ফ্রান্স কেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, আসল কারণ কী
Published: 29th, July 2025 GMT
ফ্রান্সের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ইন্দোনেশিয়া ‘শান্তির পথে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ’ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে। ভাসা ভাসাভাবে দেখতে গেলে, এই কূটনৈতিক সমর্থন ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের পক্ষে ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘদিনের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ফ্রান্সের এই ইঙ্গিতের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর ও বিপজ্জনক হিসাব–নিকাশ, যা কেবল বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে না, বরং সেটিকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ফ্রান্স যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটা মোটেই ন্যায়বিচার নয়। এটি স্বাধীনতাও নয়। এটি সেই পুরোনো বিভ্রমেরই আধুনিক সংস্করণ, যা দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের বন্দী ও ভূমিহীন করে রেখেছে। সেই তথাকথিত দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান।
জাকার্তার সরকারি বিবৃতিতে ফ্রান্সের পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে তার কারণ হলো একটি ‘সার্বভৌম ও স্বাধীন’ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সমর্থন করা হয়েছে। এর ভিত্তি হবে ১৯৬৭ সালের সীমানা এবং যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি কেমন ধরনের রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করছেন। একটি সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্রীকৃত ফিলিস্তিন, ইসরায়েলের স্বীকৃতি যেখানে থাকবে। মাখোঁর কল্পিত রাষ্ট্রে বসতি উচ্ছেদের কথা নেই, দখলকৃত ভূমিতে পুনর্বাসনের কথা নেই। এমনকি গাজায় যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহির কোনো বালাই নেই। শুধু একটি কূটনৈতিক তকমার বিনিময়ে একপেশে আত্মসমর্পণ।
এটি শান্তির পথে কোনো পদক্ষেপ নয়—এটি স্থায়ী দাসত্বের ছক।
ফ্রান্সের অবস্থান শুধু পক্ষপাতদুষ্টই নয়, এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ম্যাখোঁ ‘হামাসের নিরস্ত্রীকরণের’ আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে গাজা পুনর্গঠন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে ইসরায়েলের নিরস্ত্রীকরণ কোনো দাবি নেই, বেসামরিক মানুষ হত্যার জন্য কোনো জবাবদিহি নেই, আর ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত সার্বভৌমত্বের কোনো নিশ্চয়তাও নেই। বরং ফিলিস্তিনিদের বলা হচ্ছে প্রতিরোধ ত্যাগ করতে, অথচ দখলদার রাষ্ট্রটির ওপর দখল শেষ করার কোনো চাপই নেই।
এখন কূটনৈতিক নাটকের জন্য করতালি দেওয়ার দরকার নেই। এখন প্রয়োজন মিথ্যা সমাধানকে প্রত্যাখ্যান করা। এখন যে দ্বিরাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলা হচ্ছে, সেটা ন্যায়বিচারের পথ নয়। এটি এমন একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা কিনা উপনিবেশবাদকে সক্ষম করে তোলে।ইন্দোনেশিয়া যদি কোনো শর্ত ছাড়াই এই চুক্তিকে প্রশংসা করে, তবে সেটি এমন একটি কাঠামোকে সমর্থন করা হয়, যা কূটনীতির ভাষায় ফিলিস্তিনিদের অধিকার বিসর্জন দেওয়ার পথ খুলে দেয়। এভাবে, ইন্দোনেশিয়াও এমন এক প্রক্রিয়ার অংশ হচ্ছে, যা ইসরায়েলকে তার দীর্ঘস্থায়ী দখল ও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা চালিয়ে যেতে সহায়তা করে।
কারণ, আমরা গাজায় যা দেখছি, তা শুধু যুদ্ধ নয়—এটি একটি জাতিকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার একটি প্রক্রিয়া।
ইসরায়েলের নেতারা সংযমের কোনো ভান করছেন না। দেশটির অর্থমন্ত্রী বেজালেল বেজালেল স্মোট্রিচ ঘোষণা দিয়েছেন যে গাজাকে ‘পুরোপুরি ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া’ উচিত। ইসরায়েলের আইনসভা নেসেটের সদস্যরা এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা এই ভূখণ্ডকে ‘সমূলে উৎপাটন’ করার আহ্বান জানিয়েছেন। অনাহার, অবরোধ ও বোমাবর্ষণ কোনোটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এর পেছনে সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য আছে। লক্ষ্য শুধু শাস্তি দেওয়া নয়, বরং গাজাকে জনশূন্য করে ফেলা।
আর এই গণহত্যার আকাঙ্ক্ষাটা নতুন কিছু নয়। এটি ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থীদের দীর্ঘদিনের একটি নীলনকশার অংশ, যেটি ‘মহান ইসরায়েল’ প্রকল্প নামে পরিচিত। এই নীলনকশায় কেবল জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করাটাই উদ্দেশ্য নয়, এর বিস্তৃতি আরও বেশি। একটি বিশাল ভূখণ্ডে কেবল একটি জাতির নিয়ন্ত্রণে থাকার স্বপ্ন এখানে রয়েছে। এই মডেলে ফিলিস্তিনিরা নাগরিক বা প্রতিবেশী নয়, তারা এমন এক পথের কাঁটা, যাদেরকে তুলে ফেলতে হবে।
