গত কয়েক দিনে যত সংবাদমাধ্যম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, টক শোতে ডেকেছে, তাদের সবার মূল আলোচ্য বিষয় ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়। এটাই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রীর ফাঁসির রায় এই প্রথম। তা ছাড়া শেখ হাসিনা শেখ মুজিবের কন্যা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নেতা হিসেবে সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন। এখনো আলোচনার শীর্ষে তিনি আছেন।

আমার কাছে সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রশ্ন ছিল—প্রথমত, এই রায়ে আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া কী? দ্বিতীয়ত, আগামীর রাজনীতিতে এই রায় কী প্রভাব ফেলবে এবং তৃতীয়ত, ভারত কি শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করবে?

প্রথমেই বলি, কোনো মানুষের মৃত্যুতে (তা সে মৃত্যু যেভাবে, যে কারণেই হোক) আনন্দিত হতে পারি না। অনেক উন্নত দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না। কারণ, সম্ভবত এই কারণে যে সে ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষটি অনুশোচনায় দগ্ধ হয় না। আবার এ–ও ঠিক, মানবতাবিরোধী অপরাধ যাঁরা করেন, তাঁরা তো বিচারের বাইরে থাকতে পারেন না।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনার ফাঁসির রায় এবং তাঁর রাজনৈতিক মৃত্যু১৭ নভেম্বর ২০২৫

হিটলার, মুসোলিনি ও চেঙ্গিস খানের মতো মানুষের মৃত্যুদণ্ড হলে আমার মধ্যে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া হয় না। মনে হয় এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ হয়, তখন আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়। কত বড় (গুণের অর্থে বলছি না, নামডাকে, লুটপাটে এবং কুকর্মে) মানুষ ছিলেন তিনি!

ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, অনেক কথাই হয়েছে। সেই মানুষের এই পরিণতি না দেখতে পেলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু ইতিহাস নির্মম। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। কষ্ট লাগে; কিন্তু এই কষ্ট লাগার জন্য নিজেকেই শাসাই।

কেন কষ্ট লাগবে? হাজার গুণ বেশি কষ্ট তো এই দেশের মানুষ পেয়েছে। তিনি এবং তাঁর সরকার দিয়েছে।

দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে আসি। গত বছর আগস্ট মাসের ৪ তারিখেও আমাকে অনেকে ফোন করেছেন (ঢাকা শহরে, সারা দেশের তখন রক্তের হোলি খেলা চলছে; আর শেখ হাসিনা নিজে সেই খেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন)। তাঁদের প্রশ্ন, ‘ভাই, কিছু হবে? শেখ হাসিনাকে সরাতে পারবেন?’

আরও পড়ুনহাসিনার বিচার: ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়’ ও তথ্যপ্রমাণ২৩ নভেম্বর ২০২৫

আমি স্বভাবসুলভ রাজনৈতিক বয়ানের মতো জবাব দিয়েছি, নিশ্চয়ই জিতব! ফ্যাসিবাদ কখনো জেতেনি; কিন্তু নিজের মনের মধ্যেও এ রকম প্রশ্ন বুদ্‌বুদের মতো উঠছিল-নিভছিল। ১৫ বছরে মানুষও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল হাসিনা অজেয়। কিন্তু হাসিনার পরাজয় এবং পলায়ন আরেকবার এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল যে কোনো স্বৈরাচার শেষ পর্যন্ত টেকেননি।

হাসিনা পরাজয় মানতে চাননি। তাঁর দলের লোকজনও, বিশেষ করে যাঁরা ভারতে পালিয়েছিলেন, তাঁরাও পরাজয় মানতে চাননি। ১৯ নভেম্বর প্রথম আলোর সংবাদে দেখলাম, হাসিনার কোনো অনুশোচনা নেই। পরদিন ২০ তারিখে দেখলাম, তাঁর দলের যাঁরা ভারতে পালিয়ে গিয়েছেন, তাঁদেরও একই অবস্থা।

গত ১৫ মাস হাসিনা ভারতে থেকেও যেভাবে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে বিষোদ্‌গার করেছেন, একভাবে বলা যায়, এই সরকার উৎখাত করার মতো আহ্বান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অথচ এই রকম হতেই হবে, এমন কথা নয়। এর ভিন্ন কিছু হতে পারত।

হাসিনার এই রায়ের মধ্য দিয়ে আবার বোঝা গেল কেউ অজেয় নয়। এটা এখন ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ভাবতে শুরু করেছেন। আমি ব্যক্তিগত খবর নিয়ে জানি, আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে পরিচিত গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই হতাশার বিস্তার ঘটছে। অনেকেই ভাবছেন, শেখ হাসিনা কি আর দেশে ফিরতে পারবেন? আওয়ামী লীগ কি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?

