ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে নিয়ে আসা পুরোনো স্যুটকেস ঘাঁটতে গিয়ে একদিন একটা হলুদ খাম হাতে আসে। খুলতেই বেরিয়ে আসে একটি চিঠি, সাল ১৯৮৮। লেখাটা আমার নয়, সমাজবিজ্ঞানের এজরার। ওপরে সে লিখেছিল, ‘যদি একদিন ভুলে যাই, এইটুকু মনে রেখো—রোকেয়া হলের মাঠে দাঁড়িয়ে ঈদের সেমাই খাওয়ার মতো সম্পর্ক আর কখনো হবে না।’
সত্যিই তো, হয় না। আমাদের যৌবনের প্রতিটি দিন ছিল অনাড়ম্বর, অথচ গভীর এক মায়ার ভেতর বাঁধা। ক্লাস, রাজনীতি, লাইব্রেরি, টিউশনির টাকায় মাস চালানো, স্বপ্ন বোনা—সবই ছিল একসঙ্গে।
তবু কিছু মুহূর্ত অতিরিক্ত আলাদা হয়ে থাকে। যেমন ১৯৮৮ সালের সেই ঈদের সকাল।
সেবার ভয়াবহ বন্যায় আমি আর জেবা বাড়ি যেতে পারিনি। আমি ছিলাম যশোরের। পুরো অঞ্চলটি তখন পানির নিচে। জেবা দিনাজপুরের। ওর ট্রেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এজরা আর আসমা হলে রয়ে গিয়েছিল পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। ঈদের সকালে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, আসমা হলের মাঠে, হাতে স্টিলের হাঁড়ি। নিচু গলায় বলল, ‘ঘুমাচ্ছিস? ওঠ, সেমাই করেছি। আজ আর ক্যানটিনে খাব না।’ ওর মুখে ঈদের প্রশান্তি, কিন্তু চোখে একচিলতে বিষণ্নতা। বাড়ি না যেতে পারার ক্ষীণ ছায়া যেন।
আমি তাড়াতাড়ি কেটলি আর কয়েকটা কাপ নিয়ে হলের মাঠে চলে গেলাম। ওখানে দেখি, এজরা আগে থেকেই বসে আছে একটা পুরোনো বইয়ের পাতা ধরে। মুখ না তুলেই বলল, ‘তোমরা সত্যি সত্যি সেমাই নিয়ে এসেছ? দেশের অর্ধেক পানির নিচে অথচ সরকার কিছু বলছে না—এ নিয়ে কেউ প্রশ্নও তুলছে না!’ জেবা কিছুক্ষণ পর এসে হেসে বলল, ‘ঈদের দিনেও তুই মানবাধিকার নিয়ে তর্ক করবি? আয়, আগে খেয়ে নিস।’
চারজনে মাঠের এক কোনায় বসলাম। হাঁড়ির ঢাকনা খুলতেই মিষ্টি ঘ্রাণে মাঠটা ভরে গেল। আমি কেটলি থেকে গরম চা ঢাললাম। কিছুক্ষণ চুপ করে সবাই একসঙ্গে সেই ঈদের সকালে বসে রইলাম। মাঠের এক পাশে পুরোনো টবে ফুটে ছিল লালরঙা একটি ফুল। আসমা তাকিয়ে বলল, ‘জানি না কী ফুল। আমি একে বলি ঈদের ফুল। ও শুধু ঈদের সকালেই ফোটে।’
ওর কথাটা আমাদের নিঃশব্দ করে দিল। সত্যিই তো, যেন আমাদের জন্যই সেই ফুল ফুটেছে, এই মাঠের প্রান্তে। ঠিক তখনই নিচ থেকে ভেসে এল হলের দাদুর চেনা কণ্ঠ, ‘সবাই পাত্র নিয়ে নিচে চলে আসো! ঈদের সেমাই দিচ্ছে ক্যানটিনে।’ আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে ফেলি। এজরা হালকা গলায় বলল, ‘সেমাই তো আমরাও দিচ্ছি—বন্ধুত্বের।’
সেই ঈদের কোনো ছবি নেই। কিন্তু মনে আছে, আসমার চুলে লেগে থাকা দুধের গন্ধ, জেবার হো হো করে হেসে ওঠা আর এজরার বইয়ের পাতায় পড়ে থাকা রোদের দাগ।
২.