এই প্রেক্ষাপট থেকেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি ফ্রান্সের স্বীকৃতিকে বুঝতে হবে। এটি কোনো নীতিগত সাহসী সিদ্ধান্ত নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে একটি বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখার কূটনৈতিক কৌশল। সচেতনভাবে হোক আর অসচেতনভাবে হোক, এটি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশিয়া, ইসরায়েলি শাসকদের নৈতিক মনোবল সেটিকে গ্রহণ করে, সেই শাসনব্যবস্থার জন্য একটি নৈতিক বৈধতা তৈরি করে দিচ্ছে।
এত দুর্ভোগের মুখে, অগ্রগতির যেকোনো ইঙ্গিতকে স্বাগত জানানো প্রলুব্ধকর হতে পারে। কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া প্রতীকী স্বীকৃতি কেবল বিদ্যমান বৈষম্যকেই আরও শক্তিশালী করে। একটিকে যদি বলা হয় ‘রাষ্ট্র’, অথচ সেটি থাকবে ইসরায়েলি চেকপোস্টে ঘেরা, কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকবে না, থাকবে না ফেরার অধিকার—তাহলে তা প্রকৃতপক্ষে কোনো রাষ্ট্র নয়, বরং একটি খোলা আকাশের নিচের কারাগার, যার হাতে শুধু একটি পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছে।
গাজাবাসী যে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে আছে, তাতে কোনো অগ্রগতির আভাসকে স্বাগত জানানো যায় না। কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া কোনো প্রতীকী স্বীকৃতি বিদ্যমান বাস্তবতাকেই আরও শক্তিশালী করবে। সামরিক বাহিনীহীন ফিলিস্তিন! এর মানে হচ্ছে, ইসরায়েলি চেকপোস্টে ঘেরা একটি জায়গা, যাদের কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকবে না, থাকবে না সেখানে ফেরার অধিকার। এটি কোনো রাষ্ট্র নয়, এটি এমন এক খোলা কারাগার, যেখানে শুধু একটা পতাকা থাকবে।
এখন কূটনৈতিক নাটকের জন্য করতালি দেওয়ার দরকার নেই। এখন প্রয়োজন মিথ্যা সমাধানকে প্রত্যাখ্যান করা। এখন যে দ্বিরাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলা হচ্ছে, সেটা ন্যায়বিচারের পথ নয়। এটি এমন একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা কিনা উপনিবেশবাদকে সক্ষম করে তোলে।
মুহাম্মদ জুলফিকার রাহমাত সেন্টার ফর ইকোনমিকের ইন্দোনেশিয়া-মেনা ডেস্কের পরিচালক
মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইন দ ন শ য স ব গত জ ন ক টন ত ক ব যবস থ ইসর য় ল এমন এক র জন য ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিষ্ঠার দেড় যুগ পর ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছে বেরোবি
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ব্রাকসু) নিয়ে অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে শিক্ষার্থীদের। গত ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের গেজেট প্রকাশ হয়ছে গঠনতন্ত্র।
এরই মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর হতে যাচ্ছে কাঙিক্ষত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা ব্যাকসু নির্বাচন। তবে এর জন্য আমরণ অনশন থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মসুচিই পালন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
আরো পড়ুন:
‘আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে চাই’
বেরোবিতে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের মডেল প্রদর্শন
জুলাই অভ্যুত্থান পর গণরুম ও গেস্ট রুমের যে সাংস্কৃতি ছিল, তা এখন বন্ধ হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের কমকাণ্ডে সামিল হওয়াও বাধ্যতামুলক নয়।
তাই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ ছাত্র সংসদ। যাতে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বেরোবির বিধিমালা অনুযায়ী, ১৩টি পদে সরাসরি নির্বাচন ও হল সংসদে নয়টি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সব ধরনের কথা তুলে ধরতে পারবেন।
পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শেখর রায় বলেন, “সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও লেজুরবিত্তিক রাজনীতি ব্যতীত একটি নির্বাচন হোক। যোগ্য, আদর্শ, উত্তম চরিত্র ও মনের প্রার্থী বিজয়ী হোক। নির্বাচিত হয়ে তারা হয়ে উঠুক বেরোবির একেকজন যোগ্য প্রতিনিধি। তারা ন্যায়ের পক্ষে থাকুক । তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাক বেরোবি।”
গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জাওয়াদ সাজিদ বলেন, “ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের দাবি, অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার প্রধান মঞ্চ। এটি প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কণ্ঠ পৌঁছে যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে। কিন্তু এজন্য সংসদকে দলীয় প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। প্রকৃত অর্থে ছাত্র সংসদ তখনই সফল, যখন তা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের সমস্যার সমাধান ও কল্যাণে কাজ করে।”
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, “আমরা এমন ছাত্র সংসদ চাই, যেখানে যোগ্য নেতৃত্ব আসবে এবং সব শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হয়ে কাজ করবে। সবমিলিয়ে সবার বিশ্বস্ত জায়গা হবে এই ছাত্র সংসদ।”
ঢাকা/সাজ্জাদ/মেহেদী