মিস ইউনিভার্সের ‘ওয়ান্টেড’ মালিকের উত্থানের গল্প
Published: 26th, November 2025 GMT
মিস ইউনিভার্সের সহ-মালিক, থাই মিডিয়া টাইকুন অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) থাইল্যান্ডের ব্যাংককের সাউথ মিউনিসিপাল কোর্ট এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। থাইল্যান্ডভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য ন্যাশন এ খবর প্রকাশ করেছে।
এ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলাটি করেন ডা.
আরো পড়ুন:
বাংলাদেশ জয়ী না হয়েও জিতেছে: মিথিলা
শ্যুটিংয়ে নিয়ে মডেলকে ধর্ষণ: পরিচালক নাসিরুদ্দিন গ্রেপ্তার
নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে কয়েক দিন আগে শেষ হয়েছে মিস ইউনিভার্সের ৭৪তম আসর। এরই মধ্যে মিস ইউনিভার্সের মালিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপ। সামনে এসেছে শূন্য থেকে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার প্রসঙ্গ।
থাই মিডিয়া টাইকুন অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপ। থাইল্যান্ডের বিখ্যাত জেকেএন গ্লোবাল গ্রুপের মালিক এই রুপান্তরকামী নারী। বিশ্বের অন্যতম সুন্দরী প্রতিযোগিতার আসর মিস ইউনিভার্স। একসময় এটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মালিকানায় ছিল। ২০২২ সালের অক্টোবরে ২ কোটি ডলার মূল্যে এটি কিনে নেন অ্যান জাকাপং জাক্রাজুতাটিপ। মিস ইউনিভার্সের সর্বশেষ আসর তারই মালিকানায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নারী ধনকুবের অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপের সাফল্যে বিশ্বের মানুষ বিস্মিয় প্রকাশ করেন। কিন্তু তার জীবনের জার্নি মোটেও সহজ ছিল না। যৌন হেনস্তা থেকে শুরু করে নানারকম অত্যাচার সহ্য করে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছেন তিনি। ১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থাইল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপ। তার বাবা-মা থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ভিডিও রেন্টের একটি দোকান চালাতেন। তারাই তাদের সন্তানকে ইংরেজি ভাষা শেখার আগ্রহ তৈরি করেন। পরবর্তীতে ইংরেজি ও থাই ভাষায় কথা বলতে শিখেন অ্যান। তবে তার শৈশব মোটেও সুখকর ছিল না।
৪৬ বছরের অ্যান ছোটবেলায় ছেলেদের স্কুলে পড়াশোনা করতেন, যেখানে তাকে তার ক্লাসের বন্ধুরাও বিরক্ত করতো। শারীরিক গড়নে ছোটবেলা থেকেই অ্যান অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিলেন; শিক্ষকের কাছেও যৌন হেনস্তার শিকার হন। এরপর স্কুলই ছেড়ে দেন তিনি।
খুব ছোট বয়স থেকেই পেট্রোল পাম্পে কাজ শুরু করেন অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই নিজেকে মেয়ে ভাবতেন তিনি। কিন্তু তার অভিভাবক এই মনোভাবকে সমর্থন করতেন না। এরপর অ্যান তার বাড়ি ছেড়ে দেন এবং পড়াশোনার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। অস্ট্রেলিয়ার বন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
আস্ট্রেলিয়াতে অবস্থান করার সময়ে মা-বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে অ্যান নিজেকে নারীতে রূপান্তর করতে শুরু করেন। যদিও তিনি তার গলার স্বরকে পুরুষের মতোই রেখেছেন। কারণ অ্যান এটাকে নিজের পরিচয়ের অংশ বলে মনে করেন।
পড়াশোনা শেষ করে অস্ট্রেলিয়া থেকে থাইল্যান্ডে ফিরে আসেন অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপ। শুধু তাই নয়, পারিবারিক সেই ভিডিও রেন্টের ব্যবসায় সহায়তা করেন। পারিবারিক ব্যবসায় সহায়তার পাশাপাশি নিজের ব্যবসা শুরুর প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেন। বর্তমানে অ্যান থাইল্যান্ডের টপ কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ডিস্ট্রিবিউশন সংস্থা জেকেএন গ্লোবাল মিডিয়ার সিইও।
জেকেএন গ্রুপের আওতায় স্বাস্থ্য, বিউটি, পানীয় ও ডিজিটাল সংবাদ চ্যানেল চালু করেন অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপ। বর্তমানে জেকেএন গ্লোবাল মিডিয়ার ১৫টি আলাদা আলাদা ব্যবসা রয়েছে। ২০২০ সালে ফোর্বসের তালিকা অনুসারে বিশ্বের তৃতীয় ধনী রূপান্তরকামী নারী নির্বাচিত হন। তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২১০ মিলিয়ন ডলার।
অ্যান জ্যাকাফং জাক্রাজুতাটিপ দুই সন্তানের মা। অ্যান্ড্রু ও অ্যাঞ্জেলিকা নামে এক পুত্র এবং এক কন্যাসন্তান রয়েছে তার। কৃত্রিম গর্ভধারণের মাধ্যমে এই দুই সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেছে।
ঢাকা/শান্ত
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম স ইউন ভ র স র জ ক এন গ সন ত ন ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ ও বেহাত বিপ্লব
বাংলাদেশের ইতিহাস মূলত গণমানুষের জাগরণের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান—প্রতিটি অধ্যায়ে তৃণমূল মানুষের আত্মত্যাগ, রক্ত ও স্বাধীনভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। কিন্তু প্রতিটি বিজয়ের পর ইতিহাস যেন এক অপ্রিয় বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। বিপ্লব হয়, পরিবর্তনের সুর বাজে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ফিরে যায় ভিন্ন মুখোশধারী একই গোষ্ঠীর হাতে। যেন—যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।
তাহলে প্রশ্ন জাগে—আমাদের গণ-অভ্যুত্থানগুলো কি সত্যিই জনগণের জন্য, নাকি সাধারণ মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার পালাবদলের হাতিয়ার?
