ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লুলার প্রতিবাদে অন্যরাও শামিল হোক
Published: 30th, July 2025 GMT
বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বিশ্বের কাছে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রধান রক্ষক ও মডেল হিসেবে তুলে ধরেছে। তবে বাস্তবে এই মূল্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রে দেশটি সব সময় সফল হয়নি। বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের নানা প্রান্তে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোকে সরিয়ে দিয়েছে। গ্রিস, ইরান, চিলি ইত্যাদি দেশে তারা সামরিক শাসকদের সমর্থন দিয়েছে, যাতে সেসব দেশে সমাজতন্ত্র বিস্তার লাভ করতে না পারে। আবার নিজেদের দেশেও যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে আফ্রিকান-আমেরিকানদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর এখন সুপ্রিম কোর্ট এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যা জাতিগত বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টাকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
সত্যি বলতে কি, যুক্তরাষ্ট্র অতীতে যে আদর্শ প্রচার করেছে, তা সে সব সময় নিজেই মানেনি। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই আদর্শিক বিচ্যুতি স্পষ্ট ও প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। তিনি কেবল ওই মূল্যবোধগুলোকে উপেক্ষা করেননি; বরং সেগুলোর বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প আইনের শাসনের প্রতি কোনো সম্মান দেখাননি। তাঁর শাসনামলের সবচেয়ে ভয়ানক দৃষ্টান্ত হলো, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবনে (ক্যাপিটল) তাঁর সমর্থকদের হামলা। ওই হামলার উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের ফল বদলে দেওয়া এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি জিতেছেন, যদিও প্রকৃত ফলাফলে জো বাইডেন প্রায় ৭০ লাখ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন। ৬০টির বেশি আদালত এ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও বৈধতা নিশ্চিত করেছেন।
ট্রাম্পকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা হয়তো তাঁর এমন আচরণে অবাক হননি। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো, এখনো ৭০ শতাংশ রিপাবলিকান সমর্থক বিশ্বাস করেন, নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছিল। অনেক মার্কিন আজ মিথ্যা তথ্য, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ও বিকৃত বাস্তবতার জগতে বাস করছেন, যেখানে গণতন্ত্র বা আইনের শাসনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তথাকথিত ‘মার্কিন জীবনধারা’ রক্ষা করা। এই ‘জীবনধারা’ আসলে একধরনের শ্রেষ্ঠত্ববাদ। বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ, পুরুষ, খ্রিষ্টানদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখাকেই তাঁরা ‘মার্কিন জীবনধারা’ বলে মনে করছেন।
এই বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র এখন এমন এক দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে এবং একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা মাথাচাড়া দিচ্ছে। বিশ্বে অনেক স্বৈরশাসক এই পরিস্থিতি দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন। যেমন ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো যুক্তরাষ্ট্রের ৬ জানুয়ারির ঘটনার অনুকরণে ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় একই ধরনের এক হামলা ঘটাতে চেয়েছিলেন, যাতে নির্বাচনের ফল বদলানো যায়। তবে সৌভাগ্যক্রমে ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ পর্যন্ত টিকে গেছে এবং এখন বলসোনারোর বিচার চলছে।
ব্রাজিলের এই বিচারিক পদক্ষেপের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিচার ঠেকাতে তাঁর দল নানা চেষ্টা করছে। ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট হতে চান এবং তিনি প্রকাশ্যে বলছেন, তিনি আইনের শাসনের চেয়ে নিজের ইচ্ছাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন। তিনি বাণিজ্য চুক্তি ভেঙেছেন এবং বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, ব্রাজিল যদি বলসোনারোর বিচার না থামায়, তাহলে ব্রাজিলের রপ্তানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসাবেন।
বিশ্বে এখন এমন এক সময় চলছে, যখন ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এমন সময়েই ব্রাজিল আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি নিজেদের দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। লুলার সরকার বিশ্বকে দেখাচ্ছে, একটি রাষ্ট্র কীভাবে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে বিচারবহির্ভূত চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট একা শুল্ক বসানোর ক্ষমতা রাখেন না। এই ক্ষমতা আছে শুধু কংগ্রেসের। অর্থাৎ ট্রাম্প কেবল নিজ দেশের আইন লঙ্ঘন করছেন না, তিনি অন্য দেশকেও তাঁদের বিচারব্যবস্থা থামাতে বাধ্য করতে চাইছেন। অথচ ব্রাজিল যা করছে, তা সংবিধান মেনেই করছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাবেক প্রেসিডেন্টকেও বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে, যদি তিনি অপরাধে জড়িত থাকেন।
