ভূমিকম্পে আতঙ্কিত শিশু বলছে, ‘মা, আমি ঢাকায় থাকতে চাই না’
Published: 24th, November 2025 GMT
সুমাইয়া আফরিন রান্না করছিলেন। ভার্টিগো নামক অসুস্থতা থাকায় ভেবেছিলেন, তাঁর মাথা ঘোরাচ্ছে। কিন্তু চুলায় থাকা ভাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন, কিছু একটা ঘটছে।
গোসলে থাকা মেয়ের চিৎকার কানে আসে সুমাইয়ার। তিনি কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে গ্যাসের চুলা বন্ধ করেন।
চারপাশের জিনিসপত্র, থাই গ্লাসের জানালায় ঝনঝন শব্দ হচ্ছিল। এরপর বাথরুমের সামনে গিয়ে দেখলেন, তাঁর মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মেয়েকে টাওয়েল দিয়ে জড়িয়ে তিনতলা থেকে নেমে গ্যারেজে আসেন।
তখনো চারপাশ দুলছে। কাঁপুনি থামার পর আবার মেয়েকে কোলে করে তিনতলায় নিয়ে ফ্রক পরিয়ে নিচে এসে অন্যদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন সুমাইয়া।
রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বরের বাসিন্দা সুমাইয়া এভাবেই গত শুক্রবারের ভূমিকম্পের সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ৮ বছর বয়সী মেয়ে তাসনুভা আফরিনকে নিয়ে সে সময় বাসায় একাই ছিলেন এই মা। মেয়ের বাবা ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে ছিলেন।
শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। এই ভূমিকম্পে শিশুসহ ১০ জন নিহত হন। আহত ছয় শতাধিক ব্যক্তি। পরদিন শনিবার তিনবার ভূমিকম্প হয়।
সুমাইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন মেয়ে চোখ খোলার পর থেকে সমানে চিৎকার করছিল। বলছিল, মা, বাড়ি ক্র্যাশ করছে। আমাকে সেফ জায়গায় নিয়ে যাও। আমি ঢাকায় থাকতে চাই না।’
ঘটনার পর থেকে মেয়ে তাঁকে আঁকড়ে ধরে থাকছে বলে জানালেন সুমাইয়া। তিনি বলেন, মেয়ে এখন বাথরুমে যেতে ভয় পাচ্ছে। রাতে ঘুমাচ্ছে না। চারপাশে কোনো শব্দ শুনলেই ভয় পাচ্ছে। ভুল বকছে, অসংলগ্ন কথা বলছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য গতকাল রোববার মেয়েকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন সুমাইয়া। তবে আবার ভূমিকম্প হতে পারে ভেবে মেয়ের স্কুলের সামনে পুরোটা সময় বসে ছিলেন তিনি।
সুমাইয়া বলেন, ‘আমার এই বয়সে এমন ভয়ের পরিস্থিতি আর দেখিনি। আমি নিজেও তখন কী করেছি, জানি না। মেয়েকে স্বাভাবিক করার জন্য ভাবছি, ওকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাব।’
এমন পরিস্থিতিতে শিশু তো বটেই, বড়দেরও ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মত দেন মনোচিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভূমিকম্পের বিষয়ে সঠিক তথ্য জানাতে হবে। পাশাপাশি ভূমিকম্প হলে করণীয়গুলো শিশুদের আগেই জানিয়ে রাখতে হবে।
আরও পড়ুনভূমিকম্পের সময় নবজাতকদের যেভাবে আগলে রেখেছিলেন এই চিকিৎসক ও নার্সরা১৮ ঘণ্টা আগেরাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসিন্দা শামীমা আক্তার। তিনি জানালেন, তাঁদের চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে আফরা নাওয়ারকে নিয়েও তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। তাঁদের বাসা ১০ তলায়। শুক্রবারের ভূমিকম্পে মেয়ে খুবই ভয় পায়। তখন কোনোভাবে তাকে শান্ত করা হয়। কিন্তু শনিবার আবার ভূমিকম্প হলে আর কোনোভাবেই মেয়েকে শান্ত রাখা যাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকার খবরাখবরসহ বড়দের আলোচনা থেকে তার ধারণা হয়েছে, আরও বড় ভূমিকম্প হবে। এটা সে মানতে পারছে না।
শামীমা বলেন, মেয়ে শুধু বলছে, এত কম বয়সে মরে যেতে হবে? সে হয় বিদেশে, নয়তো গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। সে কোনোভাবেই ঢাকায় থাকবে না। রোববার মেয়েকে স্কুলে পাঠানো যায়নি। সে বলছে, পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। রাতে ঘরের লাইট পর্যন্ত জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে।
