তোফায়েল আহমেদ পথ দেখিয়ে গেছেন, সেই পথে হাঁটতে হবে
Published: 24th, October 2025 GMT
তোফায়েল আহমেদের স্বপ্ন ছিল স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সংস্কার করা। সেই স্বপ্নপূরণে তিনি পথ দেখিয়ে গেছেন, এখন সেই পথে হাঁটতে হবে। সরকার যেন স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সংস্কারে উদ্যোগী হয়। জনসাধারণেরও যাঁর যাঁর দায়িত্ব থেকে এই সংস্কারে মনোযোগী হওয়া দরকার।
শিক্ষাবিদ ও স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের স্মরণে আয়োজিত নাগরিক সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) শফিকুল কবির মিলনায়তনে ‘চলে যাওয়া নয়, পথ দেখিয়ে যাওয়া: ড.
সভার শুরুতে তোফায়েল আহমেদের জীবন ও কর্ম নিয়ে তৈরি করা একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।
কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) পরিচালক ফৌজিয়া নাসরিন সুলতানা বলেন, তোফায়েল আহমেদের সারা জীবনের চিন্তাভাবনা স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায় এসেছে। এসব প্রস্তাবনা ইংরেজিতে অনূদিত করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। সেটি করা গেলে সারা বিশ্ব এই সংস্কার প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে পারবে। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে।
নারী উদ্যোগ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য মাসুদা খাতুন বলেন, স্থানীয় সরকার সংস্কারের যে ধারণা, সেটি আরও দুই বছর আগে থেকে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন তোফায়েল আহমেদ। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে অন্য কোনো কমিশনের প্রধান এত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন কি না, সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে।
মাসুদা খাতুন আরও বলেন, ঐকমত্য কমিশনে তোফায়েল আহমেদের প্রস্তুত করা প্রতিবেদন নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি, গুরুত্বও দেওয়া হয়নি। এটি নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল। তাই তিনি হয়তো অভিমান নিয়েই চলে গেছেন। তবে তিনি খুব ভালোভাবে পথ দেখিয়ে গেছেন। তাঁর এই প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন জরুরি।
তোফায়েল আহমেদের সহধর্মিণী মাসুদা আকতার চৌধুরী বলেন, তিনি চলে গেছেন, তাঁকে তো আর পাওয়া যাবে না। সবার প্রতি তাঁর আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়ার অনুরোধ রইল। তাঁর মেয়ে সাদিয়া আহমেদ বলেন, মানুষকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে তিনি (তোফায়েল আহমেদ) চিন্তা করতেন। কাজকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি।
নাগরিক সভা সঞ্চালনা করেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী। আরও বক্তব্য দেন স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান, কোস্ট ফাউন্ডেশনের কোষাধ্যক্ষ মোস্তফা কামাল আহমেদ, সদস্য মোবাশ্বির উল্লাহ চৌধুরী, মেহেদী হাসান প্রমুখ।
৮ অক্টোবর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শিক্ষাবিদ ও স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ফ য় ল আহম দ র স স থ ন য় সরক র সরক র স স ক র পথ দ খ য় প রস ত ব
এছাড়াও পড়ুন:
নিউইয়র্কের মুসলিমরা যেভাবে গড়ে তুললেন মামদানিকে
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরে বড় প্রভাব ফেলেছিল ২০০১ সালের নাইন–ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলা। ছড়িয়েছিল ইসলামভীতি। সেই ইসলামভীতির আবহে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছেন নিউইয়র্কের মুসলিমরা। তাঁদের এই সাফল্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিফলন নিউইয়র্ক নগরের ডেমোক্র্যাট মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানি।
নাইন–ইলেভেনের ঘটনার পর আরব ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিশোধমূলক হামলার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল নগরজুড়ে—এমনকি পুরো যুক্তরাষ্ট্রেও। আজকের নির্মম ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসন এবং কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট বা আইসের অভিযানের পূর্বাভাস যেন সেই সময়ই পাওয়া গিয়েছিল। অবৈধ অভিবাসনের অভিযোগে শত শত মুসলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাঁদের অনেকে অমানবিক অবস্থায় আটক ছিলেন। মুসলিমদের নাগরিক অধিকারকে পদদলিত করা হয়েছিল।
২৪ বছর পর নিউইয়র্কের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এই নগর এখন সেখানকার ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত করার জন্য প্রস্তুত। সেখানেই ৩৪ বছর বয়সী জোহরান মামদানি ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন জিতে মেয়র প্রার্থী হয়েছেন। প্রশ্ন হলো, এত গভীর এই পরিবর্তনের পেছনে কী কাজ করেছে?
