পশ্চিমা দুনিয়ায় অপরিচিত যে রোগ নিয়ে বিল গেটস লিখেছেন
Published: 2nd, August 2025 GMT
অ্যাডিরনড্যাক চেয়ার, স্টেটসন টুপি, পাসাডেনা শহর এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে কোনো মিল কি রয়েছে? লেখক জন গ্রিনের মতে, এসবের উৎপত্তির গল্পে যক্ষ্মার উপস্থিতি রয়েছে। জন গ্রিন তাঁর নতুন বইয়ে যুক্তি দিয়ে লিখেছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক এই রোগকে ইতিহাসের বাকি অংশ থেকে আলাদা করা বেশ অসম্ভব। অ্যাডিরনড্যাক চেয়ার এমন এক ব্যক্তি ডিজাইন করেছিলেন, যিনি নিউইয়র্কের পাহাড়ে ছুটি কাটাতেন। এই এলাকা যক্ষ্মা (টিউবারকিউলোসিস বা টিবি) রোগীদের জন্য তাজা বাতাসের জনপ্রিয় স্থান ছিল। এই চেয়ার খুব দ্রুতই পুরো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্যানেটোরিয়ামের বারান্দার প্রধান আসবাব হয়ে দাঁড়ায়।
আরেকজন উদ্ভাবক জন বি স্টেটসন যক্ষ্মা রোগে ভুগছিলেন। তিনি পাহাড়ি বাতাসের জন্য পশ্চিম এলাকায় ভ্রমণ করেছিলেন। রোদ, বাতাস ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি কাউবয় টুপি আবিষ্কার করেন। ১৮০০ সালের শেষের দিকে পাসাডেনা যক্ষ্মা চিকিৎসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। যক্ষ্মানির্ভর পর্যটন শহর হিসেবে শহরের অর্থনীতি, আবাসন ব্যবসা ও পরিচয়ের প্রধান চালিকা শক্তি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডকে হত্যাকারী কিশোর হত্যাকারীরাও যক্ষ্মায় আক্রান্ত ছিল। তাঁরা যক্ষ্মায় মৃত্যুর বদলে দ্রুত মৃত্যুবরণ করতে আরও বেশি আগ্রহী ছিল।
এসব পড়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। জন গ্রিন তাঁর বইয়ে যক্ষ্মা নিয়েই সবকিছু যুক্ত করেছেন। অনেক দিক থেকে যক্ষ্মা রোগের কারণে আমাদের বাসস্থান বর্তমান রূপ পেয়েছে। যদিও ধনী দেশে এই রোগ এখন বিরল ও চিকিৎসাযোগ্য। অন্যদিকে দরিদ্র দেশে এই রোগ ক্রমবর্ধমান ও এখনো অনেকের জন্য মৃত্যুদণ্ডই বটে। জন গ্রিন সর্বকালের সেরা কিছু তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাসের লেখক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। অন্তত আমার মেয়ে ফিবির তাই মনে করেন। ফিবির উৎসাহ আমি ‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস’ ও ‘টার্টলস অল দ্য ওয়ে ডাউন’ উপন্যাস পড়েছি। অনেকেই অবাক হয়েছিলেন যখন জন গ্রিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্পর্কে নতুন বইয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যক্ষ্মা এমন একটি রোগ, যা পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ অতীত কালের রোগ মনে করে।
আমি অবশ্য এমন মনে করিনি। আমি প্রায় এক দশক আগে জনের সঙ্গে প্রথম দেখা করি। সে আমার সঙ্গে গেটস ফাউন্ডেশনের কাজে ইথিওপিয়া ভ্রমণে যুক্ত হয়। ভ্রমণের সময় আমরা অনেক আলোচনা করেছি। ‘এভরিথিং ইজ টিউবারকিউলোসিস’ বইয়ে জন যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন, তা নিয়ে আলোচনা করেছি। কেন ব্যক্তির জন্মস্থান তার শৈশব বা সন্তান জন্মদানের বিষয়টি তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে কতটা প্রভাবিত করে? আমাদের মতো মানুষেরা এই সম্ভাবনা বাড়াতে কী করতে পারি?