আমি দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনের কথা বলছি। অনেকে আলোচনা করেছেন, সংবাদমাধ্যমগুলোতে মতামতও এসেছে। তাঁরা বলছিলেন, আওয়ামী লীগ তাদের শাসনকালে যে দুঃশাসন চালিয়েছে, তার জন্য তাঁদের অনুতপ্ত হওয়া উচিত। যা কিছু অন্যায়–অত্যাচার করেছে, তার জন্য মাফ চেয়ে তাঁদের পরিশোধিত হওয়া উচিত।

কথা এসেছিল, রিফাইন্ড বা পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ নিয়ে জনগণের সামনে আসা উচিত। আওয়ামী লীগের মধ্যে এত কিছুর পরও এখনো মানুষ আছেন, যাঁদের মানুষ পছন্দ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পথে হাঁটছে বলে মনে হয় না। দলটির মধ্যে ব্যক্তিবাদ, পরিবারতন্ত্র এভাবে জেঁকে বসেছে যে শেখ হাসিনা বা তাঁর পরিবারকে বাদ দিয়ে কাউকে নেতৃত্বে আনলে যে তা দলের জন্য ভালো হতে পারে, সে কথার বলার সাহস কেউ রাখেন না।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনার বিচার: আসামিপক্ষের দুর্বল আইনি সহায়তা ও ত্রুটিপূর্ণ বিচারিক যুক্তি১৯ নভেম্বর ২০২৫

আগেই বলেছি, হাসিনার এই রায়ের মধ্য দিয়ে আবার বোঝা গেল কেউ অজেয় নয়। এটা এখন ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ভাবতে শুরু করেছেন। আমি ব্যক্তিগত খবর নিয়ে জানি, আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে পরিচিত গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই হতাশার বিস্তার ঘটছে। অনেকেই ভাবছেন, শেখ হাসিনা কি আর দেশে ফিরতে পারবেন? আওয়ামী লীগ কি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?

এবার আসি সংবাদমাধ্যমের ৩ নম্বর প্রশ্নে। শেখ হাসিনার এই ফাঁসির রায় কি কার্যকর হবে? ভারত কি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণ করবে? আমার মনে হয় না! শেখ হাসিনা যখন ভারতের মাটিতে বসে চব্বিশের অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলেন; তখনো একবার বাংলাদেশের সরকার তাঁকে ফেরত চেয়েছিল। ভারত ফেরত দেয়নি।

ভারত তো তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে যে তারা বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী হবে। এটিও একধরনের নিরাসক্তির প্রকাশ। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের দিক থেকে ভারতের এ ছাড়া আর করার কী আছে!

তখন শুনেছিলাম, প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেও কোনো একটি আশ্রয়দাতা দেশ যদি মনে করে তাদের আশ্রিত ব্যক্তিকে তাঁর দেশে ফেরত পাঠালে তাঁর জীবননাশ হতে পারে, তাহলে সে ওই আশ্রিত ব্যক্তিকে ফেরত না–ও পাঠাতে পারে। আর এখন সেই ব্যক্তির তো ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তাঁকে ফেরত না পাঠানোর জন্য এই যুক্তি ভারত তো দেখাতেই পারবে।

তা ভারত না–ই পাঠাক। তাতে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে? পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশের ওপরে ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তর যে বিবৃতি পাঠিয়েছে, তার মধ্যে ভারতের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ হয়নি। তারা কেবল বলেছে, তারা এই দণ্ডাদেশ সম্পর্কে অবগত আছে। খুবই নিরাসক্ত একটি প্রকাশ। এই নিরাসক্তির মধ্যেও যখন বাংলাদেশের নির্বাচন হয়ে যাবে, তখন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে?