প্রশস্ত হাসির অধিকারী জোহরানের প্রায় অপ্রতিরোধ্য উত্থান ব্যাখ্যা করা যায় তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে। মার্কিন রাজনীতিবিদ আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজসহ অনেকে তাঁকে বলেছেন, ‘এক প্রজন্মে একবার পাওয়া যায় এমন নেতা।’
মামদানির সাফল্যের গল্প কেবল ব্যক্তিগত নয়—এটি আরও বড় এক ইতিহাসের অংশ, যেখানে ৯/১১–এর পর কঠিন পরিস্থিতিতে পড়া তরুণ মুসলিম নিউইয়র্কবাসী সংগঠিত হয়ে নতুনভাবে নিজেদের গড়ে তুলেছেন।
ইসলামভীতির উত্থানের বিপরীতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজন থেকেই জন্ম নেয় এই তরুণ মুসলিমদের রাজনৈতিক জাগরণ। বছরের পর বছর ধরে তাঁরা শহরে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলেছেন, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। তাঁরা এমন এক নতুন ধারা গড়ে তুলেছেন, যা নতুন পরিচয়কে গ্রহণ করে, সীমাবদ্ধতাকেও অতিক্রম করে। এই আন্দোলন নীরবে ও ধারাবাহিকভাবে বেড়ে উঠেছে বহু বছর ধরে। জোহরান মামদানি আজ সেই আন্দোলনের সবচেয়ে সফল ও পরিপূর্ণ প্রতিফলন।
নিউইয়র্কের মুসলিমরা যেমন সংগঠিত হচ্ছেন, তেমনি তাঁদের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে এখন কোনো প্রার্থীই মুসলিম ভোটারদের উপেক্ষা করে জেতার আশা করতে পারেন না। আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, নিউইয়র্ক সিটিতে প্রায় ১০ লাখ মুসলিম বসবাস করেন (ধর্মভিত্তিক কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই), যা শহরের ইহুদি জনগোষ্ঠীর প্রায় সমান।
আমেরিকান–ইসলামিক রিলেশন কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, নিউইয়র্কে ১০ লাখ মুসলিমের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ নিবন্ধিত ভোটার। যদিও ২০২১ সালের মেয়র নির্বাচনে মাত্র ১২ শতাংশ মুসলিম ভোট দিয়েছিলেন। তবে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে।
নিউইয়র্ক মুসলিম ডেমোক্রেটিক ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর মেয়র পদে দলীয় প্রাইমারিতে মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় ভোটারদের উপস্থিতি ২০২১ সালের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে।
গত মাসে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমো দাবি করেছিলেন, মুসলিম সম্প্রদায় সমাজতান্ত্রিক নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মুসলিমরা এখন ডেমোক্রেটিক পার্টিকে মৌলিক নীতিগত প্রশ্নে বামধারার ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।
নিউইয়র্ক মুসলিম ডেমোক্রেটিক ক্লাবের সভাপতি সামান ওয়াকাদ বলেন, ‘জোহরানকে খুবই ব্যতিক্রমধর্মী প্রার্থী হিসেবে দেখছেন মানুষ এবং তিনি তা–ই। কিন্তু এই নির্বাচনে তাঁর গুরুত্ব গড়ে উঠেছে গত দুই দশকে। বিশেষ করে ৯/১১–এর পর মুসলিমদের সংগঠিত রাজনৈতিক কাজের ভিত্তির ওপর।’
২০০১ সালের পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মুসলিমদের ওপর নজরদারি শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেন মার্কিন গোপন নথি ফাঁস করে আলোচিত হয়েছিলেন। তাঁর নথিতে এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। ওই সময় নিউইয়র্কবাসীর মধ্যে মুসলিমদের রাজনীতিতে প্রভাব ছিল খুব কম।
