অ্যাডিরনড্যাক চেয়ার, স্টেটসন টুপি, পাসাডেনা শহর এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে কোনো মিল কি রয়েছে? লেখক জন গ্রিনের মতে, এসবের উৎপত্তির গল্পে যক্ষ্মার উপস্থিতি রয়েছে। জন গ্রিন তাঁর নতুন বইয়ে যুক্তি দিয়ে লিখেছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক এই রোগকে ইতিহাসের বাকি অংশ থেকে আলাদা করা বেশ অসম্ভব। অ্যাডিরনড্যাক চেয়ার এমন এক ব্যক্তি ডিজাইন করেছিলেন, যিনি নিউইয়র্কের পাহাড়ে ছুটি কাটাতেন। এই এলাকা যক্ষ্মা (টিউবারকিউলোসিস বা টিবি) রোগীদের জন্য তাজা বাতাসের জনপ্রিয় স্থান ছিল। এই চেয়ার খুব দ্রুতই পুরো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্যানেটোরিয়ামের বারান্দার প্রধান আসবাব হয়ে দাঁড়ায়।

আরেকজন উদ্ভাবক জন বি স্টেটসন যক্ষ্মা রোগে ভুগছিলেন। তিনি পাহাড়ি বাতাসের জন্য পশ্চিম এলাকায় ভ্রমণ করেছিলেন। রোদ, বাতাস ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি কাউবয় টুপি আবিষ্কার করেন। ১৮০০ সালের শেষের দিকে পাসাডেনা যক্ষ্মা চিকিৎসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। যক্ষ্মানির্ভর পর্যটন শহর হিসেবে শহরের অর্থনীতি, আবাসন ব্যবসা ও পরিচয়ের প্রধান চালিকা শক্তি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডকে হত্যাকারী কিশোর হত্যাকারীরাও যক্ষ্মায় আক্রান্ত ছিল। তাঁরা যক্ষ্মায় মৃত্যুর বদলে দ্রুত মৃত্যুবরণ করতে আরও বেশি আগ্রহী ছিল।

এসব পড়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। জন গ্রিন তাঁর বইয়ে যক্ষ্মা নিয়েই সবকিছু যুক্ত করেছেন। অনেক দিক থেকে যক্ষ্মা রোগের কারণে আমাদের বাসস্থান বর্তমান রূপ পেয়েছে। যদিও ধনী দেশে এই রোগ এখন বিরল ও চিকিৎসাযোগ্য। অন্যদিকে দরিদ্র দেশে এই রোগ ক্রমবর্ধমান ও এখনো অনেকের জন্য মৃত্যুদণ্ডই বটে। জন গ্রিন সর্বকালের সেরা কিছু তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাসের লেখক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। অন্তত আমার মেয়ে ফিবির তাই মনে করেন। ফিবির উৎসাহ আমি ‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস’ ও ‘টার্টলস অল দ্য ওয়ে ডাউন’ উপন্যাস পড়েছি। অনেকেই অবাক হয়েছিলেন যখন জন গ্রিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্পর্কে নতুন বইয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যক্ষ্মা এমন একটি রোগ, যা পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ অতীত কালের রোগ মনে করে।

আমি অবশ্য এমন মনে করিনি। আমি প্রায় এক দশক আগে জনের সঙ্গে প্রথম দেখা করি। সে আমার সঙ্গে গেটস ফাউন্ডেশনের কাজে ইথিওপিয়া ভ্রমণে যুক্ত হয়। ভ্রমণের সময় আমরা অনেক আলোচনা করেছি। ‘এভরিথিং ইজ টিউবারকিউলোসিস’ বইয়ে জন যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন, তা নিয়ে আলোচনা করেছি। কেন ব্যক্তির জন্মস্থান তার শৈশব বা সন্তান জন্মদানের বিষয়টি তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে কতটা প্রভাবিত করে? আমাদের মতো মানুষেরা এই সম্ভাবনা বাড়াতে কী করতে পারি?

