দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীরা ভয়হীন ন্যায্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। গতকাল শনিবার জাতীয় জাদুঘরে ‘দৃশ্যমাধ্যম সমাজ সম্মিলন ২০২৫: কইলজ্যা কাঁপানো ৩৬ দিন’ শিরোনামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁরা এই প্রত্যাশার কথা জানান।

আলোচনা, স্মৃতিচারণা, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাজানো হয় এই সম্মিলন। সারা দিন ধরে চলে এই অনুষ্ঠান।

সন্ধ্যায় সম্মিলনের আলোচনা সভায় অধ্যাপক ও চিন্তক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ‘বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার জন্য নতুন ভাষার প্রয়োজন। মজলুমের পক্ষে থাকতে হবে, শুধু জুলুমের বিরুদ্ধে নয়, জালিমের বিরুদ্ধে থাকতে হবে।’ দেশের চলমান সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা ভবিষ্যতে জাতির জন্য আরেকটি বিপর্যয় আনতে যাচ্ছে। তারা আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মতো নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল না।

বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার জন্য নতুন ভাষার প্রয়োজন। মজলুমের পক্ষে থাকতে হবে, শুধু জুলুমের বিরুদ্ধে নয়, জালিমের বিরুদ্ধে থাকতে হবে। সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক ও চিন্তক

সলিমুল্লাহ খান বলেন, মূল বিষয় হলো জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। সেই কাজ না করা গেলে এই দ্বিকক্ষ, রাষ্ট্রপতির হাতে সংরক্ষিত আসন থাকা—এসবই ভবিষ্যতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে যে নারীরা রাজপথে সোচ্চার ছিলেন, তাঁদের আর দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা যেন হারিয়ে গেছেন। কমিশনকে তাঁদের অনেকই বলছেন অভ্যুত্থানের পর তাঁদের আর জায়গা দেওয়া হয়নি। প্রয়োজন হলে নারীকে ব্যবহার, প্রয়োজনের শেষে ছুড়ে ফেলার এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করতে হবে।

অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে বর্ষপূর্তির অনেক চাকচিক্যময়, উচ্চকণ্ঠ উদ্‌যাপন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরটা মনে হচ্ছ অন্তঃসারশূন্য। সব আগের মতেই আছে উন্নয়নের বয়ান, ড্রোন শো উদ্‌যাপন। শুধু মুখ পরিবর্তন হয়েছে। এই রকমভাবে নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সংঘবদ্ধ সন্ত্রাস হচ্ছে। চলছে ‘ট্যাগ দেওয়া’। আগে বলা হতো ‘স্বাধীনতাবিরোধী’, ‘রাজাকার’। এখন বলা হচ্ছে ‘স্বৈরাচারের দোসর’। এই এখন সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটি বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক ও কবি সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মীরা জনতার অব্যক্ত বাসনাকে ভাষা দেন। কিন্তু আমাদের একটি পুরো প্রজন্মের সংস্কৃতিজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা ইতিহাসের একরৈখিক বয়ান তৈরি করেছেন। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কারিগরদের মতো কাজ করেছেন। এখন সংস্কৃতিজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য মুক্তিযুদ্ধকে নতুন আলোয় ব্যাখ্যা করা। ক্ষমতার সঙ্গে নয়, জনতার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করা।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন লেখক ফিরোজ আহমেদ,শিল্পী ও শিক্ষক মুনেম ওয়াসিফ, পরিবেশকর্মী ও সংগঠক আমিরুল রাজীব। শেষে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এর আগে ছিল নির্মাতা জাহিন ফারুক আমিনের সঞ্চালনায় ‘কথামালা’ শীর্ষক জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীদের স্মৃতিচারণা। এতে আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী ড.