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হলে আমরা চারদিকে ছড়িয়ে যাই। জেবা এখন স্কুলে ইতিহাস পড়ায়, এজরা একটি উন্নয়ন সংস্থায় গবেষণা করে আর আসমা কাজ করে এক পরিবেশ প্রকল্পে। আমি বিমা প্রতিষ্ঠানের চাকরি থেকে কিছুটা আগেই অবসরজীবন বেছে নিয়েছি।
আমরা এখনো যোগাযোগ রাখি—হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে। তবু হলের মাঠে বসে সেই ভাগাভাগি করা নির্ভরতাটুকু, একসঙ্গে চা আর সেমাই খাওয়ার মুহূর্ত আর কখনো ফিরে আসেনি।
চিঠিটার শেষে এজরা লিখেছিল, ‘ভালোবাসা মানে বড় কিছু নয়। মাঝে মাঝে সেটা হয় একটু গরম সেমাই, ঈদের সকালে, চারজনের একসঙ্গে ভাগ করে খাওয়া।’
এখনো মনে হয়—সেদিন আমরা শুধু ঈদ করিনি, জীবনের এক নির্ভেজাল আনন্দটুকু হলের মাঠের কিনারায় রেখে এসেছিলাম।
মাহবুব আরা, সড়ক–৮, নিকেতন, গুলশান, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হল র ম ঠ একসঙ গ ঈদ র স
এছাড়াও পড়ুন:
৭ উপাচার্যের অংশগ্রহণে গোবিপ্রবিতে শিক্ষা সমাপনী
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গোবিপ্রবি) নবম ব্যাচের (নবনীতক ৯) শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষা সমাপনী-২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীদের বিদায় বেলায় এক মঞ্চে আসীন হন দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান সাত উপাচার্য।
বুধবার (৩০ জুলাই) দুপুর ১২টায় একাডেমিক ভবন প্রাঙ্গণে আনন্দঘন পরিবেশে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর ছাড়াও অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী, খুলনা কৃষি বিশ্বিবদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নাজমুল আহসান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এম সরওয়ারউদ্দিন চৌধুরী, পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম আব্দুল আওয়াল, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দিন তারেক।
আরো পড়ুন:
নতুনবাজারের সেই রনির বুলেটের যন্ত্রণা আজো থামেনি
শিশু ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন, মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা
এক মঞ্চে একইসঙ্গে এতজন উপাচার্যকে পেয়ে সমাপনী ব্যাচসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, “এভাবে একসঙ্গে পুরো সেশনের শিক্ষা সমাপনী আয়োজনের আইডিয়াটি অত্যন্ত চমৎকার। এতে করে একটি ব্যাচের একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ ঘটে। যেখানে সবার একসঙ্গে পরীক্ষা হয়, রেজাল্ট প্রকাশ হয় এবং কোনো সেশন জট থাকে না। আমি এই আইডিয়াটি আমার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।”
খুলনা কৃষি বিশ্বিবদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নাজমুল আহসান বলেন, “আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ এখানে এসেছি সংহতি জানানোর জন্য। আমি নবম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জীবনে সফলতা কামনা করছি।”
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এম সরওয়ারউদ্দিন চৌধুরী বলেন, “শিক্ষার্থীদের বিসিএস দেওয়া, বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করা বা ব্যবসা করার লক্ষ্য থাকে। তবে জীবনে কোনো না কোনো কিছু করতেই হবে। এক্ষেত্রে অবসর বলে কোনো শব্দ থাকা উচিত নয়।”
পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, “আমি যখন দেশের বাইরে পড়াশোনা করতাম, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে আমি কখনোই দেখিনি। আর বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে কখনো একসঙ্গে সাতজন উপাচার্যকেও বসতে দেখিনি, এটা অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর করে দেখিয়েছেন।”
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম আব্দুল আওয়াল বলেন, “আমরা যদি আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করি, আমাদের চাকরি খোঁজার পাশাপাশি এমন কিছু করার মানসিকতা রাখতে হবে, যা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।”
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আতিয়ার রহমান বলেন, “শিক্ষা সমাপনী মানেই সব সম্পর্ক ছিন্ন করা নয়। বিশ্বে এমন অনেক নজির আছে, যেখানে অ্যালামনাই থেকে উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে। তাই নিজেকে বিস্তৃত পরিসরে মেলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ উজ্জ্বল করার দায়িত্ব নিতে হবে।”
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “নিজেকে চেনাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। আর শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনই বলে দেবে, তারা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কতটা জ্ঞান অর্জন করেছে।”
প্রধান অতিথিরি বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর আগত উপাচার্যদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্যই আমাদের এই প্রয়াস। একইসঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি তুলে ধরাও আমাদের লক্ষ্য। আমরা জানিয়ে দিতে চাই, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায় এবং অচিরে দাঁড়াবেই।”
তিনি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে ইউজিসির দুইটি হিট প্রকল্প পেয়েছি এবং ভবিষ্যতে আরো পাব। আমরা আশা করছি, বি ক্যাটাগরি থেকে আগামী অর্থবছরের আগেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি এ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হবে।”
গোবিপ্রবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সোহেল হাসানের সভাপতিত্বে এতে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজমুল আহসানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক, সব অনুষদের ডিন, বিভাগীয় সভাপতি ও প্রাধ্যক্ষগণ, দপ্তর প্রধানগণ, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে, জুলাই শহিদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়।
শিক্ষা সমাপনী উপলক্ষে বুধবার ছাত্রদের কালার ফেস্ট ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা এবং আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) সন্ধ্যায় একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে।
ঢাকা/রিশাদ/মেহেদী