নির্বাচনে প্রচারসহ প্রার্থীর আচরণবিধিমালায় যে পরিবর্তন
Published: 5th, September 2025 GMT
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধিমালায়। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও যুগোপযোগী পরিবর্তন এনেছে। এবার প্রথমবারের মতো নির্বাচনী প্রচারে পোস্টারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিলবোর্ড, ফেস্টুন, হ্যান্ডবিল, লিফলেটসহ অন্যান্য প্রচারসামগ্রী ব্যবহারে করা হয়েছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ।
ইসি থেকে জানা গেছে, এত দিন নির্বাচন মানেই ছিল দেয়ালে পোস্টার, রঙিন ব্যানার আর নানা রকম প্রচারসামগ্রীর প্রদর্শনী। ইসির মতে, এসব প্রচারণা একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অন্যদিকে নির্বাচনী ব্যয় লাগামছাড়া প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে। এ প্রেক্ষাপটে ইসি পরিবেশবান্ধব ও সুষম প্রচারণা নিশ্চিত করতে নীতিগতভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে।
নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ২ আগস্ট গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী প্রস্তাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণ বিধিমালা-২০২৫ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে আরপিওর মতো এই আচরণ বিধিমালার চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করার প্রয়োজন নেই। আইন অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে নির্বাচন কমিশন নিজে থেকেই এটি গেজেট আকারে জারি করতে পারবে।
ইসি এই খসড়া আচরণ বিধিমালা প্রণয়নে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের মতামত চেয়েছিল। অনেকগুলো দল অন্তত সাদাকালো পোস্টারে প্রচারের সুযোগ রাখার সুপারিশ করলেও নির্বাচন কমিশন সেই সুপারিশ আমলে নেয়নি।
এ দিকে, পরিবেশবান্ধব প্রচারণা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন বিধিমালায় কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যেমন রেক্সিন, পলিথিন, প্লাস্টিক, পিভিসি বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার নিষিদ্ধ। ড্রোন, কোয়াডকপ্টার বা এ জাতীয় যন্ত্রও প্রচারে ব্যবহার করা যাবে না।
আচরণবিধিমালায় এবার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো প্রার্থীরা আর পোস্টার ব্যবহার করতে পারবেন না। প্রচারসামগ্রীর ক্ষেত্রে সীমিতভাবে বিলবোর্ড ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে তা সর্বোচ্চ ২০টির মধ্যে সীমিত রাখতে হবে এবং প্রতিটির আয়তন ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৯ ফুট প্রস্থের মধ্যে থাকতে হবে। বিলবোর্ড স্থাপন এমনভাবে করতে হবে যাতে যানবাহন বা জনসাধারণের চলাচলে কোনো ধরনের বিঘ্ন না ঘটে। পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন স্থানে বিলবোর্ড বসানো যাবে না।
ডিজিটাল বিলবোর্ডে আলো ব্যবহার করা গেলেও অতিরিক্ত আলোকসজ্জা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসির যুক্তি, অতিরিক্ত বিলবোর্ড ব্যবহারে নির্বাচনী ব্যয় অতিক্রমের ঝুঁকি বাড়ে এবং অসাম্য তৈরি হয়, ফলে তা প্রতিযোগিতাকে অসুস্থ করে তোলে।
প্রচারণায় প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা
নির্বাচনী প্রচারে ড্রোন, কোয়াডকপ্টার ও এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। হেলিকপ্টার ব্যবহারে কিছুটা শিথিলতা আনা হলেও তা কেবল দলের সাধারণ সম্পাদক বা সমপর্যায়ের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে হেলিকপ্টার থেকে লিফলেট বিতরণ বা প্রচারসামগ্রী ঝুলানো যাবে না।
সামাজিক মাধ্যমেও কঠোর নিয়ম আরোপ করা হয়েছে। যেমন কোনো দল, প্রার্থী বা তাদের এজেন্ট কোনো ঘৃণ্য, বিদ্বেষমূলক, নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কনটেন্ট প্রচার করতে পারবেন না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ বা অর্থায়নে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালানো যাবে না।
প্রচার শুরুর আগেই প্রার্থী, তার এজেন্ট বা দলের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট, ই-মেইল, ওয়েবসাইটের তথ্য সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে।
নির্বাচনী সময়সীমা ও সমান সুযোগ
আচরণবিধিমালায় প্রার্থীদের জন্য তিন সপ্তাহের প্রচার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। সব প্রার্থীকে সমান সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে এক মঞ্চে ইশতেহার পাঠের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট আসনের সব প্রার্থীকে এক দিনে একটি প্ল্যাটফর্মে এনে তাদের বক্তব্য প্রচারের ব্যবস্থা করবেন। প্রার্থীরা গণমাধ্যমে সংলাপে অংশ নিতে পারবেন, তবে কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না।
সরকারি সুবিধাভোগীদের ওপর বিধিনিষেধ
নতুন বিধানে ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ (ভিভিআইপি) হিসেবে আরও কিছু নতুন শ্রেণি যুক্ত করা হয়েছে। যেমন, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরাও এবার ভিভিআইপি তালিকায় রয়েছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, স্পিকার, উপমন্ত্রী, মেয়র, সংসদ সদস্য, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নামতে পারবেন না। একইসঙ্গে তাদের সার্কিট হাউস, ডাকবাংলো বা রেস্ট হাউস ব্যবহারে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাব ঠেকাতে নতুন বিধান
প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর কোনো প্রার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বা সদস্য থাকলে, তাকে ওই পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক প্রভাব রোধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শাস্তি ও জরিমানা বৃদ্ধি
আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে এবার আরও কঠোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গুরুতর অপরাধে প্রার্থিতা বাতিলের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। জরিমানার পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দেড় লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পূর্বের মতো ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধানও বহাল রাখা হয়েছে।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিধান
ভোটকেন্দ্রের ১৮০ মিটারের মধ্যে ভোটার স্লিপ বিতরণ করা যাবে না। স্লিপের আকার ১২ সেন্টিমিটার × ৮ সেন্টিমিটারের বেশি হতে পারবে না। টিশার্ট, জ্যাকেট ইত্যাদির ব্যবহারে পূর্বের তুলনায় কিছুটা শিথিলতা আনা হয়েছে।
মাইক ব্যবহারের সময় ও শব্দমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এবং সর্বোচ্চ ৬০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দমাত্রা অনুমোদিত।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.
