‘হয় তুমি এ পক্ষে, নয় তুমি ও পক্ষে’—এর বাইরে কি কোনো ধারণা নেই
Published: 25th, October 2025 GMT
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যেন দুই মেরুর টানাটানিতে পরিণত হয়েছে। একদিকে রয়েছে নিউ লেফট বা নতুন বামপন্থী চিন্তাধারা। এই চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন যোগেন্দ্র যাদবের মতো বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা দাবি করছেন, নিম্নবর্ণ ও বঞ্চিত শ্রেণির সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষোভই রাজনীতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিত।
অন্যদিকে রয়েছে ডানপন্থী সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ—রাম মাধবের মতো চিন্তকদের বয়ানে যার মূল সুর হচ্ছে হিন্দুত্ব, সভ্যতার গৌরব ও সংস্কৃতিনির্ভর জাতিসত্তা।
দুদিকেই রয়েছে জোরালো বয়ান, প্রবল যুক্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারত কি অনন্তকাল এ দুই চরমের দোলাচলে দুলতেই থাকবে? নাকি, তৃতীয় এমন কোনো পথ আছে, যা দুই দিকের চরমপন্থী শক্তিকে সংযত করে তাদের সীমা লঙ্ঘন থেকে মুক্ত একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যেতে পারে?
আমার মনে হয় আছে। সেই পথ হলো ‘র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম’ বা ‘কট্টর মধ্যপন্থা’।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম কোনো কুসুমকোমল আপসনীতি নয়; বরং এটি সাহসী এক পুনঃকল্পনা। এটি এমন এক রাজনীতি, যা বহুত্ববাদকে ধারণ করে। কোনো কিছুর পরিচয় মুছে দেয় না, বরং তার উন্নয়ন চায়, তবে সমতা বিসর্জন দেয় না। এই মতাদর্শ সভ্যতার ঐতিহ্যকে সম্মান করে, কিন্তু বিশ্বজনীনতার দরজা বন্ধ করে না। এটি ঐক্য চায়, কিন্তু এক রূপের মোহে পড়ে না।
এই রাজনীতি নেহরু ও সরদার প্যাটেলের মধ্যে বেছে নিতে বাধ্য নয়। এই রাজনীতি ‘রাজাজি’ সি রাজাগোপালাচারী ও বি আর আম্বেদকরের মধ্যে বিভাজন মানে না। এটি বামপন্থার নৈতিক স্বচ্ছতা ও ডানপন্থার সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস—দুয়েরই গুণ একত্র করে একটি বাস্তববাদী ও ভবিষ্যৎমুখী রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করতে চায়।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের মূলে রয়েছে ভারতের বহুত্ববাদ। কিন্তু এটি নিছক সহনশীলতা নয়, এটি ভিন্নতার সক্রিয় উদ্যাপন। নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের ধারণা যেমন ভারতের ভিত্তি স্থাপন করেছিল, র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম সেই ভাবনাকে আরও প্রসারিত করতে চায়।
আরও পড়ুনটার্গেট তাজমহল: বলিউডের নতুন হিন্দুত্ববাদী পণ্য ও বিভাজনের রাজনীতি২৩ অক্টোবর ২০২৫বহুত্ববাদ কেবল ধর্ম বা ভাষার বিষয় নয়; এটি জাত, লিঙ্গ, অঞ্চল ও শ্রেণির জীবন্ত বাস্তবতার প্রতিফলন। তাই এই পথ একদিকে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের একরূপীকরণের প্রবণতাকে, অন্যদিকে পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির বিভাজনকেও প্রত্যাখ্যান করে।
এটি এমন জোট গঠনের আহ্বান জানায়, যা ক্ষুদ্র ভোটব্যাংকের বাইরে গিয়ে বৃহত্তর ভারতীয় ভাগ্যকে স্পর্শ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিহারের এক দলিত নারী কিংবা ছত্তিশগড়ের এক আদিবাসী কৃষক কেবল বঞ্চনার প্রতীক নন; বরং তাঁরাই ভারতের মূল কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের একটি বড় কাজ হলো জাতীয়তাবাদকে বর্জনের কবল থেকে মুক্ত করা। সরদার প্যাটেলের জাতীয়তাবাদ ছিল বাস্তববাদী ও ঐক্যনিষ্ঠ। আজ ভারতের প্রয়োজন এমন এক জাতীয়তাবাদ, যা বাঁধে, কিন্তু অন্ধ করে না। আজ ভারতের দরকার এমন দেশপ্রেম, যা আত্মবিশ্বাসী কিন্তু দাম্ভিক নয়।