সেই থেকে জন গ্রিন আমাদের ফাউন্ডেশনের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে কৌতূহল ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছেন। তিনি নিজেই এখন বিশ্ব স্বাস্থ্যের শক্তিশালী সমর্থক হয়ে উঠেছেন। আমি এমন আর কাউকে চিনি না, যিনি যক্ষ্মা–সম্পর্কিত একটি বইকে নিউইয়র্ক টাইমসের সেরা বিক্রীত বইয়ের তালিকায় নিতে পেরেছেন।
বইটি মর্মস্পর্শী আবার বুদ্ধিদীপ্ত হলেও মাঝেমধ্যে বিরক্তিকর। বইটিতে হেনরি নামের এক ছেলের গল্প আছে। হেনরির সঙ্গে জন সিয়েরা লিওনের একটি টিবি ক্লিনিকে দেখা করেন। হেনরির বয়স যখন মাত্র ছয় বছর, তখন তার যক্ষ্মার লক্ষণ দেখা যায়। হেনরির তখন ক্লান্তি, ওজন হ্রাস আর রাতের ঘাম দেখা যেত। প্রথম পরীক্ষায় যক্ষ্মা ধরা পড়েনি বলে হেনরিকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যখন তার রোগনির্ণয় করা হয়, তখন হেনরি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।
হেনরিকে কয়েক দশক ধরে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়। এই পদ্ধতি বেশ নিষ্ঠুর পদ্ধতি। মাসের পর মাস বড়ি, বেদনাদায়ক ইনজেকশন দিলেও ক্রমাগত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সংক্রমণের মাত্রা কমতে শুরু করলে তীব্র ক্ষুধার্ত ভাব হয়। ওষুধ কেবল তখনই কাজ করে, যদি তা ধারাবাহিকভাবে ও সময়সূচি অনুসারে নেওয়া হয়। রোগীদের জন্য এমন নিয়ম মানা প্রায়ই অবাস্তব। বিশ্বের বেশির ভাগ জায়গায় যক্ষ্মা চিকিৎসার অর্থ হলো ক্লিনিকের জন্য হেঁটে যাওয়া। কাজ বা স্কুল মিস হয়। রোগীরা ঋণে ডুবে যায়। সামাজিক কলঙ্ক আর বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হওয়া। শিশু হেনরির মা তাকে সমর্থন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। চেষ্টা থাকলেও চিকিৎসায় বাধা দেখা যায়। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় হেনরি।
শেষ পর্যন্ত হেনরির ভাগ্য ভালো ছিল। অসুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসার বিকল্প ব্যবস্থা বন্ধ হলেও চিকিৎসকেরা তাকে ছেড়ে দেননি। তার জন্য বিশেষ ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়। সেই ওষুধ দরিদ্র দেশে শিশুরা কম পায়। সেই ওষুধের জন্য তার জীবন বেঁচে যায়। আজ হেনরির উন্নতি হয়েছে। বছরের পর বছর হাসপাতালে আটকে থাকার পর সে এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার একটি ইউটিউব চ্যানেলও রয়েছে। যেখানে হেনরি তার কথা প্রকাশ করছে। অন্য যক্ষ্মা রোগীদের জন্য কথা বলছে। জন তাঁর বইয়ে হেনরির গল্পকে কোনো অলৌকিক ঘটনা হিসেবে বা রোমান্টিকভাবে উপস্থাপন করেননি। তিনি প্রমাণ হিসেবে লিখেছেন। যক্ষ্মা নিরাময়যোগ্য, ভালো যত্নে যক্ষ্মা রোগী ভালো হয়। আসল প্রশ্ন হলো আমরা জীবন বাঁচাতে চাই কি না? আমরা চিকিৎসাকে সবার জন্য সুযোগ দিতে ইচ্ছুক কি না।
জন গ্রিন গত বছর বইটি লেখা শেষ করেছেন। এখনকার যক্ষ্মার তাৎপর্য তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ধনী দেশে বেশির ভাগ মানুষ যে রোগটি ভুলে গেছেন, তা এখনো বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করছে। খুব সহজেই এই সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই আশঙ্কা সত্যি। বৈদেশিক সাহায্যের কাটছাঁটের ফলে বিশ্বজুড়ে যক্ষ্মা চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। শিশু হেনরি হয়তো আজ বেঁচে থাকত না যদি পার্টনার্স ইন হেলথের মতো সংস্থা না থাকত। সংস্থাটি আংশিকভাবে মার্কিন স্বাস্থ্য সহায়তার অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছিল। এই সংস্থা হেনরিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে লড়াই করেছিল। সাহায্য কাটছাঁটের কারণে শিশু হেনরির মতো অনেক শিশুর ক্ষতি হবে। অনেক শিশু সম্পূর্ণরূপে চিকিৎসার সুযোগ হারাতে পারে। এর ফলে চিকিৎসা ব্যাহত হবে। আরও বেশি সংক্রমণের কেস দেখা যাবে। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা ও বেশি সংক্রামক রোগের ধরন তৈরি হবে। সারা বিশ্বের জন্য যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ও ব্যয়বহুল হবে।