তাসনুভা-আফরাদের মতো আরও অনেক শিশুই ভূমিকম্পের পর আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে বলে বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল। অভিভাবকেরা বলছেন, সন্তানের এমন পরিস্থিতি দেখে তাঁরা উদ্বিগ্ন। কী করবেন, বুঝতে পারছেন না।
আরও পড়ুনভূমিকম্পের সময় কী করব, কী করব না, আগে কী করণীয়২১ ঘণ্টা আগেঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় নারী ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক মা অনিমা ফেরদৌস ফেসবুকে শুক্রবারের ভূমিকম্পের সময়কার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। তিনি তখন কর্মস্থলে এক শিশু রোগীকে দেখছিলেন। তাঁর সন্তানেরা ছিল ঢাকার বাসায় গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে।
বাসার দরজায় তালা লাগান না এই মা। কিন্তু ভূমিকম্পের সময় দরজা কোনোভাবে আটকে গিয়েছিল। ভূমিকম্পের দুলুনি থামলে তিনি সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখেন, তাঁর বড় মেয়েসন্তান আর গৃহকর্মী দরজা খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু দরজা খুলতে পারছে না। আর ছোট ছেলেসন্তান চিৎকার করে কাঁদছে। প্রতিবেশীরা দরজা ভেঙে বাচ্চাদের বের করেন। অন্য স্বজনেরাও পরে বাসায় আসেন।
কর্মস্থল থেকে রাত ১০টায় এই মা বাসায় ফেরেন। ৫ বছর বয়সী ছেলে ঘুমানোর আগে মাকে বলে, ‘আমাকে কেন বাসায় রেখে গিয়েছিলা? আমি তো ভয় পাই ভূমিকম্প, জানো না?’
অনিমা ফেরদৌস তাঁর ফেসবুক পোস্ট শেষ করেছেন, ‘কী অনিশ্চিত জীবন আমাদের’ লিখে।
শুক্র-শনিবার প্রায় ৩১ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা ও এর আশপাশে চারটি ভূমিকম্পের ঘটনায় ঝুঁকির দিকটি যেমন সামনে এসেছে, তেমনি মানুষের মধ্যে আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুনভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ২৩ নভেম্বর ২০২৫কয়েকজন অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের ট্রমা বা ভীতি কীভাবে দূর করবেন, কীভাবে তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক রাখবেন, আবার বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে কী করবেন, এসব নিয়ে তাঁরা ভাবছেন।
এ বিষয়ে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ভয় পাবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেউ ভয় পেলে সে মানসিকভাবে দুর্বল, তেমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ভূমিকম্পের মতো ঘটনায় করণীয় সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানাতে হবে। ভয় পাওয়া ব্যক্তি বা শিশুদের দ্রুত স্বাভাবিক কাজে ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। বন্ধু-স্বজন থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। অনেক সময় পরিবারের বড় সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, তা শিশুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। বুঝতে হবে, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে।
ভয় পেয়েছে—এমন শিশুদের বেলায় তারা যাতে রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে বলে উল্লেখ করেন হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, শিশুরা আবার আতঙ্কিত হয়ে যেতে পারে, এমন আলোচনা তাদের সামনে করা যাবে না। আর আতঙ্কিত হওয়ার মাত্রা যদি বেড়ে যায়, তাহলে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
আরও পড়ুনভূমিকম্পে ঢাকার বড় বিপদ স্পষ্ট হচ্ছে২৩ নভেম্বর ২০২৫ফেসবুকে গুজব-মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ি থাকে বলে উল্লেখ করেন হেলাল উদ্দিন আহমেদ। এ বিষয়ে তিনি সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান। এর বাইরে ভূমিকম্পের সময় করণীয়গুলো যাতে বাস্তবসম্মত হয়, সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন তিনি।