সেই থেকে জন গ্রিন আমাদের ফাউন্ডেশনের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে কৌতূহল ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছেন। তিনি নিজেই এখন বিশ্ব স্বাস্থ্যের শক্তিশালী সমর্থক হয়ে উঠেছেন। আমি এমন আর কাউকে চিনি না, যিনি যক্ষ্মা–সম্পর্কিত একটি বইকে নিউইয়র্ক টাইমসের সেরা বিক্রীত বইয়ের তালিকায় নিতে পেরেছেন।

বইটি মর্মস্পর্শী আবার বুদ্ধিদীপ্ত হলেও মাঝেমধ্যে বিরক্তিকর। বইটিতে হেনরি নামের এক ছেলের গল্প আছে। হেনরির সঙ্গে জন সিয়েরা লিওনের একটি টিবি ক্লিনিকে দেখা করেন। হেনরির বয়স যখন মাত্র ছয় বছর, তখন তার যক্ষ্মার লক্ষণ দেখা যায়। হেনরির তখন ক্লান্তি, ওজন হ্রাস আর রাতের ঘাম দেখা যেত। প্রথম পরীক্ষায় যক্ষ্মা ধরা পড়েনি বলে হেনরিকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যখন তার রোগনির্ণয় করা হয়, তখন হেনরি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।

হেনরিকে কয়েক দশক ধরে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়। এই পদ্ধতি বেশ নিষ্ঠুর পদ্ধতি। মাসের পর মাস বড়ি, বেদনাদায়ক ইনজেকশন দিলেও ক্রমাগত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সংক্রমণের মাত্রা কমতে শুরু করলে তীব্র ক্ষুধার্ত ভাব হয়। ওষুধ কেবল তখনই কাজ করে, যদি তা ধারাবাহিকভাবে ও সময়সূচি অনুসারে নেওয়া হয়। রোগীদের জন্য এমন নিয়ম মানা প্রায়ই অবাস্তব। বিশ্বের বেশির ভাগ জায়গায় যক্ষ্মা চিকিৎসার অর্থ হলো ক্লিনিকের জন্য হেঁটে যাওয়া। কাজ বা স্কুল মিস হয়। রোগীরা ঋণে ডুবে যায়। সামাজিক কলঙ্ক আর বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হওয়া। শিশু হেনরির মা তাকে সমর্থন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। চেষ্টা থাকলেও চিকিৎসায় বাধা দেখা যায়। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় হেনরি।

শেষ পর্যন্ত হেনরির ভাগ্য ভালো ছিল। অসুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসার বিকল্প ব্যবস্থা বন্ধ হলেও চিকিৎসকেরা তাকে ছেড়ে দেননি। তার জন্য বিশেষ ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়। সেই ওষুধ দরিদ্র দেশে শিশুরা কম পায়। সেই ওষুধের জন্য তার জীবন বেঁচে যায়। আজ হেনরির উন্নতি হয়েছে। বছরের পর বছর হাসপাতালে আটকে থাকার পর সে এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার একটি ইউটিউব চ্যানেলও রয়েছে। যেখানে হেনরি তার কথা প্রকাশ করছে। অন্য যক্ষ্মা রোগীদের জন্য কথা বলছে। জন তাঁর বইয়ে হেনরির গল্পকে কোনো অলৌকিক ঘটনা হিসেবে বা রোমান্টিকভাবে উপস্থাপন করেননি। তিনি প্রমাণ হিসেবে লিখেছেন। যক্ষ্মা নিরাময়যোগ্য, ভালো যত্নে যক্ষ্মা রোগী ভালো হয়। আসল প্রশ্ন হলো আমরা জীবন বাঁচাতে চাই কি না? আমরা চিকিৎসাকে সবার জন্য সুযোগ দিতে ইচ্ছুক কি না।

