ফ্রান্সের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ইন্দোনেশিয়া ‘শান্তির পথে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ’ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে। ভাসা ভাসাভাবে দেখতে গেলে, এই কূটনৈতিক সমর্থন ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের পক্ষে ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘদিনের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ফ্রান্সের এই ইঙ্গিতের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর ও বিপজ্জনক হিসাব–নিকাশ, যা কেবল বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে না, বরং সেটিকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।

ফ্রান্স যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটা মোটেই ন্যায়বিচার নয়। এটি স্বাধীনতাও নয়। এটি সেই পুরোনো বিভ্রমেরই আধুনিক সংস্করণ, যা দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের বন্দী ও ভূমিহীন করে রেখেছে। সেই তথাকথিত দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান।

জাকার্তার সরকারি বিবৃতিতে ফ্রান্সের পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে তার কারণ হলো একটি ‘সার্বভৌম ও স্বাধীন’ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সমর্থন করা হয়েছে। এর ভিত্তি হবে ১৯৬৭ সালের সীমানা এবং যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি কেমন ধরনের রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করছেন। একটি সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্রীকৃত ফিলিস্তিন, ইসরায়েলের স্বীকৃতি যেখানে থাকবে। মাখোঁর কল্পিত রাষ্ট্রে বসতি উচ্ছেদের কথা নেই, দখলকৃত ভূমিতে পুনর্বাসনের কথা নেই। এমনকি গাজায় যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহির কোনো বালাই নেই। শুধু একটি কূটনৈতিক তকমার বিনিময়ে একপেশে আত্মসমর্পণ।

এটি শান্তির পথে কোনো পদক্ষেপ নয়—এটি স্থায়ী দাসত্বের ছক।

ফ্রান্সের অবস্থান শুধু পক্ষপাতদুষ্টই নয়, এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ম্যাখোঁ ‘হামাসের নিরস্ত্রীকরণের’ আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে গাজা পুনর্গঠন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে ইসরায়েলের নিরস্ত্রীকরণ কোনো দাবি নেই, বেসামরিক মানুষ হত্যার জন্য কোনো জবাবদিহি নেই, আর ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত সার্বভৌমত্বের কোনো নিশ্চয়তাও নেই। বরং ফিলিস্তিনিদের বলা হচ্ছে প্রতিরোধ ত্যাগ করতে, অথচ দখলদার রাষ্ট্রটির ওপর দখল শেষ করার কোনো চাপই নেই।

এখন কূটনৈতিক নাটকের জন্য করতালি দেওয়ার দরকার নেই। এখন প্রয়োজন মিথ্যা সমাধানকে প্রত্যাখ্যান করা। এখন যে দ্বিরাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলা হচ্ছে, সেটা ন্যায়বিচারের পথ নয়। এটি এমন একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা কিনা উপনিবেশবাদকে সক্ষম করে তোলে।

ইন্দোনেশিয়া যদি কোনো শর্ত ছাড়াই এই চুক্তিকে প্রশংসা করে, তবে সেটি এমন একটি কাঠামোকে সমর্থন করা হয়, যা কূটনীতির ভাষায় ফিলিস্তিনিদের অধিকার বিসর্জন দেওয়ার পথ খুলে দেয়। এভাবে, ইন্দোনেশিয়াও এমন এক প্রক্রিয়ার অংশ হচ্ছে, যা ইসরায়েলকে তার দীর্ঘস্থায়ী দখল ও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা চালিয়ে যেতে সহায়তা করে।

কারণ, আমরা গাজায় যা দেখছি, তা শুধু যুদ্ধ নয়—এটি একটি জাতিকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার একটি প্রক্রিয়া।

ইসরায়েলের নেতারা সংযমের কোনো ভান করছেন না। দেশটির অর্থমন্ত্রী বেজালেল বেজালেল স্মোট্রিচ ঘোষণা দিয়েছেন যে গাজাকে ‘পুরোপুরি ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া’ উচিত। ইসরায়েলের আইনসভা নেসেটের সদস্যরা এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা এই ভূখণ্ডকে ‘সমূলে উৎপাটন’ করার আহ্বান জানিয়েছেন। অনাহার, অবরোধ ও বোমাবর্ষণ কোনোটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এর পেছনে সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য আছে। লক্ষ্য শুধু শাস্তি দেওয়া নয়, বরং গাজাকে জনশূন্য করে ফেলা।

