সুশান্ত, শ্রীচরণ আর কানু। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার হাওর কাওয়াদিঘি পাড়ের রক্তা গ্রামের এক প্রান্তের বাসিন্দা, মধ্য বয়সী প্রান্তিক জেলে। বাপ-দাদার আমল থেকে জল আর জালের সাথে বাধা জীবন। শৈশব- কৈশোর কাটিয়েছেন হাওরের বুকে মাছ ধরে। শত বছর পার হলেও বদলায়নি তাদের বুনিয়াদি জীবনধারা।

ওরা মৎস্য দাস সম্প্রদায়ের মানুষ। একশ্রেণির ওয়াটার লর্ডদের রোষাণলে পড়ে তারা এখন সহায় সম্বলহীন। দরিদ্রতার কষাঘাতে জীবন চলে কোনোমতে।

তারা জানান, আধুনিকতার পালাবদলে আমাদের হাত থেকে চলে গেছে পরিবেশবান্ধব জাল, বাঁশের তৈরি চাই-বুচনা, ঘুনি, ডারকি সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় (উকা, ডরি, ফাড়ং) ইত্যাদি। 

তার বদলে এসেছে কিরণমালাসহ জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী মাছধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম। তাদের অভিযোগ, এটা দেখার কেউ নেই। মাঝে মাঝে মৎস্য বিভাগের অভিযান হলেও আবার আগের মতোই রয়ে যায়। আধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার অব্যহত থাকলে একসময় হাওরের জীববৈচিত্র্যসহ দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হবে। হাওরের মিঠা জলে এর ব্যবহার ক্ষতিকর জেনেও নিরুপায় হয়েই আধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

বিশাল জলরাশির হাওর কাউয়াদিঘিতে এখন কোথাও এক চিলতে শুকনো স্থান নেই। হাওরের বুকে উচুঁ রাস্তাঘাটই কেবল ভেসে আছে। সেখানে বসেই মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে জেলেরা। সরেজমিনে গিয়ে কাউয়াদিঘি হাওরের কুশুয়া, নাইকা, উলাউলি, বরইউরি বিলের পাশে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

কথা হয় হাওর পারের প্রান্তিক জেলে কানু বিশ্বাসের (৪০) সাথে। তিনি বলেন, “যখন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ওয়াটার লর্ডদের হাতে হাওরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায়, তখন থেকে বেশি চাওয়া-পাওয়ার টার্গেটে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে না। মানুষের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। জলদস্যুরা রেনু পোনা থেকে মাছ ধরা শুরু করে। এতে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্থানীয় ও দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের সুস্বাদু মাছ।”

হাওর পারের রক্তা গ্রামের জেলে নন্দলাল (৪২) বলেন, “প্লাষ্টিকের পট দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরার ফাঁদ কিরণমালা তৈরি করা হয়। আমরা এগুলো শ্রীমঙ্গল থেকে ক্রয় করি। এর ভিতরে টোপ হিসেবে শামুকের ভিসারালভর (ভেতরের অংশ) ও ফিড ব্যবহার করি। ৪০০ থেকে ৫০০ চিংড়ি ধরার ফাঁদ কিরণমালা পট বিকেলে পানিতে ফেলে দেই সকালে উঠাই। ৪/৫ জনের গ্রুপে কাজ করি। প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ কেজি ছোট দেশীয় চিংড়ি ধরি। বিক্রি করে প্রতিজনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা হারে পেয়ে থাকি। তা দিয়েই চলে টনাটানির সংসার। এটাই আমাদের জীবন।”

রক্তা গ্রামের জুবেল বলেন, “আমি এখনও পুরনো পদ্ধতির জাল দিয়ে মাছ ধরি। কই, ভেদা, মাগুর এসব মাছ জালে ওঠে। তবে দিন দিন মাছ কমে যাচ্ছে। সারা দিনে ৪/৫শ টাকার মাছ ধরি। পরিবারের চাহিদা মেটানোর পর বেশি থাকলে বিক্রি করি।”

রাজনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ.

কে.এম মহসীন বলেন, “আমাদের জনবল সংকটের কারণে আমরা নিয়মিত অভিযান না করলেও অনিয়মিতভাবে অভিযান করে থাকি। তবে যাতায়াত সুবিধা না থাকায় জলদুস্যুরা গভীর হাওরে গিয়ে আস্তানা তৈরি করে। নিষিদ্ধ জাল ও সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে পোনামাছ ধরে। 

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. আরিফ হোসেন বলেন, “হাওর পারের মানুষ ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে সচেতনতা না আসলে আমাদের মৎস্য ভাণ্ডার একসময় খালি হয়ে যাবে।”

তিনি আরো বলেন, “মৌলভীবাজারের হাওরগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর মাছ উৎপাদন হয়। জেলেরা না বুঝে রেনু পোনা আহরণ করে বিক্রি করে। তারা বোঝে না ১০ কেজি রেনু পোনা বড় হলে এক টন মাছ হতে পারে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। সবাই সচেতন হলে মৌলভীবাজারের মৎস্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধশালী হবে।”

ঢাকা/আজিজ/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবহ র ক সরঞ জ ম পর ব শ আম দ র হ ওর র র হ ওর মৎস য

এছাড়াও পড়ুন:

ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন

কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ। 

এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।

একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।

দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।

গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।

পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।

ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।

এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।

বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।

এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”

যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।

বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”

তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।

প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।

এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।

ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”

শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • একসময় ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ভবিষ্যৎ তারকা, এখন ক্লাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন
  • ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন