গোলাম মুরশিদের কোন বইয়ের পুনঃসংস্করণ না হলে ধরে নিতে পারি, এই আত্মকথা ইতিকথা তাঁর সর্বশেষ রচনা। মুরশিদ দেশে ও দেশের বাইরে অত্যন্ত একনিষ্ঠ একজন গবেষক হিসেবে সুপরিচিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী রচনা করে মুরশিদ সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
আলোচ্য বইটিপ্রকাশিত হয়েছে মুরশিদের মৃত্যুর পর। তাঁর স্নেহভাজন ছাত্র স্বরোচিষ সরকার অন্য দুজনের সহায়তায় এ গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। যদিও ঠিক প্রচলিত অর্থে এ গ্রন্থকে মুরশিদের আত্মকথন বলা যাবে না। জীবনসায়াহ্নে মুরশিদ আত্মকথা রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু আরও সব তথ্য সাজিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটা গ্রন্থের অবয়ব দেওয়ার অবকাশ তাঁর আর জোটেনি।
এ গ্রন্থে ছোটবেলায় তাঁর মফস্সল থেকে ঢাকায় এসে পড়াশোনা এবং বিশেষত প্রবাসকালে বিবিসিতে চাকরি করার সুবাদে বহুবিচিত্র সব অভিজ্ঞতার বিবরণী পাঠককে বেশ চমৎকৃত করবে। গ্রন্থে মোট ৯টি অধ্যায় আছে। অবশ্য পূর্ব-প্রকাশিত ‘অশিক্ষার ইতিকথা’ ও ‘অসংবাদিকতার ইতিকথা’ নামের দুটি রচনা মাঝখানে অনুপ্রবিষ্ট না করালে এ গ্রন্থের আত্মকথনের সুরটা আরও পাঠসুখকর হতে পারত।
আত্মকথায় মুরশিদ মা ও বাবাকে নিয়ে যা লিখেছেন, তা তিনি মোটামুটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। আরও কিছুদিন তিনি বেঁচে থাকলে সমগ্র এক আত্মকথা পড়ার সুযোগ হতো আমাদের। তবে এ গ্রন্থে এই দুটি অধ্যায়ই সবচেয়ে সুখপাঠ্য। বাংলা সাহিত্যের যেসব সুখ্যাত আত্মজীবনী পাঠককে মুগ্ধ করে, তার সব কটিতেই ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে তৎকালীন সামাজিক অবস্থার বর্ণনা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকে। এই দুটি অধ্যায়েই সেই চিত্র পাওয়া যায়।
শৈশবের কথা, খুব কম বয়সে মাতৃহীন হওয়ার কথা, সেই কালে বরিশালের গ্রামীণ জীবন, একই সঙ্গে অশিক্ষা, ম্যালেরিয়া, বসন্ত ও কলেরা— এসব আক্ষরিক অর্থেই গ্রামের সমগ্র অধিবাসীকে মৃত্যুর মুখে টেনে নিয়ে যেত, এসব জানা যায় এই দুই অধ্যায় থেকে। পোস্ট অফিস থেকে ম্যালেরিয়ার কুইনিন পাওয়া যেত। সেই নীল রঙের ধাতব পোস্টার এখনো আমার মতো প্রবীণ ব্যক্তির চোখে ভেসে ওঠে; গ্রামের প্রধান যানবাহন নৌকা, একূল থেকে ওকূল দেখতে না পাওয়া নদীর বর্ণনা আমাদের মন ভরিয়ে দেয়। কিছুটা আত্মবিশ্বাসের অভাবে অন্য অনেক লেখকের মতো একদা ‘হাসান মুরশিদ’ ছদ্মনামে এই লেখক গল্প লিখতেন। সুতরাং একেবারেই গল্পকথনের ভঙ্গিতে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর আত্মকথাকে আরও সরস, তথ্যময় ও মনোরঞ্জক করে তুলতে পারতেন।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুরশিদ একান্তভাবে তাঁর শৈশবের নানা কথা, যার অধিকাংশই বিষাদময়, সেসব বিভিন্ন কাহিনি আমাকে গল্পের ছলে জানিয়েছিলেন। নিজ গ্রামের সঙ্গে তাঁর সখ্য তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি, তার কোনো সুযোগও ছিল না, মা-হারা হওয়ার পর তিনি নানির কাছে বড় হয়ে উঠেছিলেন।
এমন এক উদাস প্রান্তিক গ্রামীণ জীবন থেকে মুরশিদ ঢাকায় পড়তে এলেন। এই গ্রন্থে সেকালের ঢাকাকেও আমরা চিনতে পারি। তিনি প্রথমে রসায়নশাস্ত্র নিয়ে উচ্চশিক্ষা আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু বিষয়ের নাম যা–ই হোক, এই শাস্ত্র পড়াশোনায় তিনি তেমন রস খুঁজে পাননি। বেশ কিছুটা বিরতির পর তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন।
এ গ্রন্থের সম্পাদক আমারও স্নেহভাজন। আরেকটু পরিশ্রম করে মুরশিদের যখন পলাতক গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত অংশ অন্তর্ভুক্ত করা হলে তাঁর কলকাতা-বাস ও মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত থাকার বিষয়টি পাঠক জানতে পারতেন।
তবু মুরশিদের চলে যাওয়ার পর এই প্রকাশনাকেই আমি তাঁর প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বলে বিবেচনা করছি।
আত্মকথা ইতিকথা
গোলাম মুরশিদ
সম্পাদনা: স্বরোচিষ সরকার
প্রকাশক: অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; মূল্য: ৪০০ টাকা
পৃষ্ঠা: ১৯২; প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