আজকের বিশ্ব স্বাস্থ্যের কেন্দ্রীয় চ্যালেঞ্জ সম্পর্কেই লিখেছেন জন। জনের ভাষায়, যেখানে রোগ নেই, সেখানে নিরাময়সেবা আছে। যেখানে প্রতিকার নেই, সেখানেই এই রোগ উপস্থিত। যক্ষ্মা সম্পর্কে একটি বই বেশ বিরক্তিকর হতে পারে। লেখক জন তাঁর বইকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। যক্ষ্মা রোগের দীর্ঘ আর অদ্ভুত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। যক্ষ্মা নিয়ে মিথের মধ্যে আছে এ রোগ কেবল শ্বেতাঙ্গদের আক্রমণ করে। আবার এই রোগ নিয়ে এমনও তত্ত্ব রয়েছে, এই রোগ সৃজনশীল প্রতিভাকে অনুপ্রাণিত করে। এই রোগের ভিক্টোরিয়ান সময়ে সৌন্দর্যের মানদণ্ডের ওপর প্রভাব ছিল। শেষ দুটি তথ্য সম্পর্কে আমি জানতাম না। আমি স্টেটসন টুপি সম্পর্কেও জানতাম না। যদি আপনি জনের কাজের সঙ্গে পরিচিত হন, তাহলে এমন লেখার পদ্ধতি আপনাকে অবাক করবে না। পাঠকের সামনে এমন জিনিস সম্পর্কে যত্নশীল করে তোলার ক্ষেত্রে তার অনন্য প্রতিভা রয়েছে। পাঠক যেন এই বিষয় আমার জন্য না, এমনটা মনে করতে পারেন না। কবিতা হোক বা জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা সংক্রামক রোগসংক্রান্ত যেকোনো বিষয় হোক না কেন।
জন একটি আহ্বানের মাধ্যমে তাঁর ‘এভরিথিং ইজ টিউবারকিউলোসিস’ বইটি শেষ করেছেন। তাঁর যুক্তি, যক্ষ্মা থেকে জীবন বাঁচানো আসলে আর কোনো বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ নয়। এটি একটি নৈতিক চ্যালেঞ্জ। আমি তাঁর সঙ্গে একমত। আমি মনে করি, বইটিতে যা বলা হয়েছে, তার চেয়ে অবশ্য অনেক আশাবাদী কারণ রয়েছে। জন গ্রিন অতীত ও বর্তমানের ব্যর্থতা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানেন। এই রোগের চিকিৎসায় অগ্রগতির ক্ষেত্রে ধীরগতি আছে। নতুন যক্ষ্মা রোগের ওষুধের আকাশছোঁয়া দাম দেখা যায়। কে চিকিৎসা পাবে আর কে করবে না, তার ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। সামনে কী হবে, তা নিয়ে জন তেমন লেখেননি। আড়াই দশক ধরে গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার পেছনে বিনিয়োগ করছি আমরা। আমি গল্পের একটি ভিন্ন দিক দেখেছি। আমি জানি সামনে কী আছে ও জানি কী সম্ভব।
আমরা এমন সাফল্যের কাছাকাছি আছি, যা আমাদের চিকিৎসা ও প্রতিরোধের বিষয়ে সবকিছু পরিবর্তন করতে পারে। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ওষুধ ব্যবস্থা, উন্নত রোগনির্ণয় ও টিকা নিয়ে কাজ হচ্ছে। এসব পরিবর্তন তখনই পার্থক্য আনবে, যদি তা আমরা হেনরির মতো শিশুর কাছে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট দ্রুত কাজ করি। ওষুধের মূল্যের জন্য প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানি বিদ্রূপের শিকার হচ্ছে। অথচ এসব কোম্পানি যক্ষ্মা চিকিৎসায় বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক। আমাদের তাদের সঙ্গে অংশীদার হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। উদ্ভাবন অব্যাহত রাখতে হবে ও খরচ কমাতে হবে। যদি আমরা সেই পথে চলি, তাহলে আমরা হেনরির বেঁচে থাকাকে স্বাভাবিক ভাবতে পারব। যক্ষ্মাকে তখন পুরোনো রোগে পরিণত করতে পারব।
সূত্র: গেটস নোটস
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: জাহিদ হোসাইন খান
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জন গ র ন র জন য এই র গ আম দ র কর ছ ল ব যবস প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
উৎসব ঘুরে প্রেক্ষাগৃহে ‘বাড়ির নাম শাহানা’
কৈশোর পেরোনোর আগেই শাহানাবাড়ির মেয়ে দীপার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর নির্যাতনের জাল ছিঁড়ে নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের পটভূমিতে দীপার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে বাড়ির নাম শাহানা।
সত্য কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত বাড়ির নাম শাহানায় দীপা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনান সিদ্দিকা। ছবিটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে কমলা কালেক্টিভ ও গুপী বাঘা প্রোডাকশন্স লিমিটেড।
নির্মাণের বাইরে লীসা গাজী লেখক, নাট্যকর্মী হিসেবে পরিচিত