ভারত তো তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে যে তারা বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী হবে। এটিও একধরনের নিরাসক্তির প্রকাশ। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের দিক থেকে ভারতের এ ছাড়া আর করার কী আছে!

আরও পড়ুনহাসিনার সাজার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী২১ নভেম্বর ২০২৫

পাঠক নিশ্চয়ই এটাও খেয়াল করছেন, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বুধবার দিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাঁদের এ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল এক দিন পরে। কিন্তু অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে খলিলুর রহমান তাঁর সফরসূচিতে পরিবর্তন আনেন।

এদিকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায়ের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, একটি নিকট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি, স্থিতিশীলতাসহ বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছে। খুবই ডিপ্লোমেটিক স্টেটমেন্ট।

আমার মনে হয়, বাংলাদেশের নির্বাচন যথাযথ সময়ে হয়ে যাবে। কোনো অদৃশ্য কারণ, যা জানার উপায় আমার কাছে নেই, সেটি বাদ দিয়ে আমি এই কথা বলছি। ভারতও নির্বাচন থামানোর জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে বলে মনে করি না। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ কী? সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগেরই–বা ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? ভারত যে অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছে (বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্তির কথা বলে), এর তাৎপর্য কী? এর গভীরতা কত? সেটি আমাদের কত দূর নিয়ে যেতে পারে?

এই সরকার থাকতে এর কোনো নিষ্পত্তি হবে না। কারণ, এ সরকার পরিষ্কারভাবে বলেছে, এই টার্মে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে না। এরপর যে সরকার আসবে, তার ওপরই নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ পথচলা, রাজনীতির নির্মাণ।

মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক স ব দম ধ র র জন ত এই র য় র জন য প রব ন প রক শ কর ছ ন আওয় ম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

যেমন ছিল আবু বকর (রা.)-এর বিচার

ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর শাসনামল ছিল খোলাফায়ে রাশিদুনের সূচনা। সে হিসেবে এর গুরুত্বও ছিল অপরিসীম। তাঁর খেলাফতকাল ছিল নবীযুগের একবারে কাছাকাছি।

তাঁর সময়ের বিচারব্যবস্থা ছিল মূলত মহানবী (সা.)-এর বিচারব্যবস্থারই সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ। মহানবী (সা.)-এর যুগে যা কিছু প্রমাণিত ছিল, তা হুবহু সংরক্ষণ ও কঠোরভাবে অনুসরণ করা হতো। যেমন: বিচার-সংক্রান্ত মহানবী (সা.)-এর সময়ের সমস্ত দলিল-প্রমাণ সংরক্ষণ করা এবং সে অনুযায়ী পুরোপুরি কাজ করা। সম্প্রসারিত ইসলামি সাম্রাজ্যের নতুন নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য নতুন আইন তৈরি করা।

রাসুল (সা.)-এর যুগের মতো তাঁর শাসনামলেও বিচারবিভাগকে প্রশাসন থেকে আলাদা করা হয়নি এবং বিচারকাজের জন্য আলাদা কোনো দপ্তরও ছিল না। মদিনায় বিচারবিভাগ দেখাশোনার জন্য তিনি উমর (রা.)-কে নিযুক্ত করেছিলেন।

বিচারকার্যে শুধু উমর (রা.) নন, আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। খলিফা নিজেও বিচার করতেন এবং ফায়সালা দিতেন। এছাড়া রাসুল (সা.) সেসব কাজি ও গভর্নর নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনি তাঁদেরকে স্বপদে বহাল রাখেন। (মুস্তফা জুহাইলি, তারিখুল কাজা ফিল ইসলাম, পৃ. ১৩৪)

আবু বকর (রা.) বিচারকাজ পরিচালনায় চারটি উৎসকে মূল ভিত্তি হিসেবে সামনে রাখতেন— ১. কোরআন, ২. হাদিসে রাসুল। ৩. ইজমা অর্থাৎ, আলেম ও ফকিহ সাহাবীদের পরামর্শ ও ফাতওয়া। ৪. ইজতিহাদ অর্থাৎ, শরিয়তসম্মতভাবে নতুন বা জটিল বিষয়ে আলেম ও ফকিহদের গভীর গবেষণাভিত্তিক সিদ্ধান্ত।