শহীদুল আলম বলেন, ‘আমরা এখন অনেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের সমালোচনা করছি। কিন্তু সেই সরকার টিকে থাকার সময় সাহস করে কিছু বলিনি। যখন যা বলা দরকার, তখনই তা বলতে হবে।’

অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, ‘গত বছর সবাই একত্র হতে পেরেছিলাম বলে পথে নেমে প্রতিবাদ করেছি। অনেকের সঙ্গে পথেই নতুন করে পরিচয় হয়েছিল। এখন এই ঐক্য ধরে রাখতে হবে।’ কথামালায় আরও অংশ নেন শিল্পী ও নির্মাতা ঋতু সাত্তার, আলোকচিত্রী ও রাজনৈতিক কর্মী তাসলিমা আখতার, পোশাক পরিকল্পক ইদিলা ফরিদ, প্রযোজক মুশফিকুর রহমান, নির্মাতা আল হাসিব খান, সংগীতশিল্পী হাসান ইথার ও নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়।

এর আগে সকালে ‘কইলজ্যা কাঁপানো ৩৬ দিন: জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে দিনভর সম্মিলনের কার্যক্রম শুরু হয়। আয়োজনের শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, জুলাই গণমানুষের অভ্যুত্থান। মানুষকে সম্পৃক্ত রাখা না গেলে জুলাইকে ধরে রাখা যাবে না। অন্যায়-অবিচার হলে মানুষ মেনে নেয় না।

নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল বসবাসের উপযোগী একটা নগর, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু এই প্রান্তিক মানুষ, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ কোনো সংস্কার আলোচনায় নেই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, ৫ আগস্টের আগে জনগণ বয়ান তৈরি করেছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তা উল্টে গেছে। যারা ক্ষমতায় আছে, তারা নিজেদের মতো করে বয়ান তৈরি করছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ ভাইয়ের স্মৃতিচারণা করেন। এতে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা শামসী আরা জামান, অধ্যাপক হাসান আশরাফ, অধ্যাপক দীনা এম সিদ্দিকী, চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।

আরও পড়ুনমানুষকে বাদ দিয়ে জুলাইয়ের চেতনা ধরে রাখা যাবে না৬ ঘণ্টা আগে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন ন বল ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘‘বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি তোলা উচিত, চব্বিশ এবং আগের গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, ভোটাধিকার হরণ—এসবের জন্য যদি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হতে পারে। তাহলে একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণ, নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করতে হবে। একই অপরাধে দুই রকমের বিচার হতে পারে না।’’

শনিবার (১ নভেম্বর) রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের আয়োজনে ‘স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য’ শীর্ষক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

আরো পড়ুন:

দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন: দুলু

নৌকা ডুবেছে, শাপলা ভাসবে: এনসিপির তুষার

মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘‘যদি আওয়ামী লীগের মতো একই ধরনের অপরাধে জামায়াতের বিচার না হয়, তাহলে সেটা হবে ইতিহাসের প্রতি অবিচার।’’

তিনি বলেন, ‘‘আজকে জামায়াত তাদের পোশাক-চেহারা, আচরণ পাল্টে নতুন রূপে হাজির হয়েছে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করছে। কিন্তু, মূল উদ্দেশ্য বিএনপিকে আক্রমণ করা। এই বহুরূপীদের চেহারা জনগণ চিনে ফেলেছে।’’

বিএনপির এই নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে বিএনপিই একমাত্র শক্তি। অথচ এই শক্তিকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র চলছে। সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনের নামে প্রক্রিয়া চালালেও জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

আলাল আরো বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার মনে করেছে, দেশের সব অনাচারের মূলে সংবিধান। কিন্তু সমস্যার মূল সংবিধান নয়—ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনগণের ভোটাধিকার হরণ। শেখ হাসিনার ১৬-১৭ বছরের শাসনে এই অন্যায়, নির্যাতন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারই হয়েছে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।’’

ঢাকা/রায়হান/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদ জনগণের নয়, কিছু উপদেষ্টার প্রয়োজন: হাফিজ
  • একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল
  • জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিতে সংগ্রাম, শপথ যুব সংসদের সদস্যদের
  • বন্দরে বিএনপি নেতা তাওলাদের উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম
  • বিএনপি ও জামায়াত কে কোন ফ্যাক্টরে এগিয়ে
  • অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে: ফখরুল
  • সরকার নিরপেক্ষতা হারালে জনগণ মাঠে নামবে: তাহের
  • সংস্কার ইস্যুতে সব দল ঐক্যবদ্ধ থাকলেও বিএনপি অবস্থান পরিবর্তন করে
  • বিএনপি-জামায়াত দেশকে অন্য এক সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী
  • জনগণের সঙ্গে এটা প্রতারণা: মির্জা ফখরুল