ওই সময় সিটি কাউন্সিলে রবার্ট জ্যাকসন নামের একজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০১ সালে সিটিতে জয়ী হওয়া জ্যাকসন পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে আগ্রহী তরুণ মুসলিমদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে পরিচিত হন। ২০১৮ সালে জ্যাকসন প্রথম মুসলিম হিসেবে রাজ্যের সিনেটে নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালের মেয়র নির্বাচনের সময় মুসলিম নিউইয়র্কবাসী কাঠামোগত সমাধান খুঁজতে শুরু করেন। নিউইয়র্ক মুসলিম ডেমোক্রেটিক ক্লাব সেই বছর গঠিত হয়।
জোহরান মামদানির নিউইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে উত্থান শুরু হয় নিউইয়র্ক মুসলিম ডেমোক্রেটিক ক্লাব থেকে। ক্লাবের সহপ্রতিষ্ঠাতা আলী নাজমি একজন আইনজীবী। ২০১৫ সালে তিনি সিটি কাউন্সিল পদে প্রার্থী হন। নাজমির শৈশবের বন্ধু, র্যাপার হিমস তাঁকে সমর্থন করেছিলেন। মামদানিকে কুইন্সে নাজমির প্রচারণায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন হিমস।
২০১৭ সালে ফিলিস্তিনি-আমেরিকান লুথারান পাস্তর ও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার সদস্য খাদের এল-ইয়াতিম সিটি কাউন্সিলে একটি আসনের জন্য প্রার্থী হন। মামদানি ছিলেন তাঁর প্রচার দলের পরিচালক। ২০১৮ সালে মামদানির নেতৃত্বে বামপন্থী রাজনৈতিক সাংবাদিক রস বার্কান স্টেট সিনেটে প্রার্থী হন।
নাজমি, এল-ইয়াতিম এবং বার্কান সবাই তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যান। নাজমি বলেছেন, ‘জোহরানের উত্থান হলো অনেক মানুষের পরাজয়ের ফলাফল।’
প্রচারের অর্থ সংগ্রহের পরিসংখ্যানও দেখা যায়, মামদানির ‘সাশ্রয়ী মূল্যের নিউইয়র্ক’ বার্তা মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরে কতটা প্রভাব ফেলছে। মার্কিন রাজনীতির বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ওপেন সিক্রেটসের তথ্য অনুযায়ী, মামদানির প্রচার শিবির এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৬৮ লাখ মার্কিন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ দাতা ২৫০ ডলারের কম অনুদান দিয়েছেন। গড় অনুদান মাত্র ৯৮ ডলার।
তুলনামূলকভাবে, মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী কুমোর প্রচারে গড় অনুদান ৬১৫ ডলার। তিনি ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার তুলতে পেরেছেন। মামদানির জন্য বড় শক্তি হলো তাঁর রাজনৈতিক ‘অ্যাকশন কমিটি’ বা ৮৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর দল। এই স্বেচ্ছাসেবীরা ভোটারদের দরজায় কড়া নাড়ছেন এবং সাশ্রয়ী খরচে নিউইয়র্কে টিকে থাকার বিষয় নিয়ে কথা বলছেন।
মামদানিকে আক্রমণমামদানিকে লক্ষ্য করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণ বাড়ছে। তাঁর মুসলিম ও এশীয় পরিচয়কে নিয়ে আক্রমণ করছেন কুমো। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি। মামদানিকে আক্রমণ করে এ ধরনের ভিডিও পোস্টকে ভালোভাবে নেননি অনেকেই।
নিউইয়র্ক সিটির সাবেক মেয়র বিল ডে ব্লাজিও বলেছেন, কুমো মামদানিকে লক্ষ্য করে যে ভিডিও করেছেন, তা বর্ণবাদ। এ ধরনের ভিডিও চালাতে দেওয়া সরকারের উচিত নয়।
নিউইয়র্ক নগরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৪ নভেম্বর। নির্বাচনের আগে মামদানিকে লক্ষ্য করে যে ব্যক্তিগত আক্রমণ হচ্ছে, তাতে অনেকেই বলছেন, কুমোর নির্বাচনী যোগ্যতা বাতিল করা উচিত।