আমার ‘দ্য ব্যাটেল অব বিলঙ্গিং’ বইয়ে আমি যুক্তি দিয়েছি, ভারতের জাতীয়তাবাদকে হতে হবে নাগরিক–ভিত্তিক (সিভিক); ধর্মীয় বা জাতিগত নয়। সংবিধানই ভারতের মূল্যবোধের সর্বোচ্চ প্রকাশ—এই সত্যকে স্বীকার করাই প্রকৃত দেশপ্রেম।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের কেন্দ্রে থাকতে হবে সামাজিক ন্যায়বিচার। নিপীড়িতদের অধিকারের পক্ষে আম্বেদকরের যে সংগ্রাম ছিল, তা কেবল কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য ছিল না; এটি ছিল মানবমর্যাদার সর্বজনীন দাবি। তাঁর সংবিধানিক নৈতিকতার ধারণাই রাজনীতির পথনির্দেশক হওয়া উচিত।বিরোধিতা বা ভিন্নমত কোনো বিশ্বাসঘাতকতা নয়; এটি গণতন্ত্রের সুস্থতার লক্ষণ। কারণ, ভারতের ধারণা কোনো পাথরে খোদাই করা স্থির বাণী নয়; এটি এক জীবন্ত, বিকশিত সংলাপ।
রাজাজির মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শন এবং মনমোহন সিংয়ের সংস্কারের নীতি লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি অসমতা বাড়িয়েছে এবং বহু জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম এ বাস্তবতাকে স্বীকার করে। এটি বাজারকে গ্রহণ করে, কিন্তু বাজারপূজা করে না। এর লক্ষ্য হলো নৈতিক বোধসম্পন্ন উন্নয়ন।
এর মানে হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোসহ জনসেবায় বিনিয়োগ বাড়ানো, পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা তৈরি ও জটিল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শিথিল করা।
কল্যাণনীতিকে হতে হবে লক্ষ্যভিত্তিক ও দক্ষ, কিন্তু জনতুষ্টিমূলক নয়। অর্থনৈতিক সুযোগের মতোই অর্থনৈতিক মর্যাদাও সমান গুরুত্বপূর্ণ—এ কথা মনে রাখতে হবে।
আজকের মেরূকৃত রাজনীতিতে ঐকমত্য গঠনের প্রয়াসকে অনেকেই দুর্বলতা বলে মনে করেন। কিন্তু অটল বিহারি বাজপেয়ী প্রমাণ করেছিলেন—ঐকমত্যই প্রকৃত শক্তি হতে পারে।
আরও পড়ুন‘ইন্ডিয়া’কে ‘ভারত’ করার গোপন কারণ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩নিজ দলের মধ্যেও ভিন্নমতের মানুষকে একত্র করতে অটল বিহারি বাজপেয়ীর যে দক্ষতা ছিল, তা কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়; সেটি ছিল গণতান্ত্রিক প্রজ্ঞা।
আজকের বিভাজিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম সেই ঐকমত্যের চেতনা পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। এটি আলোচনা, সংলাপ ও প্রতিষ্ঠানের দৃঢ়তাকে গুরুত্ব দেয়। কারণ, শাসনব্যবস্থা কোনো শূন্য যোগফলের খেলা নয়; এটি একটি যৌথ প্রয়াস।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের কেন্দ্রে থাকতে হবে সামাজিক ন্যায়বিচার। নিপীড়িতদের অধিকারের পক্ষে আম্বেদকরের যে সংগ্রাম ছিল, তা কেবল কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য ছিল না; এটি ছিল মানবমর্যাদার সর্বজনীন দাবি। তাঁর সংবিধানিক নৈতিকতার ধারণাই রাজনীতির পথনির্দেশক হওয়া উচিত।
এর মানে, জাতভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই হতে হবে কেবল বক্তৃতায় নয়, বাস্তব নীতিতেও। প্রতিটি মানুষের প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব, সুযোগের প্রাপ্তি ও আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, ন্যায়বিচার কোনো অনুগ্রহ নয়। এটি সংবিধানের মৌলিক অঙ্গীকার।
আরও পড়ুনবাঘের পিঠে সওয়ার বিজেপি, সামলাতে পারবে তো?২৯ ডিসেম্বর ২০২১একটি র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিস্ট এজেন্ডার মূল দিকগুলো হতে পারে—
১.
২. অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি: বাজার সংস্কার ও লক্ষ্যভিত্তিক সামাজিক বিনিয়োগের সমন্বয়, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ডিজিটাল অবকাঠামোয়।
৩. নাগরিক জাতীয়তাবাদ: সংবিধাননির্ভর যৌথ ভারতীয় পরিচয় গঠন; অর্থাৎ ধর্মীয় বা জাতিগত একচেটিয়াত্বকে ‘না’ বলা। একই সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি থাকবে, যা বৈশ্বিক পরিসরে ভারতের স্বার্থ সুরক্ষিত করবে।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা জোরদার করা। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে উৎসাহ দেওয়া, যেন তারা সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হতে পারে।
৫. অংশগ্রহণমূলক শাসন: নাগরিক সম্পৃক্ততা, বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বচ্ছ নীতিনির্ধারণ নিশ্চিত করা।ভারত এত বৈচিত্র্যময়, এত জটিল, এত গতিশীল যে একরৈখিক মতাদর্শ দিয়ে তাকে পরিচালনা করা যায় না। এর সমস্যাগুলো সমাধান করতে প্রয়োজন চটপটে, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতি।
এসব লক্ষ্য কোনো কল্পনাপ্রসূত ইউটোপিয়া নয়। এটি সেই বিশ্বাস, যা আমি রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকে ধারণ করে আসছি, সংসদে উচ্চারণ করেছি, জনসভায় বলেছি এবং আমার লেখায় বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছি।
এটি এমন এক রাজনৈতিক রূপরেখা, যা ক্ষমতা নয়, বরং উদ্দেশ্য খোঁজে, যা নীতিতে দৃঢ়, অন্তর্ভুক্তিতে সাহসী এবং ভবিষ্যৎ–চিন্তায় অগ্রগামী।
আজকের ভারতীয় রাজনৈতিক আলোচনায় এক ভয়ানক দ্বৈততা সবকিছু গ্রাস করেছে। বাম বনাম ডান, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ব বনাম সংখ্যালঘু, পুনর্বণ্টন বনাম প্রবৃদ্ধি—এ রকম দ্বৈততা দেখা যাচ্ছে।
এই দ্বৈততা বাস্তবতাকে সরলীকৃত করে এবং সমাজে বিষাক্ত বিভাজন তৈরি করে। এটি নাগরিকদের পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করে, যেখানে তারা আসলে সমাধান খুঁজতে চায়।
আমাকে প্রায়ই অভিযুক্ত করা হয়—আমি নাকি ‘অন্য পক্ষের’ কিছু অবস্থানে গুণ খুঁজে পাই। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি কোনো পক্ষের নই; আমি কেবল ভারতের পক্ষেই আছি।
ভারত এত বৈচিত্র্যময়, এত জটিল, এত গতিশীল যে একরৈখিক মতাদর্শ দিয়ে তাকে পরিচালনা করা যায় না। এর সমস্যাগুলো সমাধান করতে প্রয়োজন চটপটে, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতি।
আমার কাছে র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম কোনো মাঝামাঝি অবস্থান নয়। এটি তার চেয়ে উচ্চতর পথ। এটি পার্থক্য ভাগ করার কথা বলে না; বরং পার্থক্যকে পুনর্নির্ধারণের আহ্বান জানায়। এটি চরমপন্থা এড়িয়ে চলা নয়; বরং তাদের অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞাকে একত্র করার প্রয়াস।
যখন ভারত ২০৪৭-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, আমরা কি এমন রাজনীতি গড়তে পারি, যা ঐতিহ্যের সেরা দিক ও ভবিষ্যতের সাহসী স্বপ্ন—দুটিকেই ধারণ করে?