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক মহান সামাজিক বিপ্লবের সামগ্রিক ফসল। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েই সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব চলে যায় রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত এক এলিট শ্রেণির হাতে। যাদের ওপর আস্থা রেখে জনগণ শাসনক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন, কালের পরিক্রমায় তারাই শাসক থেকে শোষকে রূপান্তরিত হলেন। হয়ে উঠলেন রক্ষক থেকে ভক্ষক। অথচ জনতার স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বাস্তবে তার সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হলো—যেখানে আদর্শ হার মানল লোভের কাছে, আর রাজনীতি পরিণত হলো স্বার্থ চরিতার্থ করার যন্ত্রে। ফলস্বরূপ, জনমনে জন্ম নিল নতুন অসন্তোষ।
এরপর এল ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান। ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ একত্র হয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রচনা করল এক নতুন ইতিহাস। সবাই ভেবেছিল, এবার হয়তো সত্যিকারের গণতন্ত্রের সূর্যোদয় হবে। কিন্তু না—ইতিহাস আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্ত করল। আন্দোলনের সুফল ভোগ করল রাজনীতির পুরোনো খেলোয়াড়েরা, আর যারা রাস্তায় রক্ত দিল, যাদের পরিবারের সদস্যরা জীবন বিপন্ন করল, তারাই রইল মঞ্চের বাইরে। শাসক বদলাল, কিন্তু চরিত্র বদলাল না। আবারও বিপ্লব বেহাত হলো।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানেও দৃশ্যপট প্রায় অভিন্ন। হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ আর অসংখ্য মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে উদিত হয়েছিল এক নতুন সূর্য। কিন্তু বছর না ঘুরতেই দেখা গেল সেই পুরোনো পরিচিত চিত্র—চাঁদাবাজি, বদলি বাণিজ্য, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনে বিপ্লবের চেতনা ক্ষয় হতে শুরু করল। সংস্কার নিয়ে ঐকমত্যে বিরোধ, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে তর্ক—সব মিলিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা আজ প্রায় বিপর্যস্ত। যাদের আত্মত্যাগে এই আন্দোলন সফল হয়েছিল, তাদের প্রতি দেখা যাচ্ছে অবহেলা। অন্যদিকে পরাজিত শক্তিও আবার মাথা তুলছে—নাশকতা, ককটেল বিস্ফোরণ, রাজনৈতিক সহিংসতা—সবকিছু যেন ফিরে এসেছে পুরোনো চিত্রে।
সব মিলিয়ে আজকের বাংলাদেশ যেন তাসের ঘরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক বেহাত বিপ্লবের নাম। দুই দিন পর হয়তো নির্বাচন হবে, সরকার গঠিত হবে, কিন্তু তারপর? হয়তো দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নেই ব্যস্ত থাকবে রাজনৈতিক দলগুলো। জনগণকে তখন মনে পড়বে কেবল ভোটের দিনে, আর বাকিটা সময় তারা হয়ে থাকবে নিছক এক ‘সংখ্যা’।
ইতিহাস সাক্ষী—প্রয়োজনে যতবারই ক্রান্তিকাল এসেছে, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ জনতা রক্ত দিয়েছে। অথচ ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছেন রাজনীতিবিদেরা ও মুষ্টিমেয় এলিট শ্রেণি। বিপ্লবের চেতনা রাস্তায় জন্ম নেয়, কিন্তু ফল ভোগ করে চৌহদ্দিতে বন্দী কিছু সুযোগসন্ধানী। এই চক্র ভাঙতেই হবে—এবং ভাঙতেই হবে। তবে এর জন্য কেবল বিপ্লব বা সরকার পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন মানুষের মানসিকতার গভীর পরিবর্তন। বিপ্লবীদেরও বুঝতে হবে—অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা হস্তান্তরই চূড়ান্ত দায়িত্ব নয়; নিজেদের হাতে নিয়ে দায়িত্বশীলভাবে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করাও তাদের কর্তব্য। জনগণকে নিজেদের ক্ষমতা, অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে রাজনীতি-সচেতন, নেতৃত্ব নির্বাচনে সজাগ ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
তবেই হয়তো এই হতভাগ্য রাষ্ট্রের ভাগ্য আকাশে সুবাতাস বইবে; নয়তো এই অন্ধকার চক্র চলবে শেষনিশ্বাস পর্যন্ত।
সাব্বির রহমান
শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিজ্ঞান, ঢাকা কলেজ।