আরও পড়ুনবদরের যুদ্ধবন্দীদের বিচার১৯ মার্চ ২০২৫

আবু বকর (রা.)-এর নীতি ছিল, তাঁর কাছে কোনো মামলা উত্থাপিত হলে প্রথমেই কোরআনে এর সমাধান খুঁজতেন। সেখানে নির্দেশনা পেলে সরাসরি সে অনুযায়ী ফায়সালা করতেন।

কোরআনে না পেলে হাদিসে নববি অনুসন্ধান করতেন। হাদিসেও স্পষ্ট নির্দেশনা না পেলে তিনি উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করতেন, ‘এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর কোনো ফয়সালা সম্পর্কে কি তোমরা জানো?’ 

যদি কেউ নির্ভরযোগ্যভাবে কোনো হাদিস স্মরণ করিয়ে দিত, তিনি বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের মাঝে এখনো এমন লোক আছেন, যাঁরা রাসুলের সিদ্ধান্ত মনে রেখেছেন।’

এরপর সেই ভিত্তিতেই রায় দিতেন। এতেও যদি সমাধান না পেতেন, তাহলে তিনি সাহাবীদের শুরাপরিষদের সভা ডাকতেন। এরপর তাঁদের পরামর্শ ও সম্মিলিত মতামতের ওপর ভিত্তি করেই রায় নির্ধারণ হতো।

এ থেকে বোঝা যায়, শুরার সিদ্ধান্তকে তিনি প্রায় বাধ্যতামূলক মনে করতেন। এমনকি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.)-কে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘তুমি মানুষের পরামর্শ নেবে ও তাদের মতের বিরোধিতা করবে না।’ (ড. মুহাম্মদ রাওয়াস কালাজি, মাউসুআতু ফিকহি আবি বাকরিনিস সিদ্দিক, পৃ. ১৫৫-১৫৬)

বিচারকাজে খলিফা আবু বকর (রা.) সংবাদ গ্রহণ, সাক্ষ্য যাচাই এবং প্রমাণ নিশ্চিত করতে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন।

কাবিসা ইবনে জুয়াইব থেকে বর্ণিত আছে, এক নারী তাঁর নাতির সম্পদে নিজের অংশ দাবি করে আবু বকর (রা.)-এর কাছে এলে তিনি প্রথমে বলেন, ‘আল্লাহর কিতাবে তোমার জন্য কোনো নির্দিষ্ট অংশ পাই না; আর এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর কোনো সিদ্ধান্তও আমার জানা নেই।’

এরপর তিনি উপস্থিত সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলে মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বলেন, তিনি রাসুল (সা.)-কে দেখেছেন, রাসুল (সা.) একজন নানিকে সম্পদের ছয় ভাগের এক ভাগ (ষষ্ঠাংশ) দিতে দেখেছেন। আবু বকর (রা.) তাঁর কথার সাক্ষ্য চাইলেন। তখন মাসলামা (রা.) সাক্ষ্য দিলে তিনি ওই মহিলার জন্য ষষ্ঠাংশের নির্দেশ দিয়ে দেন। ( জাহাবি, তাজকিরাতুল হুফফাজ, দারুল ইলমিয়্যা, বৈরুত, ১/২)

এ ঘটনার মাধ্যমে আবু বকর (রা.)-এর বিচারনীতির একটি মূলনীতি স্পষ্ট হয়, বিচারক শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জ্ঞানের ওপর ভরসা করে ফয়সালা দেবেন না; বরং নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য বা প্রমাণ থাকা আবশ্যক। তাঁর আরেকটি বক্তব্য হলো, ‘আমি যদি কাউকে এমন কোনো অপরাধে লিপ্ত দেখি, যাতে শরয়ি হদ প্রযোজ্য হয়, তবু পরিষ্কার দলিল বা সাক্ষী ছাড়া আমি শাস্তি কার্যকর করব না।’ (সাবহি মিহমাসানি, তুরাসুল খুলাফাইর রাশিদিন, দারুল ইলিম বৈরুত, পৃ. ১৮৬)

আরও পড়ুনকিয়ামতের দিন প্রথম বিচার কার হবে২১ জানুয়ারি ২০২৫

আবু বকর (রা.)-এর শাসনকালে সংঘটিত কয়েকটি বিচারের রায় তুলে ধরা হলো : 

১. বেত্রাঘাতের নির্দেশ : ইমাম মালেক রাহ. নাফে থেকে বর্ণনা করেন, সাফিয়া বিনতে উবায়েদ তাঁকে বলেছেন, এক ব্যক্তিকে আবু বকর সিদ্দিকের কাছে উপস্থিত করা হয়। লোকটি একটি বাঁদির সঙ্গে ব্যভিচার করে এবং বাঁদিটি গর্ভবতী হয়ে যায়। লোকটি নিজেই দোষ স্বীকার করায় সাক্ষীর প্রয়োজন হয়নি। সে অবিবাহিত ছিল; তাই আবু বকর (রা.) তার ওপর ১০০ বেত্রাঘাত কার্যকর করেন এবং তাকে ফিদাক অঞ্চলে নির্বাসিত করেন। (মুওয়াত্তা ইমাম মালেক, কিতাব আল-হুদুদ, হাদিস: ৮৪৮)

আরেক বর্ণনায় বলা হয়েছে—বাঁদি নারীর ব্যাপারে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি, কারণ তার সঙ্গে জোরপূর্বক ব্যভিচার করা হয়েছিল। পরে আবু বকর (রা.) পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই নারীকে সেই ব্যক্তির সঙ্গেই বিবাহবন্ধনে যুক্ত করে দেন।

আবু বকর (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘কেউ যদি ব্যভিচারের পর কোনো নারীকে বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তখন কী করা উচিত?’ তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে উত্তম তাওবা আর নেই; সে যেন তাকে বিয়ে করে নেয় এবং ব্যভিচারের পথ থেকে সরে আসে।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ১২৭৯৬)

২. প্রতিবিধানমূলক ফায়সালা: আলি ইবনে মাজিদা সাহমি (রা.) বলেন, আমি এক ব্যক্তির সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে তার কানের একটি অংশ কেটে ফেলি। পরে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় এলে ঘটনাটি তাঁর সামনে পেশ করা হয়। তিনি উমর (রা.)-কে লক্ষ করে বললেন, ‘উমর, এর কিসাস বা প্রতিবিধানমূলক দণ্ড সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?’ উমর (রা.) একইভাবে তার কান কাটার কথার বললে আবু বকর বললেন, তিনি নবীজিকে বিনিময়ে একটি দাস দেওয়ার কথা বলতে শুনেছেন। (ওয়াকি, আখবারুল কাজা, ২/১০২)

৩. পিতার খরচের ভার সন্তানের ওপর: কায়েস ইবনে আবু হাজিম (রা.) বলেন, আমি আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর পাশে বসে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁর পিতার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা! আমার এই পিতা আমার পুরো সম্পদ নিতে চান, যদিও তাঁর প্রয়োজন আছে।’ আবু বকর (রা.) পিতাকে লক্ষ করে বললেন, ‘তোমার যতটুকু প্রয়োজন, তুমি তোমার সন্তানের সম্পদ থেকে ততটুকুই নিতে পারো।’

এ কথা শুনে লোকটি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা, রাসুল (সা.) কি বলেননি, “তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার জন্য?”’ জবাবে আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ যা পছন্দ করেন, তুমিও তা-ই পছন্দ করো।’ অন্যান্য বর্ণনায় আছে, এখানে সম্পদ নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো ভরণ-পোষণের খরচ, যা সন্তানের ওপর পিতার ন্যায্য অধিকার। (আস-সুনানুল কুবরা, ৭/৪৮১)

উপরের ঘটনাগুলোই সিদ্দিকি যুগে সংঘটিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার উদাহরণ। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর শাসনামলের বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল দুর্বলদের সহায়তা, মজলুমের হক আদায় এবং সমতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত। ফায়সালা যার ব্যাপারেই হোক—খলিফা, গভর্নর বা সমাজের বড় কেউ—বিচারক নিরপেক্ষভাবে রায় দিতেন এবং তা সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবায়ন করা হতো। (মুস্তফা জুহাইলি, তারিখুল কাজা ফিল ইসলাম, পৃ. ১৬০)

আরও পড়ুনবনি কুরাইজা যুদ্ধের বিচার২৯ আগস্ট ২০২৩

সম্পর্কিত নিবন্ধ