জন গ্রিন গত বছর বইটি লেখা শেষ করেছেন। এখনকার যক্ষ্মার তাৎপর্য তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ধনী দেশে বেশির ভাগ মানুষ যে রোগটি ভুলে গেছেন, তা এখনো বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করছে। খুব সহজেই এই সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই আশঙ্কা সত্যি। বৈদেশিক সাহায্যের কাটছাঁটের ফলে বিশ্বজুড়ে যক্ষ্মা চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। শিশু হেনরি হয়তো আজ বেঁচে থাকত না যদি পার্টনার্স ইন হেলথের মতো সংস্থা না থাকত। সংস্থাটি আংশিকভাবে মার্কিন স্বাস্থ্য সহায়তার অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছিল। এই সংস্থা হেনরিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে লড়াই করেছিল। সাহায্য কাটছাঁটের কারণে শিশু হেনরির মতো অনেক শিশুর ক্ষতি হবে। অনেক শিশু সম্পূর্ণরূপে চিকিৎসার সুযোগ হারাতে পারে। এর ফলে চিকিৎসা ব্যাহত হবে। আরও বেশি সংক্রমণের কেস দেখা যাবে। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা ও বেশি সংক্রামক রোগের ধরন তৈরি হবে। সারা বিশ্বের জন্য যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ও ব্যয়বহুল হবে।

আজকের বিশ্ব স্বাস্থ্যের কেন্দ্রীয় চ্যালেঞ্জ সম্পর্কেই লিখেছেন জন। জনের ভাষায়, যেখানে রোগ নেই, সেখানে নিরাময়সেবা আছে। যেখানে প্রতিকার নেই, সেখানেই এই রোগ উপস্থিত। যক্ষ্মা সম্পর্কে একটি বই বেশ বিরক্তিকর হতে পারে। লেখক জন তাঁর বইকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। যক্ষ্মা রোগের দীর্ঘ আর অদ্ভুত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। যক্ষ্মা নিয়ে মিথের মধ্যে আছে এ রোগ কেবল শ্বেতাঙ্গদের আক্রমণ করে। আবার এই রোগ নিয়ে এমনও তত্ত্ব রয়েছে, এই রোগ সৃজনশীল প্রতিভাকে অনুপ্রাণিত করে। এই রোগের ভিক্টোরিয়ান সময়ে সৌন্দর্যের মানদণ্ডের ওপর প্রভাব ছিল। শেষ দুটি তথ্য সম্পর্কে আমি জানতাম না। আমি স্টেটসন টুপি সম্পর্কেও জানতাম না। যদি আপনি জনের কাজের সঙ্গে পরিচিত হন, তাহলে এমন লেখার পদ্ধতি আপনাকে অবাক করবে না। পাঠকের সামনে এমন জিনিস সম্পর্কে যত্নশীল করে তোলার ক্ষেত্রে তার অনন্য প্রতিভা রয়েছে। পাঠক যেন এই বিষয় আমার জন্য না, এমনটা মনে করতে পারেন না। কবিতা হোক বা জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা সংক্রামক রোগসংক্রান্ত যেকোনো বিষয় হোক না কেন।

জন একটি আহ্বানের মাধ্যমে তাঁর ‘এভরিথিং ইজ টিউবারকিউলোসিস’ বইটি শেষ করেছেন। তাঁর যুক্তি, যক্ষ্মা থেকে জীবন বাঁচানো আসলে আর কোনো বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ নয়। এটি একটি নৈতিক চ্যালেঞ্জ। আমি তাঁর সঙ্গে একমত। আমি মনে করি, বইটিতে যা বলা হয়েছে, তার চেয়ে অবশ্য অনেক আশাবাদী কারণ রয়েছে। জন গ্রিন অতীত ও বর্তমানের ব্যর্থতা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানেন। এই রোগের চিকিৎসায় অগ্রগতির ক্ষেত্রে ধীরগতি আছে। নতুন যক্ষ্মা রোগের ওষুধের আকাশছোঁয়া দাম দেখা যায়। কে চিকিৎসা পাবে আর কে করবে না, তার ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। সামনে কী হবে, তা নিয়ে জন তেমন লেখেননি। আড়াই দশক ধরে গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার পেছনে বিনিয়োগ করছি আমরা। আমি গল্পের একটি ভিন্ন দিক দেখেছি। আমি জানি সামনে কী আছে ও জানি কী সম্ভব।