গোলাম মুরশিদের আত্মকথন
গোলাম মুরশিদের কোন বইয়ের পুনঃসংস্করণ না হলে ধরে নিতে পারি, এই আত্মকথা ইতিকথা তাঁর সর্বশেষ রচনা। মুরশিদ দেশে ও দেশের বাইরে অত্যন্ত একনিষ্ঠ একজন গবেষক হিসেবে সুপরিচিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী রচনা করে মুরশিদ সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
আলোচ্য বইটিপ্রকাশিত হয়েছে মুরশিদের মৃত্যুর পর। তাঁর স্নেহভাজন ছাত্র স্বরোচিষ সরকার অন্য দুজনের সহায়তায় এ গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। যদিও ঠিক প্রচলিত অর্থে এ গ্রন্থকে মুরশিদের আত্মকথন বলা যাবে না। জীবনসায়াহ্নে মুরশিদ আত্মকথা রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু আরও সব তথ্য সাজিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটা গ্রন্থের অবয়ব দেওয়ার অবকাশ তাঁর আর জোটেনি।
এ গ্রন্থে ছোটবেলায় তাঁর মফস্সল থেকে ঢাকায় এসে পড়াশোনা এবং বিশেষত প্রবাসকালে বিবিসিতে চাকরি করার সুবাদে বহুবিচিত্র সব অভিজ্ঞতার বিবরণী পাঠককে বেশ চমৎকৃত করবে। গ্রন্থে মোট ৯টি অধ্যায় আছে। অবশ্য পূর্ব-প্রকাশিত ‘অশিক্ষার ইতিকথা’ ও ‘অসংবাদিকতার ইতিকথা’ নামের দুটি রচনা মাঝখানে অনুপ্রবিষ্ট না করালে এ গ্রন্থের আত্মকথনের সুরটা আরও পাঠসুখকর হতে পারত।
আত্মকথায় মুরশিদ মা ও বাবাকে নিয়ে যা লিখেছেন, তা তিনি মোটামুটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। আরও কিছুদিন তিনি বেঁচে থাকলে সমগ্র এক আত্মকথা পড়ার সুযোগ হতো আমাদের। তবে এ গ্রন্থে এই দুটি অধ্যায়ই সবচেয়ে সুখপাঠ্য। বাংলা সাহিত্যের যেসব সুখ্যাত আত্মজীবনী পাঠককে মুগ্ধ করে, তার সব কটিতেই ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে তৎকালীন সামাজিক অবস্থার বর্ণনা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকে। এই দুটি অধ্যায়েই সেই চিত্র পাওয়া যায়।
শৈশবের কথা, খুব কম বয়সে মাতৃহীন হওয়ার কথা, সেই কালে বরিশালের গ্রামীণ জীবন, একই সঙ্গে অশিক্ষা, ম্যালেরিয়া, বসন্ত ও কলেরা— এসব আক্ষরিক অর্থেই গ্রামের সমগ্র অধিবাসীকে মৃত্যুর মুখে টেনে নিয়ে যেত, এসব জানা যায় এই দুই অধ্যায় থেকে। পোস্ট অফিস থেকে ম্যালেরিয়ার কুইনিন পাওয়া যেত। সেই নীল রঙের ধাতব পোস্টার এখনো আমার মতো প্রবীণ ব্যক্তির চোখে ভেসে ওঠে; গ্রামের প্রধান যানবাহন নৌকা, একূল থেকে ওকূল দেখতে না পাওয়া নদীর বর্ণনা আমাদের মন ভরিয়ে দেয়। কিছুটা আত্মবিশ্বাসের অভাবে অন্য অনেক লেখকের মতো একদা ‘হাসান মুরশিদ’ ছদ্মনামে এই লেখক গল্প লিখতেন। সুতরাং একেবারেই গল্পকথনের ভঙ্গিতে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর আত্মকথাকে আরও সরস, তথ্যময় ও মনোরঞ্জক করে তুলতে পারতেন।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুরশিদ একান্তভাবে তাঁর শৈশবের নানা কথা, যার অধিকাংশই বিষাদময়, সেসব বিভিন্ন কাহিনি আমাকে গল্পের ছলে জানিয়েছিলেন। নিজ গ্রামের সঙ্গে তাঁর সখ্য তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি, তার কোনো সুযোগও ছিল না, মা-হারা হওয়ার পর তিনি নানির কাছে বড় হয়ে উঠেছিলেন।
এমন এক উদাস প্রান্তিক গ্রামীণ জীবন থেকে মুরশিদ ঢাকায় পড়তে এলেন। এই গ্রন্থে সেকালের ঢাকাকেও আমরা চিনতে পারি। তিনি প্রথমে রসায়নশাস্ত্র নিয়ে উচ্চশিক্ষা আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু বিষয়ের নাম যা–ই হোক, এই শাস্ত্র পড়াশোনায় তিনি তেমন রস খুঁজে পাননি। বেশ কিছুটা বিরতির পর তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন।
এ গ্রন্থের সম্পাদক আমারও স্নেহভাজন। আরেকটু পরিশ্রম করে মুরশিদের যখন পলাতক গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত অংশ অন্তর্ভুক্ত করা হলে তাঁর কলকাতা-বাস ও মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত থাকার বিষয়টি পাঠক জানতে পারতেন।
তবু মুরশিদের চলে যাওয়ার পর এই প্রকাশনাকেই আমি তাঁর প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বলে বিবেচনা করছি।
আত্মকথা ইতিকথা
গোলাম মুরশিদ
সম্পাদনা: স্বরোচিষ সরকার
প্রকাশক: অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; মূল্য: ৪০০ টাকা
পৃষ্ঠা: ১৯২; প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