ষের মধ্যে অনেকগুলো বস্তা আর প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রাখা জব্দ কাঁকড়াগুলো। পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কয়েকজন বনকর্মী।
আদালত ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন বিভাগের কোবাদক ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানালেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন, কিছু অসাধু জেলে সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া ধরে কপোতাক্ষ নদ ধরে লোকালয়ে ফিরছেন। এরপর কোস্টগার্ডের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালিয়ে চরামুখা গ্রামের কাছে একটি সন্দেহজনক ট্রলার দেখতে পান তাঁরা। কিন্তু টহল বোট কাছে পৌঁছানোর আগেই জেলেরা তীরে ভিড়িয়ে ট্রলার ফেলে পালিয়ে যান। পরিত্যক্ত ট্রলারে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় ৭৩০ কেজি জীবিত কাঁকড়া।
সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, এখন সুন্দরবনের কাঁকড়ার ব্যবসা মাছের চেয়ে অনেক বড় মুনাফার ব্যবসা। বন-উপকূলজুড়ে একটি বড় সিন্ডিকেট কাঁকড়া শিকারে জড়িত। জোড়শিং, ঘড়িলাল, বানিয়াখালী, দেউলিয়া বাজারসহ বিভিন্ন আড়তে প্রতিদিন শত শত মণ কাঁকড়া বিক্রি হয়। যদিও এখন শিকার নিষিদ্ধ, জেলেরা বন থেকে অবৈধভাবে কাঁকড়া শিকার করছেন।
আড়তে অবাধে কাঁকড়া বেচাকেনা
আজ সকালে কয়রা উপজেলার কয়েকটি কাঁকড়ার আড়তে দেখা গেছে, বস্তায় বস্তায় কাঁকড়া এসেছে বন থেকে। আড়তে কাঁকড়া পরিমাপ ও দড়ি দিয়ে বাঁধার কাজ চলছে। কয়রার কাশির হাটখোলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ট্রলারবোঝাই কাঁকড়া পার্শ্ববর্তী শ্যামনগর উপজেলার আড়তে যাচ্ছে। কাঁকড়ার বস্তা ট্রলারে ওঠানোর ফাঁকে এক ব্যক্তি জানালেন, ‘এখন সুন্দরবনে ঢোকা নিষিদ্ধ, তবু আমরা বনে ঢুকে কাঁকড়া ধরে আনি। বন্ধের সময় সবকিছু একটু ম্যানেজ করেই করতে হয়। ধরা খায় অল্প, বেশির ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে।’
বন বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে মাছ ধরা, কাঁকড়া আহরণ ও পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ; কারণ, এটি মাছ ও বন্য প্রাণীর প্রজননকাল। অথচ ঠিক এই সময়েই বেড়ে যাচ্ছে বন অপরাধ। একের পর এক অভিযানে ধরা পড়ছে ভয়াবহ চিত্র। ২৪ জুলাই বয়াশিংয়ে, ২২ জুলাই কালাবগীতে, ১৭ জুলাই দুবলায় এবং ১৪ জুলাই ভূতুমারী খালে বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া ও শিকারের সরঞ্জাম জব্দ হলেও শিকারিরা প্রত্যেকবারই পালিয়ে গেছেন। এসব ঘটনা বন বিভাগের জন্য বড় উদ্বেগের বার্তা দিচ্ছে।
কয়রার কয়েকজন কাঁকড়া ব্যবসায়ী জানান, উপজেলায় প্রায় ১০৫টি কাঁকড়া বিক্রির ডিপো আছে। জেলেরা কাঁকড়া শিকার করে বনে বসেই তা বিক্রি করে দিচ্ছেন দ্বিতীয় কোনো পক্ষের কাছে। আর দ্বিতীয় পক্ষের লোকজন নার্সিং পয়েন্ট ও ঘেরের কাঁকড়া বলে তাঁদের কাছে কাঁকড়া বিক্রি করছেন। তাঁরা (ব্যবসায়ীরা) কাঁকড়া কিনে ঢাকায় রপ্তানিকারকদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন।
উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, একসময় ছোট কাঁকড়ার বাজার ছিল না, এখন কোনো বাছবিচার ছাড়াই ছোট-বড় সব কাঁকড়া ধরা হচ্ছে। বাঁশের তৈরি ‘চারো’ বা ‘আটোন’ ফাঁদ দিয়ে নির্বিচার শিকার চলছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, সুন্দরবন সোনার ডিম পাড়া হাঁস, এটি ধ্বংস করলে শেষ ক্ষতিটা গরিব জেলেদেরই হবে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে কাঁকড়ার অস্তিত্বই শেষ।
পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ‘বনরক্ষীদের বোটের শব্দ শুনলেই অপরাধীরা জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। বন বিভাগের টহল দল নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে একাধিক নৌকা ও বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া জব্দ করে নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। আজ বেলা দেড়টায় আদালতের নির্দেশে ৭৩০ কেজি কাঁকড়া শাকবাড়িয়া নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। তবে লোকালয়ের বাজারে তদারকি কম থাকায় কিছু কাঁকড়া ডিপোতে চলে যেতে পারে। তাই বাজার নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি উপকূলীয় উপজেলাগুলোর প্রশাসনকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন ব ভ গ র স ন দরবন উপজ ল র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে।
যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে।
রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”
তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।
শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’
ঢাকা/শহিদুল/এস