আমরা কি দ্বৈততার ফাঁদ পেরিয়ে র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের সম্ভাবনাকে আলিঙ্গন করতে পারব?
হয়তো সঠিক উত্তরটি কোনো এক পক্ষকে বেছে নেওয়ার মধ্যে নয়, বরং ভারতকেই বেছে নেওয়ার মধ্যে নিহিত।
শশী থারুর ভারতের টানা চতুর্থবার নির্বাচিত লোকসভা সদস্য ও দেশটির কংগ্রেসদলীয় সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ই র জন ত র জন ত ক র জন ত র ব স তবত দ ব তত লক ষ য ক ত কর ব ভ জন আরও প
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদে ঐক্য গড়তে তৎপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
রাষ্ট্র সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে গত কয়েক মাস ধরে এগিয়ে আসছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’। এই সনদে স্বাক্ষর করাকে ঘিরে এখন রাজনৈতিক মহলে প্রতিযোগিতা ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এরইমধ্যে ২৫টি রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর করেছে। তবে বামপন্থী চার দল এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো সই করেনি। এই কারণে স্বাক্ষর আদায়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তৎপরতা বাড়িয়েছে।
কমিশনের গঠন ও কার্যক্রম
জানা গেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বর্তমান রাষ্ট্রসংস্থান, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন সংস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে এই সনদ প্রণয়ন করেছে।
কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে। এরপর ধারাবাহিক আলোচনার পর ২৮ জুলাই ২০২৫ তারিখে সনদের খসড়া ঘোষণা করা হয়। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর মতামত আহ্বান শেষে ১৭ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সনদে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করা হয়।
স্বাক্ষরের অগ্রগতি
আয়োজিত অনুষ্ঠানে কমিশনের প্রধান উপদেষ্টা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মোট ২৫টি রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর করে। অনুষ্ঠানে স্বাক্ষর শেষে সনদ উঁচিয়ে দেখানোর মুহূর্তগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
বাকি দল ও তাদের শর্ত
যদিও বড় দলগুলো এরইমধ্যে স্বাক্ষর করেছে, তবু বামধারার চারটি দল- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ এখনও সই করেনি।
তারা সাত দফা দাবিসহ একটি স্মারকলিপি দিয়েছে। প্রধান আপত্তিগুলো হলো-
সনদের প্রথম অংশে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়নি।
ভিন্নমত সংযুক্তির বিষয়ে এনেক্স সংযোজনের প্রস্তাব থাকলেও তার সংবিধানিক কার্যকারিতা স্পষ্ট নয়।
সনদে বলা হয়েছে “কেউ সনদ নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে না” যা তারা নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী বলে মনে করছে। সংবিধানের ১৫০(২) ও ১০৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব তারা গ্রহণ করছে না।
অন্যদিকে, এনসিপি জানিয়েছে, তাদের তিনটি শর্ত পূরণ হলে তারা সনদে স্বাক্ষর করবে।
দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, “কমিশন আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করেনি, তাই আমরা সেদিন সই করিনি। তবে আলোচনা চলছে। শর্তগুলো পূরণ হলে আমরা অবশ্যই স্বাক্ষর করব।”
কমিশনের কৌশল ও প্রস্তুতি
কমিশন এখন বাকি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও সংলাপ বাড়িয়েছে। যেসব দল এখনও মতামত দেয়নি, তাদের দ্রুত মতামত জানাতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “দল ও বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে আলোচনা চলছে। সনদ প্রণয়নের পাশাপাশি বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি করতে হবে, যাতে এটি শুধু প্রতিশ্রুতির কাগজ না হয়ে বাস্তব পরিবর্তনের ভিত্তি হয়।”
