জেন–জি প্রজন্ম কোথায় বিনিয়োগ করতে পছন্দ করে
Published: 25th, October 2025 GMT
বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগের জগতে ঘটছে এক বড় প্রজন্মগত পরিবর্তন। এর নেতৃত্ব দিচ্ছে জেন–জি (জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২) ও মিলেনিয়াল প্রজন্মের (জন্ম ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬) বিনিয়োগকারীরা। বিশেষত্ব হলো, তাঁরা বিনিয়োগ শুরু করছেন কম বয়সে; নিয়মিত ঘেঁটে দেখছেন পোর্টফোলিও। সেই সঙ্গে আগের যেকোনো প্রজন্মের তুলনায় তাঁরা বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়ছেন আরও দ্রুতগতিতে।
এই পরিবর্তনের সবচেয়ে স্পষ্ট চিত্র দেখা যাচ্ছে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে। সেখানে তরুণ, শিক্ষিত ও সম্পদশালী জনগোষ্ঠীর দ্রুত বিস্তারের কল্যাণে পুরো আর্থিক দৃশ্যপট নতুন রূপ নিচ্ছে।
এই পরিবর্তনের মূল কারণ এই প্রজন্মের বিনিয়োগ বিষয়ক মানিসকতার ভিন্নতা। বেবি বুমার (জন্ম ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সাল) প্রজন্ম যেখানে অবসর, মূল্যস্ফীতি থেকে সুরক্ষা বা ভবিষ্যতের নিরাপত্তাকে লক্ষ্য করে বিনিয়োগ করত, সেখানে নতুন প্রজন্মের লক্ষ্য অনেক বেশি তাৎক্ষণিক ও গতিশীল।
নতুন প্রজন্ম বিনিয়োগ করছে নতুন আয়ের উৎস তৈরির জন্য—ভ্রমণ, পরিবারের সহায়তা কিংবা নিজের জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করার জন্য। তাঁদের লক্ষ্য যেমন ভিন্ন, তেমনি সম্পদ গঠনের ধরনও আলাদা। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মূলে আছে এক অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী বিষয়। সেটি হলো আত্মবিশ্বাস।
আত্মবিশ্বাসের অনুঘটকএই আত্মবিশ্বাস কীভাবে জন্ম নিচ্ছে, তা বোঝা জরুরি। কারণ, এটাই তরুণদের আচরণ প্রভাবিত করছে। এটি নিছক আশাবাদ নয়; বরং অর্থনীতি, সমাজ ও প্রযুক্তির মিলিত প্রভাবে তৈরি আত্মনির্ভর মানসিকতা। তাঁদের এই আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠার পেছনে তিনটি অনুঘটক সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। সেগুলো হলো—
১.
আশাবাদ, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস ও দ্রুত পদক্ষেপ
তরুণ বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। তাঁরা ঝুঁকি নিতে ভয় পান না। তাই তাঁরা বাজারে সুযোগ দেখলেই ব্যবস্থা নেন, যেখানে আগের প্রজন্ম ছিল অনেক বেশি সতর্ক ও দীর্ঘমেয়াদি চিন্তায় আবদ্ধ।
২. দ্রুত প্রাথমিক মূলধন লাভ
এই প্রজন্ম আগের তুলনায় অনেক অল্প বয়সেই মূলধন পাচ্ছে। ফলে তারা তরুণ বয়সেই সাহসী ও উদ্ভাবনী বিনিয়োগ কৌশল গ্রহণ করতে পারছে।
৩. গতিশীল আর্থিক লক্ষ্য
এই তরুণদের আর্থিক আকাঙ্ক্ষা শুধু অবসরের জন্য সঞ্চয়ে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁরা এখনই পছন্দের জীবন গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ করছে—বর্তমান জীবনযাত্রার উন্নতিই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য।
এই মানসিক আত্মবিশ্বাস তাঁদের জ্বালানি। সেই সঙ্গে এই বিপ্লবের চালিকাশক্তি হলো প্রযুক্তি। বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তিগত উন্নতির কল্যাণে বিনিয়োগ নতুন মাত্রা পেয়েছে। ফলে বিনিয়োগ এখন সবার নাগালে চলে এসেছে, যদিও একসময় তা ছিল শুধু ধনীদের খেলা।
