অস্ত্র বিতরণ ও বোমা বিস্ফোরণের গুজব, দুটি ভিডিওই ভুয়া বলছে পুলিশ
Published: 16th, October 2025 GMT
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। একটিতে প্রকাশ্যে অস্ত্র বিতরণের দাবি ও অন্যটিতে বোমা বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখানো হয়। দুটি ঘটনাকে গুজব ও ভিত্তিহীন বলছে রাজশাহী মহানগর পুলিশ।
মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব ভুয়া ও বানোয়াট ভিডিও প্রচার করছে। এর মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে বানানো এবং অস্ত্র বিতরণের ভিডিওটি দূর থেকে ধারণ করা একটি অস্পষ্ট দৃশ্য, যাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে মহানগর পুলিশের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অস্ত্র বিতরণের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, রাকসু নির্বাচনের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের বিপরীতে একটি বাগানে কিছু লোকের আনাগোনার একটি অস্পষ্ট ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভিডিওটি ছড়িয়ে দিয়ে দাবি করা হয়, একটি রাজনৈতিক দলের লোকজন সেখানে প্রকাশ্যে অস্ত্র বিতরণ করছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পায়নি। সেখানে স্থানীয় উৎসুক লোকজন ও বিভিন্ন দলের সমর্থকেরা বাগানে গাছের ছায়ায় আড্ডা দিচ্ছিলেন ও খাওয়াদাওয়া করছিলেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঘটনাস্থলের খুব কাছেই পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা টহলে ছিলেন। গণমাধ্যমকর্মী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে এমন একটি প্রকাশ্য স্থানে অস্ত্র বিতরণ করা বাস্তবসম্মত নয়। একটি মহল সাধারণ মানুষের আড্ডা ও খাওয়ার দৃশ্যকে দূর থেকে ধারণ করে অস্ত্র বিতরণের গুজব ছড়িয়েছে।
রাকসু নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাস–সংলগ্ন বিনোদপুরে শামিয়ানা টানিয়ে জামায়াত (বাঁয়ে) ও বিএনপির নেতা–কর্মীদের অবস্থান। বৃহস্পতিবার দুপুরে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আগামীকাল স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ, কী থাকছে এই সনদে
দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে প্রায় আট মাস ধরে তিন ধাপে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শেষে তৈরি করা ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে আগামীকাল শুক্রবার। এদিন বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ সই হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও সদস্যরা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দুজন করে প্রতিনিধি এই সনদে সই করবেন।
গত বছর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের (সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন) সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়।
গত ১৬ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের খসড়া পাঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে ওই খসড়ায় কিছু ত্রুটি থাকায়, তা সংশোধন করে নির্ভুল খসড়া পাঠানো হয়। এরপর গত ২০ আগস্ট ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে খসড়াটির ওপর যেকোনো ধরনের মতামত দেওয়ার সময় ২২ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপর আবারও জুলাই সনদের নানা বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কমিশনের আলোচনা হয়।
সব দলের মতামত পর্যালোচনা এবং নির্ভুল আকারে জুলাই সনদ লিখিত আকারে চূড়ান্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সনদের চূড়ান্ত কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে তুলে দেওয়া হয়। জুলাই সনদের চূড়ান্ত এই কপি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
ব্লক-১, এমপি হোস্টেল, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, শেরে-বাংলা নগর, ঢাকা।
১৪ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
ব্লক-১, এমপি হোস্টেল, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, শেরে-বাংলা নগর, ঢাকা।
ই-মেইল: [email protected]
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫
সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও শক্তিসমূহের পারস্পরিক ও সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি :
১। পটভূমি
প্রায় দুশো বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘ লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং পূর্ব-বাংলা তার অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরশাসন, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব-বাংলার জনগণ সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার-সংগ্রামের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদার বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ জনগণের উপর বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করলে পরদিন ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরিণতিতে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতিকে ধারণ করে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, দীর্ঘ ৫৩ বছরেও তা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সংস্কৃতি বিকাশের ধারা বারবার হোঁচট খেয়েছে। ১৯৭৫ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল কায়েম করা হয়। ওই বছরই এক সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে সংঘটিত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থার পতন ঘটে। নানামুখী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগের ফলে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ আবারও গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। যে কারণে বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি টেকসই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি এবং এগুলো অত্যন্ত ন্যুব্জ ও দুর্বলভাবে কাজ করেছে।
২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লগি-বৈঠা তাণ্ডবে দেশে কয়েকটি নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় এবং সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ও একটি অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১/১১ সরকার নামে পরিচিত। যার ফলে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করতে থাকে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা ও হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সংঘটিত হয় এক নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে বিশেষ ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠী বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর তিনটি বিতর্কিত ও প্রহসনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস এবং বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ব্যবস্থা কায়েম করে। বস্তুতপক্ষে, রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অবারিত সুযোগ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিগত ১৬ বছরে দলীয় প্রভাবকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর, জবাবদিহিতাবিহীন ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল।