আমরা এমন সাফল্যের কাছাকাছি আছি, যা আমাদের চিকিৎসা ও প্রতিরোধের বিষয়ে সবকিছু পরিবর্তন করতে পারে। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ওষুধ ব্যবস্থা, উন্নত রোগনির্ণয় ও টিকা নিয়ে কাজ হচ্ছে। এসব পরিবর্তন তখনই পার্থক্য আনবে, যদি তা আমরা হেনরির মতো শিশুর কাছে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট দ্রুত কাজ করি। ওষুধের মূল্যের জন্য প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানি বিদ্রূপের শিকার হচ্ছে। অথচ এসব কোম্পানি যক্ষ্মা চিকিৎসায় বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক। আমাদের তাদের সঙ্গে অংশীদার হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। উদ্ভাবন অব্যাহত রাখতে হবে ও খরচ কমাতে হবে। যদি আমরা সেই পথে চলি, তাহলে আমরা হেনরির বেঁচে থাকাকে স্বাভাবিক ভাবতে পারব। যক্ষ্মাকে তখন পুরোনো রোগে পরিণত করতে পারব।

সূত্র: গেটস নোটস

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: জাহিদ হোসাইন খান

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জন গ র ন র জন য এই র গ আম দ র কর ছ ল ব যবস প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

ভয়হীন ন্যায্য মানবিক মর্যাদার দেশ গড়ার প্রত্যাশা

দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীরা ভয়হীন ন্যায্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। গতকাল শনিবার জাতীয় জাদুঘরে ‘দৃশ্যমাধ্যম সমাজ সম্মিলন ২০২৫: কইলজ্যা কাঁপানো ৩৬ দিন’ শিরোনামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁরা এই প্রত্যাশার কথা জানান।

আলোচনা, স্মৃতিচারণা, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাজানো হয় এই সম্মিলন। সারা দিন ধরে চলে এই অনুষ্ঠান।

সন্ধ্যায় সম্মিলনের আলোচনা সভায় অধ্যাপক ও চিন্তক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ‘বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার জন্য নতুন ভাষার প্রয়োজন। মজলুমের পক্ষে থাকতে হবে, শুধু জুলুমের বিরুদ্ধে নয়, জালিমের বিরুদ্ধে থাকতে হবে।’ দেশের চলমান সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা ভবিষ্যতে জাতির জন্য আরেকটি বিপর্যয় আনতে যাচ্ছে। তারা আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মতো নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল না।

বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার জন্য নতুন ভাষার প্রয়োজন। মজলুমের পক্ষে থাকতে হবে, শুধু জুলুমের বিরুদ্ধে নয়, জালিমের বিরুদ্ধে থাকতে হবে। সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক ও চিন্তক

সলিমুল্লাহ খান বলেন, মূল বিষয় হলো জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। সেই কাজ না করা গেলে এই দ্বিকক্ষ, রাষ্ট্রপতির হাতে সংরক্ষিত আসন থাকা—এসবই ভবিষ্যতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে যে নারীরা রাজপথে সোচ্চার ছিলেন, তাঁদের আর দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা যেন হারিয়ে গেছেন। কমিশনকে তাঁদের অনেকই বলছেন অভ্যুত্থানের পর তাঁদের আর জায়গা দেওয়া হয়নি। প্রয়োজন হলে নারীকে ব্যবহার, প্রয়োজনের শেষে ছুড়ে ফেলার এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করতে হবে।

অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে বর্ষপূর্তির অনেক চাকচিক্যময়, উচ্চকণ্ঠ উদ্‌যাপন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরটা মনে হচ্ছ অন্তঃসারশূন্য। সব আগের মতেই আছে উন্নয়নের বয়ান, ড্রোন শো উদ্‌যাপন। শুধু মুখ পরিবর্তন হয়েছে। এই রকমভাবে নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সংঘবদ্ধ সন্ত্রাস হচ্ছে। চলছে ‘ট্যাগ দেওয়া’। আগে বলা হতো ‘স্বাধীনতাবিরোধী’, ‘রাজাকার’। এখন বলা হচ্ছে ‘স্বৈরাচারের দোসর’। এই এখন সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটি বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক ও কবি সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মীরা জনতার অব্যক্ত বাসনাকে ভাষা দেন। কিন্তু আমাদের একটি পুরো প্রজন্মের সংস্কৃতিজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা ইতিহাসের একরৈখিক বয়ান তৈরি করেছেন। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কারিগরদের মতো কাজ করেছেন। এখন সংস্কৃতিজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য মুক্তিযুদ্ধকে নতুন আলোয় ব্যাখ্যা করা। ক্ষমতার সঙ্গে নয়, জনতার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করা।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন লেখক ফিরোজ আহমেদ,শিল্পী ও শিক্ষক মুনেম ওয়াসিফ, পরিবেশকর্মী ও সংগঠক আমিরুল রাজীব। শেষে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এর আগে ছিল নির্মাতা জাহিন ফারুক আমিনের সঞ্চালনায় ‘কথামালা’ শীর্ষক জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীদের স্মৃতিচারণা। এতে আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী ড. শহীদুল আলম বলেন, ‘আমরা এখন অনেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের সমালোচনা করছি। কিন্তু সেই সরকার টিকে থাকার সময় সাহস করে কিছু বলিনি। যখন যা বলা দরকার, তখনই তা বলতে হবে।’

অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, ‘গত বছর সবাই একত্র হতে পেরেছিলাম বলে পথে নেমে প্রতিবাদ করেছি। অনেকের সঙ্গে পথেই নতুন করে পরিচয় হয়েছিল। এখন এই ঐক্য ধরে রাখতে হবে।’ কথামালায় আরও অংশ নেন শিল্পী ও নির্মাতা ঋতু সাত্তার, আলোকচিত্রী ও রাজনৈতিক কর্মী তাসলিমা আখতার, পোশাক পরিকল্পক ইদিলা ফরিদ, প্রযোজক মুশফিকুর রহমান, নির্মাতা আল হাসিব খান, সংগীতশিল্পী হাসান ইথার ও নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়।

এর আগে সকালে ‘কইলজ্যা কাঁপানো ৩৬ দিন: জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে দিনভর সম্মিলনের কার্যক্রম শুরু হয়। আয়োজনের শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, জুলাই গণমানুষের অভ্যুত্থান। মানুষকে সম্পৃক্ত রাখা না গেলে জুলাইকে ধরে রাখা যাবে না। অন্যায়-অবিচার হলে মানুষ মেনে নেয় না।

নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল বসবাসের উপযোগী একটা নগর, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু এই প্রান্তিক মানুষ, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ কোনো সংস্কার আলোচনায় নেই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, ৫ আগস্টের আগে জনগণ বয়ান তৈরি করেছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তা উল্টে গেছে। যারা ক্ষমতায় আছে, তারা নিজেদের মতো করে বয়ান তৈরি করছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ ভাইয়ের স্মৃতিচারণা করেন। এতে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা শামসী আরা জামান, অধ্যাপক হাসান আশরাফ, অধ্যাপক দীনা এম সিদ্দিকী, চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।

আরও পড়ুনমানুষকে বাদ দিয়ে জুলাইয়ের চেতনা ধরে রাখা যাবে না৬ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