সহজ বৈচিত্র্যএকসময় বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে বড় অঙ্কের টাকা প্রয়োজন হতো। প্রয়োজন হতো পরামর্শদাতা আর নানা জটিল কাগজপত্রের, কিন্তু এখন তা স্মার্টফোন অ্যাপের কয়েকটি ট্যাপেই সম্ভব হচ্ছে। এই পরিবর্তন বিনিয়োগকারী ও বৈশ্বিক বাজারের সম্পর্কের ভারসাম্য বদলে দিয়েছে।
যেকোনো সময়, যেকোনো দেশ, যেকোনো বাজার—এই নতুন বাস্তবতা তরুণ প্রজন্মের জন্য বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। সময় ও স্থানের বাধা তাদের জন্য আর প্রাসঙ্গিক নয়।
তথ্যের বিস্তৃত উৎসতরুণেরা এখন শুধু প্রচলিত বাজার বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করছেন না; বরং এআইভিত্তিক বিশ্লেষণ, অনলাইন বিনিয়োগ কমিউনিটি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। প্রযুক্তি–নির্ভরতা বাড়লেও তরুণ বিনিয়োগকারীরা মানবিক পরামর্শের গুরুত্ব একেবারে অস্বীকার করছেন না।
প্রযুক্তি যতই উন্নত হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুহূর্তে মানবিক পরামর্শের প্রয়োজন ততই বাড়ছে। তরুণ বা প্রবীণ—দুই ধরনের বিনিয়োগকারীই সংকটময় সময়ে বিশেষজ্ঞ বা সম্পর্ক বিশারদদের কাছ থেকে পরামর্শ চান। এই প্রবণতা এশিয়া অঞ্চলে বিশেষভাবে দেখা যাচ্ছে।
বিনিয়োগকারীরা ব্যক্তিগত পরামর্শ ও ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ—দুটিই একসঙ্গে চান। তাই হাইব্রিড মডেল জনপ্রিয় হচ্ছে, যেখানে উচ্চমানের মানবিক সেবা সহজ ডিজিটাল অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে গেছে।
এই মডেল থেকে বিনিয়োগকারীরা উভয় দিকের সেরা সুবিধা পাচ্ছেন—প্রয়োজনে মানবিক অন্তর্দৃষ্টি, সেই সঙ্গে নিয়মিত ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির স্বাচ্ছন্দ্য। এমন একসময় এটি হচ্ছে যখন আমরা ইতিহাসের বৃহৎ সম্পদ হস্তান্তরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। সম্পদ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আলট্রাটার তথ্যানুসারে, আগামী এক দশকে হস্তান্তর হবে ৩১ লাখ কোটি ডলারের সম্পদ।
প্রজন্মের সেতুবন্ধএই আসন্ন সম্পদ হস্তান্তর কেবল একমুখী প্রক্রিয়া নয়, এটি পরস্পর থেকে শেখার অসাধারণ সুযোগ। বয়স্ক প্রজন্ম তরুণদের কাছ থেকে প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা শিখতে পারে—অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ, বৈশ্বিক বাজারে অংশগ্রহণ ও নতুন বিনিয়োগের সাহস সঞ্চয় করতে পারে। অন্যদিকে তরুণেরা প্রবীণদের কাছ থেকে মূলধন সংরক্ষণ ও ঝুঁকি বণ্টনের চিরন্তন শিক্ষা নিতে পারেন। এই দ্বিমুখী শিক্ষা যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের ভিত্তি হতে পারে।
সংবাদে বলা হয়েছে, এই দুই প্রজন্মের মধ্যে অর্থনৈতিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে আরও টেকসই বিনিয়োগ ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রজন ম র র জন য ম নব ক তর ণ ব লক ষ য
এছাড়াও পড়ুন:
তুরস্কের যে কৌশলে ‘জিহাদি’ শারা হয়ে উঠলেন সিরিয়ার ‘আমির’
২০১৯ সালের বসন্ত। রুশ বিমানবাহিনীর সহায়তায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ইদলিবের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তৈরি হয় জরুরি পরিস্থিতি।
হায়াত তাহরির আল–শামের (এইচটিএস) নেতা আবু মোহাম্মদ আল–জোলানি (আহমেদ আল–শারা নামে বেশি পরিচিত) তখন ইদলিবের কেন্দ্রস্থলে একটি নিরাপদ বাড়িতে তাঁর সহযোগী ও কয়েকজন বিদেশি অতিথির সঙ্গে বসেছিলেন। অতিথিদের মধ্যে তুর্কিও ছিল।