এই পটভূমিকায় রাজনৈতিক দলগুলোর তথা জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিতে কোটা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের এক দফা আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-শ্রমিক-নারী-পেশাজীবী তথা ফ্যাসিস্ট বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সকল স্তরের জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে রেমিট্যান্স বন্ধ করাসহ অব্যাহতভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সফল এই অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত লগ্নে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের তাৎপযপূর্ণ ভূমিকা স্বৈরাচারের পতনকে ত্বরান্বিত করে। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ সহস্রাধিক নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ গুরুতর আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি, ত্যাগ এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে অনেকেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
বর্ণিত প্রেক্ষাপটে, জনগণের মননে রাষ্ট্র-কাঠামো সংস্কারের এক প্রবল আকাঙ্ক্ষার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটে; বিশেষত সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, ধ্বসে পড়া নির্বাচনি ব্যবস্থা, আইনি ও বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ও পুলিশি ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি দমন ও জবাবদিহির ব্যবস্থায় সর্বত্র ব্যাপক সংস্কারের জোরালো আওয়াজ ওঠে । এই প্রেক্ষাপটেই গণঅভ্যুত্থানের সরকার প্রথম দফায় বিষয়ভিত্তিক ৬টি পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে।
২। সংস্কার কমিশন গঠন
গণঅভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে ৩ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে জারীকৃত পৃথক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাঁচটি সংস্কার কমিশন যথা, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন এবং এরপর ৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে জারীকৃত অপর একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করে। উক্ত কমিশনগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লিখিত মতামত এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিসহ অংশীজনদের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত সুপারিশসহ প্রতিবেদন ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাখিল করে।
৩। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন
সার্বিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধানগণ এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের একজন সদস্যকে সদস্য করে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। পরবর্তীতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের পরিবর্তে উক্ত কমিশনের একজন সদস্যকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে কমিশন কিছুটা পুনর্গঠন করা হয়। তাছাড়া, রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তথা সরকারের নিবিড় যোগাযোগের সুবিধার্থে প্রধান উপদেষ্টা একজন বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) নিয়োগ দেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্ব ছিল ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা করা এবং এ মর্মে পদক্ষেপ সুপারিশ করা’। প্রাথমিকভাবে কমিশনের মেয়াদ ছিল কার্যক্রম শুরুর তারিখ থেকে ছয় মাস। পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক জারীকৃত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিগত ১১ আগস্ট ২০২৫ তারিখে একবার এবং ১৫ সেপ্টেস্বর ২০২৫ তারিখে আরেকবার ১ মাস করে দুই দফায় কমিশনের মেয়াদ মোট ২ মাস (১৫ অক্টোবর, ২০২৫ পর্যন্ত) বৃদ্ধি করা হয়।
৪। কমিশনের কার্যক্রম
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখের মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো অনুলিপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে প্রেরণ করা হয়। এরপর ৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে পুলিশ সংস্কার কমিশন ব্যতীত অপর পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংস্কার বিষয়ক ২৩টি, জনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ক ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার বিষয়ক ২০টি সুপারিশ ছিল। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় সেগুলো স্প্রেডশিটে রাখা হয়নি। অপরদিকে, সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মোট ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে প্রেরণ করে, অনেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও প্রদান করে। মতামত গ্রহণের পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ৪৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে কিছু দলের সঙ্গে কমিশনের একাধিকবার বৈঠক হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষে কমিশন মৌলিক সাংবিধানিক সংস্কার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ মোট ২০টি বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় দফায় আলোচনায় মিলিত হয়। এ পর্যায়ে ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত ৩০টি দল ও জোটের প্রতিনিধিগণ একত্রিত হয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেন। এ পর্বে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ২৩টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনার ভিত্তিতে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত এই সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার ফলাফলস্বরূপ নিম্নলিখিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ কিছু বিষয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের ভিন্নমতসহ সর্বসম্মতভাবে প্রণীত হয়।
৫। ঐকমত্যের ঘোষণা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, আমরা অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা স্ব-স্ব দলের পক্ষ থেকে—
(ক) বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে নিম্নলিখিত কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি;
(খ) এসব বিষয়কে এই জাতীয় সনদে (কিছু বিষয়ে ভিন্নমতসহ) সন্নিবেশিত করতে সম্মত হয়েছি; এবং
(গ) ২০০৯ সাল পরবর্তী ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ, গ্রেফতার ও কারাবরণকারীদের প্রতি সহমর্মিতা এবং উক্ত গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে আমরা এই সনদকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ হিসেবে ঘোষণা করছি।