আর এই গণহত্যার আকাঙ্ক্ষাটা নতুন কিছু নয়। এটি ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থীদের দীর্ঘদিনের একটি নীলনকশার অংশ, যেটি ‘মহান ইসরায়েল’ প্রকল্প নামে পরিচিত। এই নীলনকশায় কেবল জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করাটাই উদ্দেশ্য নয়, এর বিস্তৃতি আরও বেশি। একটি বিশাল ভূখণ্ডে কেবল একটি জাতির নিয়ন্ত্রণে থাকার স্বপ্ন এখানে রয়েছে। এই মডেলে ফিলিস্তিনিরা নাগরিক বা প্রতিবেশী নয়, তারা এমন এক পথের কাঁটা, যাদেরকে তুলে ফেলতে হবে।

এই প্রেক্ষাপট থেকেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি ফ্রান্সের স্বীকৃতিকে বুঝতে হবে। এটি কোনো নীতিগত সাহসী সিদ্ধান্ত নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে একটি বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখার কূটনৈতিক কৌশল। সচেতনভাবে হোক আর অসচেতনভাবে হোক, এটি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশিয়া, ইসরায়েলি শাসকদের নৈতিক মনোবল সেটিকে গ্রহণ করে, সেই শাসনব্যবস্থার জন্য একটি নৈতিক বৈধতা তৈরি করে দিচ্ছে।

এত দুর্ভোগের মুখে, অগ্রগতির যেকোনো ইঙ্গিতকে স্বাগত জানানো প্রলুব্ধকর হতে পারে। কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া প্রতীকী স্বীকৃতি কেবল বিদ্যমান বৈষম্যকেই আরও শক্তিশালী করে। একটিকে যদি বলা হয় ‘রাষ্ট্র’, অথচ সেটি থাকবে ইসরায়েলি চেকপোস্টে ঘেরা, কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকবে না, থাকবে না ফেরার অধিকার—তাহলে তা প্রকৃতপক্ষে কোনো রাষ্ট্র নয়, বরং একটি খোলা আকাশের নিচের কারাগার, যার হাতে শুধু একটি পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছে।

গাজাবাসী যে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে আছে, তাতে কোনো অগ্রগতির আভাসকে স্বাগত জানানো যায় না। কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া কোনো প্রতীকী স্বীকৃতি বিদ্যমান বাস্তবতাকেই আরও শক্তিশালী করবে। সামরিক বাহিনীহীন ফিলিস্তিন! এর মানে হচ্ছে, ইসরায়েলি চেকপোস্টে ঘেরা একটি জায়গা, যাদের কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকবে না, থাকবে না সেখানে ফেরার অধিকার। এটি কোনো রাষ্ট্র নয়, এটি এমন এক খোলা কারাগার, যেখানে শুধু একটা পতাকা থাকবে।

এখন কূটনৈতিক নাটকের জন্য করতালি দেওয়ার দরকার নেই। এখন প্রয়োজন মিথ্যা সমাধানকে প্রত্যাখ্যান করা। এখন যে দ্বিরাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলা হচ্ছে, সেটা ন্যায়বিচারের পথ নয়। এটি এমন একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা কিনা উপনিবেশবাদকে সক্ষম করে তোলে।

মুহাম্মদ জুলফিকার রাহমাত সেন্টার ফর ইকোনমিকের ইন্দোনেশিয়া-মেনা ডেস্কের পরিচালক

মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইন দ ন শ য স ব গত জ ন ক টন ত ক ব যবস থ ইসর য় ল এমন এক র জন য ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

বিসিএলে বিদেশি দল, এনসিএলে বিদেশি ক্রিকেটার

দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে প্রশ্ন আজকের নয়। জাতীয় ক্রিকেট লিগ, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ যে মানের হয়, যেভাবে আয়োজন হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে হরহামেশা। অতীতে সমালোচনার পর কিছুটা মান বেড়েছে। কিন্তু তারপরও ‘আপ টু মার্ক’ হয়নি।