রাত বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আল–শারা মন খুলে নিজের ব্যক্তিগত কিছু গল্প বলতে শুরু করলেন। ‘আমি ছোটবেলায় একবার স্বপ্ন দেখেছিলাম’, ধীরে, গভীর মনোযোগ নিয়ে বলতে থাকেন তিনি। ‘স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি দামেস্কের আমির হয়েছি।’
আশ–শারা বলেছিলেন, সেই স্বপ্ন ছিল শুভ ইঙ্গিত, নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্রষ্টার একধরনের বার্তা। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট স্বৈরশাসক বাশার আল–আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা কঠিন হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেতা সম্ভব। তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা, যাঁদের মধ্যে সালাফি পটভূমির লোকও ছিলেন। বলেছিলেন, সেই স্বপ্ন সত্যি তিনি বিশ্বাস করতেন।
ওই গল্প বলার প্রায় পাঁচ বছর পর আহমেদ আল–শারা তাঁর বিদ্রোহী খেতাব কাটিয়ে সিরিয়ান আরব রিপাবলিকের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ সেই ‘আমির’ হন, যার স্বপ্ন তিনি একসময় দেখেছিলেন।
রাত বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আল-শারা মন খুলে নিজের ব্যক্তিগত কিছু গল্প বলতে শুরু করলেন। ‘আমি ছোটবেলায় একবার স্বপ্ন দেখেছিলাম’, ধীরে, গভীর মনোযোগ নিয়ে বলতে থাকেন তিনি। ‘স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি দামেস্কের আমির হয়েছি।’এখন জোলানি নিজের জন্মনাম আহমেদ আল–শারা নামে পরিচিত। ৪৩ বছরের শারা খুব দ্রুতই নিজের পরিচয় পাল্টে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। একসময়ের ‘জিহাদি সন্ত্রাসী’ (যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কথায়) থেকে এখন রাষ্ট্রনেতা তিনি। ইরাক থেকে সিরিয়া। দীর্ঘ সময় আল–কায়েদা ঘরানার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীতে সক্রিয় থাকার পর এমন পরিবর্তন বিস্ময়করই বলা যায়।
আসাদ পরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর শারা এখন সেসব বিশ্বনেতার সঙ্গেও মিশছেন, যাঁদের তিনি একসময় এড়িয়ে চলতেন। তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জনসমক্ষে উপস্থিত হন, শ্মশ্রু ছোট করেছেন, পাগড়ি ও থোব (ঐতিহ্যবাহী দীর্ঘ ঢিলেঢালা পোশাক) ছেড়ে স্যুট–টাই পরছেন। সব মিলিয়ে এমন একটি নতুন রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা করছেন, যেখানে স্পষ্ট ইসলামি প্রভাব নেই।
কিন্তু এ রূপান্তর কীভাবে সম্ভব হলো
তুরস্কসহ আঞ্চলিক কর্মকর্তারা, সিরীয় সূত্র, বিশেষজ্ঞ, এমনকি সিরিয়ার সরকারি শাসনব্যবস্থার ভেতরের লোকেরাও মনে করেন, ইদলিবে শারার শাসনামলেই ধীরে ধীরে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ভূমিকার এ পাল্টে যাওয়া শুরু হয়। ইদলিব মূলত একধরনের অনানুষ্ঠানিক ‘ক্ষুদ্র রাষ্ট্র’ হয়ে উঠেছিল, যা শারার ভাবমূর্তিকে পুনর্গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
‘তাঁর (আল–শারা) রূপান্তরে তুরস্ক খুবই বাস্তব ভূমিকা রেখেছে’, এইচটিএসের নেতা থাকাকালীন শারার সঙ্গে দেখা করা একজন তুর্কি কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন।
তুরস্কের সঙ্গে প্রথম বড় যোগাযোগ
তুর্কি কর্মকর্তার মতে, শারার নিজেরও বদলে যাওয়ার কারণ ছিল। সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে টিকে থাকতে হতো, আর তুরস্কই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা। কারণ, তিনি এমন এক এলাকায় আটকে ছিলেন, যেখানে আঙ্কারা ছিল তাঁর জীবনসঞ্চারণী রেখার মতো।
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে, ১৪ মে ২০২৫