যা ব্রাজিল করছে, তা যুক্তরাষ্ট্রে যা হয়েছে, তার থেকে একদম আলাদা।
যুক্তরাষ্ট্রে ৬ জানুয়ারির পার্লামেন্ট হামলায় যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের বিচারপ্রক্রিয়া ধীরে হলেও সঠিক পথে এগোচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এমনকি যাঁরা সবচেয়ে বেশি সহিংস ছিলেন, তাঁদেরও। তিনি এমন লোকদেরও ক্ষমা করে দেন, যাঁরা একটি হামলায় জড়িত ছিলেন। ওই হামলায় পাঁচজন মারা যান এবং ১০০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য আহত হন। ট্রাম্পের চোখে এই অপরাধ কোনো অপরাধই ছিল না।
এমন অবস্থায় ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা ট্রাম্পের হুমকিকে জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো বিদেশি প্রেসিডেন্ট আমাকে বলে দিতে পারেন না, কী করতে হবে।’ তিনি স্পষ্টভাবে ট্রাম্পের বাণিজ্য হুমকিকে ‘অযাচিত ব্ল্যাকমেল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
লুলা শুধু বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নয়, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মার্কিন নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধেও সোচ্চার। তিনি মনে করেন, ব্রাজিলের ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন চালু থাকা উচিত। কারণ, মার্কিন টেক কোম্পানিগুলো অনেক সময় মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয় এবং বিদেশি রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে।
বিশ্বে এখন এমন এক সময় চলছে, যখন ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এমন সময়েই ব্রাজিল আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি নিজেদের দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। লুলার সরকার বিশ্বকে দেখাচ্ছে, একটি রাষ্ট্র কীভাবে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে বিচারবহির্ভূত চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।
এ দৃষ্টান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ট্রাম্প কেবল যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ধ্বংস করছেন না, তিনি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও স্বৈরাচার ও অনিয়মকে উৎসাহিত করছেন। তাঁকে বিশ্বজুড়ে এই কাজ করতে দেওয়া উচিত নয়। ব্রাজিল যেভাবে প্রতিবাদ করেছে, অন্য দেশগুলোকেও সেই সাহসিকতা দেখাতে হবে।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী। তিনি বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র গণত ন ত র ক গণতন ত র কর ছ ন র গণত ক ষমত করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান
ঢাকা-৮ আসনে দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য আকবর খান। তিনি বলেন, “ভোটের অধিকার জনগণের পবিত্র আমানত, এটি সচেতনভাবে প্রয়োগ করতে হবে।”
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা জননেতা সাইফুল হক-এর ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচনী গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচিতে তিনি একথা বলেন।
গণসংযোগের শুরুতে ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাকের সভাপতিত্বে এক সংক্ষিপ্ত পথসভা হয়।
সেখানে আকবর খান বলেন, “নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে অবিলম্বে ভোটের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে—২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে—ঢাকা-৮ আসনের বহু নাগরিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যে তরুণের এখন বয়স ২৫ বা ২৬, তারা কখনো ভোট দিতে পারেনি, ভোট কী তা জানে না- এটি গণতন্ত্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।”
তিনি আরো বলেন, “গত ১৬-১৭ বছর ধরে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমাদের নেতা সাইফুল হক জনগণের ভোটাধিকারের আন্দোলনে রাজপথে সংগ্রাম করে আসছেন। এর জন্য জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য করেও তিনি থেমে থাকেননি। ভোটাধিকার গণমানুষের দীর্ঘ লড়াই ও ত্যাগের ফসল। এই অধিকার ভুল ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।”
আকবর খান বলেন, “জননেতা সাইফুল হক গণমানুষের পরীক্ষিত নেতা। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের জনগণ যেন তাকে ভোট দিয়ে নিজেদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ও দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস সংসদে তুলে ধরার সুযোগ করে দেন- এটাই আমাদের আহ্বান।”
গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচি বাংলাদেশ ব্যাংক এলাকা থেকে শুরু হয়ে মতিঝিল, কমলাপুর, ফকিরাপুল, কালভার্ট রোড হয়ে বিজয়নগরে এসে শেষ হয়। এতে শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন।
কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সিকদার হারুন মাহমুদ, মীর রেজাউল আলম, কবি জামাল সিকদার, ফাইজুর রহমান মুনির, বাবর চৌধুরী, মহানগর নেতা যুবরান আলী জুয়েল, সালাউদ্দিন, রিয়েল মাতবর, আরিফুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু, গোলাম রাজিব, মাহমুদুল হাসান খান, ফয়েজ ইবনে জাফর, নান্টু দাস, শিবু মহন্ত ও হুমায়ুন কবির প্রমুখ।
ঢাকা/এএএম/এস