ইসি মনে করে, নতুন আচরণবিধি প্রণয়ন একটি বড় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ। এটি সুষ্ঠু, পরিবেশবান্ধব, স্বচ্ছ ও সমান সুযোগে নির্বাচনী প্রচারণা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। বিশেষ করে প্রচার ব্যয় কমানো, প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ এবং গঠনমূলক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই বিধিমালা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
ঢাকা-৮ আসনের ভোটার বোরহানউদ্দিন বলেন, ‘‘এই বিধিমালা বাস্তবায়নে ইসির কঠোর মনোভাব এবং পরিবেশ, প্রযুক্তি ও ন্যায়ের ভারসাম্যপূর্ণ বিবেচনা আগামী নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।’’
ঢাকা/তারা/
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আচরণব ধ ম ল য় ব যবহ র কর ব যবহ র ক র ব যবহ র কর মকর ত ব যবস থ মন ত র পর ব শ প রব ন
এছাড়াও পড়ুন:
জকসুর তফসিল সোমবার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রথম কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে।
রবিবার (২ নভেম্বর) চূড়ান্ত করা হবে নির্বাচনি আচরণবিধি এবং আগামীকাল সোমবার (৩ নভেম্বর) ঘোষণা করা হবে নির্বাচনের তফসিল।
জকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা হাসান বলেন, “২৭ নভেম্বর নয়, ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে জকসু নির্বাচন হবে। সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে ডিসেম্বরের ৮, ৯ বা ১০ তারিখ যাচাই করে দেখা হচ্ছে। যেহেতু ১৩ ডিসেম্বর ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে এবং ১১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ কর্মদিবস—সেক্ষেত্রে ১০ ডিসেম্বর বুধবার নির্বাচনের সম্ভাবনা বেশি।”
তিনি আরো বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এবারই প্রথম জকসু নির্বাচন। তাই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগছে। অনেক ছাত্র সংগঠনও ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়, যাতে তারা প্রচারণা চালাতে পারে। তবে আমরা চাই, যত দ্রুত সম্ভব একটি উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজন করতে।”
অধ্যাপক মোস্তফা হাসান বলেন, “ভোটার তালিকা, প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা, ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া—এসব খসড়া তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচনি আচরণবিধিও প্রস্তুত করা হয়েছে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল অনুসরণ করে।”
আজ সব কার্যকর ছাত্র সংগঠন, সাংবাদিক প্রতিনিধি ও নির্বাচনের অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করে আচরণবিধি চূড়ান্ত করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “কেউ যেন দ্বিমত না করে, সেটিই আমাদের লক্ষ্য। আচরণবিধি চূড়ান্ত হলেই সোমবার বা মঙ্গলবার তফসিল ঘোষণা করব।”
ছাত্রদলের সম্পাদকীয় ও সদস্য পদ বৃদ্ধির দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “জকসুর সংবিধি পাস হয়ে গেছে। এখন এটি সংশোধন করতে হলে একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট, ইউজিসি, মন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাগবে—এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই নতুন করে সংযোজনের সুযোগ নেই।”
তিনি আরো বলেন, “আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, সেটা স্বীকার করছি। তবে আমরা চাই, সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে। অন্যান্য ক্যাম্পাসের তুলনায় জবির ছাত্র সংগঠনগুলো অনেক ঐক্যবদ্ধ। তাদের সহযোগিতা পেলে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই হবে জকসু নির্বাচন।”
অধ্যাপক মোস্তফা হাসান আশা প্রকাশ করে বলেন, “২০ বছর পর প্রথম জকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আমরা চাই, জবির এই নির্বাচন সারা দেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক।”
ঢাকা/লিমন ইসলাম/ইভা