বিশেষ করে ঘরোয়া ক্রিকেটে দিব‌্যি পারফর্ম করা ক্রিকেটাররা যখন জাতীয় দলে এসে ধুকতে থাকেন তখন তারতম‌্য প্রকটভাবে ফুটে উঠে। এজন‌্য ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। জাতীয় ক্রিকেট লিগে বিদেশি ক্রিকেটারকে নিয়ে আসতে চায় বিসিবি। এছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে যুক্ত করতে চায় বিদেশি দল।

বিসিবির পরিচালক ও টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম‌্যান আকরাম খান রাইজিংবিডিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আরো পড়ুন:

তিন সপ্তাহের জন্য আসছেন উড, মনোবিদ স্কট

সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার বেলায়েত হোসেন মারা গেছেন

বিসিএল শুরু থেকে ছিল ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক প্রতিযোগিতা। ওয়ালটন সেন্ট্রাল জোন, প্রাইম ব‌্যাংক সাউথ জোন, ইসলামী ব‌্যাংক ইষ্ট জোন ও বিসিবি নর্থ জোন নামে চারটি দল শুরুর কয়েক বছর বিসিএলে অংশ নিয়েছে। পেশাদারিত্বের ঘাটতি, পরিকল্পনার অভাব এবং বাণিজ‌্যিকভাবে লাভবান না হওয়ায় তিনটি ফ্রাঞ্চাইজি ধীরে ধীরে সরে যায়। পরবর্তীতে বিসিবি চারটি দলই নিজস্ব খরচে পরিচালনা করে বিসিএল চালু রাখে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীতার অভাব বোঝা যায়।

এজন‌্য বিসিবি সামনের আসরে বিদেশ থেকে একটি দল নিয়ে আসতে চায়। শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। বিসিএল যেই সময়ে আয়োজন করতে চাচ্ছে সেই সময়ে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে ব‌্যস্ত থাকবেন। আফগানিস্তানকে চূড়ান্ত করার পথে হাঁটছে। বিসিবির পুরো খরচেই অতিথি দল প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। বাকি তিনটি দল গঠন করবে বিসিবি।

আকরাম খান বলেছেন, ‘‘আমরা প্রথমবারের মতো বিসিএলে একটি বিদেশি দলকে পেতে যাচ্ছি। হয়তো তারা এ দল হিসেবে আসবে। নয়তো অন‌্য কোনো নামে। এক মাস এই টুর্নামেন্ট চলবে। ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’’

এদিকে জাতীয় ক্রিকেট লিগে বিদেশি ক্রিকেটার অন্তর্ভূক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় তারা যুক্ত হবেন, কিভাবে আসবেন, পারিশ্রমিক কত হতে পারে সেসব নিয়ে এখনও কোনো উপায় খুঁজতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে ভালোমানের বিদেশি খোঁজার প্রক্রিয়া চলছে।

তাদের পারিশ্রমিক চূড়ান্ত করা, পুরো আসরে অ‌্যাভেইলেভেল থাকবেন কিনা সেসব নিয়েও কাজ হচ্ছে। এজন‌্য আগেভাগে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না আকরাম।

আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দুই স্তরে জাতীয় ক্রিকেট লিগের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। আট দলে একজন করে বিদেশি ক্রিকেটার রাখার ইচ্ছা বিসিবির। অতীতে বিদেশি ক্রিকেটার জাতীয় ক্রিকেট লিগে অংশ নিয়েছে। ইমরান ফরহাদ, আমির ওয়াসিমরা খেলেছেন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রথম শ্রেণির এই টুর্মামেন্টে।

মূলত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং মান বাড়াতে এই উদ‌্যোগ নিতে যাচ্ছে আয়োজকরা। যদিও একজন করে বিদেশি ক্রিকেটার খেলানোর নিয়ম প্লেয়িং কন্ডিশনে সব সময়ই ছিল, ছিল সর্বশেষ মৌসুমেও। বিভাগীয় দলগুলো আগ্রহ না থাকায় বিসিবিও জোর দেয়নি। তবে এবার বিসিবি বিদেশি ক্রিকেটারকে যুক্ত করবে। পাশাপাশি তাদের পারিশ্রমিক ও সুযোগ সুবিধার বিষয়টিও দেখভাল করবে।

ঢাকা/ইয়াসিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