সনদের মূল বিষয়বস্তু
খসড়া প্রকাশের সময় সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলো ছিল ভাষার অধিকার: প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা থাকবে, পাশাপাশি অন্যান্য মাতৃভাষার ব্যবহার ও স্বীকৃতি সংবিধানে যুক্ত করা হবে।
সংবিধান, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।
এসব সংস্কার পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের প্রস্তাব। সংশ্লিষ্ট আইনি পরিবর্তন ও সংবিধান সংশোধনের নির্দেশনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
চ্যালেঞ্জ ও উদ্বেগ
সনদটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ হলেও এর বাস্তবায়নে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, বাম দল ও এনসিপির শর্ত ও আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। বাস্তবায়নের রূপরেখা এবং টাইমলাইন স্পষ্ট নয়।
আদালতে চ্যালেঞ্জ নিষিদ্ধের ধারা ও সংবিধান পরিবর্তনের অস্পষ্টতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সব দল একসাথে না থাকলে সংস্কার কার্যক্রম রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠতে পারে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ দিক
বিশ্লেষকদের মতে, এই সনদ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে— নির্বাচন, সংবিধান, বিচার ও প্রশাসনিক সংস্কারের একটি স্বীকৃত নকশা তৈরি হবে।
দলগুলোর মধ্যে সংলাপ বাড়বে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। বিদেশি বিনিয়োগ ও নাগরিক আস্থা বাড়তে পারে, কারণ শাসন সংস্কারের রূপরেখা স্পষ্ট হবে। তবে যদি সনদ কেবল প্রতিশ্রুতিতেই সীমিত থাকে, তাহলে এটি রাজনৈতিক হতাশা তৈরি করতে পারে- বিশেষত যারা এতে অংশ নিচ্ছে না বা শর্ত দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলের বক্তব্য
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটি সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ (July National Charter) স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে কিছু দল তাদের স্বাক্ষর দিচ্ছে না, তবে সেটি আগামী দিনে করার সুযোগ এখনো খোলা রয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “চুক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার পরও কাজ অনেক আছে, এটি শুরু মাত্র। আমরা আশা করি পূর্ণ বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাবে। রাষ্ট্র আবেগভিত্তিকভাবে চলবে না, আইন‐নীতির ভিত্তিতে চলবে।”
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’র নায়েবে আমীর তাহের বলেছেন, “যদি জুলাই সনদকে আইনগত ভিত্তি দেওয়া না হয়, তাহলে আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও সরকারকে মীমাংসার জন্য মামলা করব। আমরা ইতিমধ্যে বলেছি আমরা সনদ স্বাক্ষর করব না, যদি আইনগত ভিত্তি না থাকে। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আক্তার হোসেন বলেছেন, “আমরা মূলভিত্তিক সংস্কার এবং আইনগত বাধ্যবাধকতা ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব না। অনেকে ভেবেছেন স্বাক্ষর মানে সব মেনে নেওয়া কিন্তু তা ভুল। যদি সনদ কার্যকরভাবে প্রয়োগযোগ্য না হয়, আমরা স্বাক্ষর করব না।”
নাগরিক মত
ঢাকা–৮ আসনের ভোটার ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, “'জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’ বাংলাদেশের চলমান সংস্কার আন্দোলনের একটি বড় মাইলফলক হতে পারে। রাজনৈতিক দল, কমিশন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে আলোচনায় এসেছে এটি আশাব্যঞ্জক। তবে বাম দল ও এনসিপির শর্ত এবং বাস্তবায়নের রূপরেখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কমিশন সক্রিয়ভাবে দলগুলোকে যুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যদি সনদ বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি কেবল একটি কাগজ নয় একটি পরিবর্তনের সূচক হয়ে উঠবে।
ঢাকা/এস