আরও পড়ুনএক দিনে ৩ বার ভূমিকম্প ২২ নভেম্বর ২০২৫আরও পড়ুনভূমিকম্পের সময় কী করবেন, কী করবেন না২৩ নভেম্বর ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ ম কম প র সময় র র ভ ম কম প ব র ভ ম কম প প রথম আল ক পর স থ ত শ ক রব র চ ক ৎসক আতঙ ক ত সন ত ন করণ য় করব ন
এছাড়াও পড়ুন:
যেমন ছিল আবু বকর (রা.)-এর বিচার
ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর শাসনামল ছিল খোলাফায়ে রাশিদুনের সূচনা। সে হিসেবে এর গুরুত্বও ছিল অপরিসীম। তাঁর খেলাফতকাল ছিল নবীযুগের একবারে কাছাকাছি।
তাঁর সময়ের বিচারব্যবস্থা ছিল মূলত মহানবী (সা.)-এর বিচারব্যবস্থারই সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ। মহানবী (সা.)-এর যুগে যা কিছু প্রমাণিত ছিল, তা হুবহু সংরক্ষণ ও কঠোরভাবে অনুসরণ করা হতো। যেমন: বিচার-সংক্রান্ত মহানবী (সা.)-এর সময়ের সমস্ত দলিল-প্রমাণ সংরক্ষণ করা এবং সে অনুযায়ী পুরোপুরি কাজ করা। সম্প্রসারিত ইসলামি সাম্রাজ্যের নতুন নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য নতুন আইন তৈরি করা।
রাসুল (সা.)-এর যুগের মতো তাঁর শাসনামলেও বিচারবিভাগকে প্রশাসন থেকে আলাদা করা হয়নি এবং বিচারকাজের জন্য আলাদা কোনো দপ্তরও ছিল না। মদিনায় বিচারবিভাগ দেখাশোনার জন্য তিনি উমর (রা.)-কে নিযুক্ত করেছিলেন।
বিচারকার্যে শুধু উমর (রা.) নন, আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। খলিফা নিজেও বিচার করতেন এবং ফায়সালা দিতেন। এছাড়া রাসুল (সা.) সেসব কাজি ও গভর্নর নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনি তাঁদেরকে স্বপদে বহাল রাখেন। (মুস্তফা জুহাইলি, তারিখুল কাজা ফিল ইসলাম, পৃ. ১৩৪)
আবু বকর (রা.) বিচারকাজ পরিচালনায় চারটি উৎসকে মূল ভিত্তি হিসেবে সামনে রাখতেন— ১. কোরআন, ২. হাদিসে রাসুল। ৩. ইজমা অর্থাৎ, আলেম ও ফকিহ সাহাবীদের পরামর্শ ও ফাতওয়া। ৪. ইজতিহাদ অর্থাৎ, শরিয়তসম্মতভাবে নতুন বা জটিল বিষয়ে আলেম ও ফকিহদের গভীর গবেষণাভিত্তিক সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুনবদরের যুদ্ধবন্দীদের বিচার১৯ মার্চ ২০২৫আবু বকর (রা.)-এর নীতি ছিল, তাঁর কাছে কোনো মামলা উত্থাপিত হলে প্রথমেই কোরআনে এর সমাধান খুঁজতেন। সেখানে নির্দেশনা পেলে সরাসরি সে অনুযায়ী ফায়সালা করতেন।
কোরআনে না পেলে হাদিসে নববি অনুসন্ধান করতেন। হাদিসেও স্পষ্ট নির্দেশনা না পেলে তিনি উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করতেন, ‘এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর কোনো ফয়সালা সম্পর্কে কি তোমরা জানো?’
যদি কেউ নির্ভরযোগ্যভাবে কোনো হাদিস স্মরণ করিয়ে দিত, তিনি বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের মাঝে এখনো এমন লোক আছেন, যাঁরা রাসুলের সিদ্ধান্ত মনে রেখেছেন।’
এরপর সেই ভিত্তিতেই রায় দিতেন। এতেও যদি সমাধান না পেতেন, তাহলে তিনি সাহাবীদের শুরাপরিষদের সভা ডাকতেন। এরপর তাঁদের পরামর্শ ও সম্মিলিত মতামতের ওপর ভিত্তি করেই রায় নির্ধারণ হতো।
এ থেকে বোঝা যায়, শুরার সিদ্ধান্তকে তিনি প্রায় বাধ্যতামূলক মনে করতেন। এমনকি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.)-কে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘তুমি মানুষের পরামর্শ নেবে ও তাদের মতের বিরোধিতা করবে না।’ (ড. মুহাম্মদ রাওয়াস কালাজি, মাউসুআতু ফিকহি আবি বাকরিনিস সিদ্দিক, পৃ. ১৫৫-১৫৬)
বিচারকাজে খলিফা আবু বকর (রা.) সংবাদ গ্রহণ, সাক্ষ্য যাচাই এবং প্রমাণ নিশ্চিত করতে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন।
কাবিসা ইবনে জুয়াইব থেকে বর্ণিত আছে, এক নারী তাঁর নাতির সম্পদে নিজের অংশ দাবি করে আবু বকর (রা.)-এর কাছে এলে তিনি প্রথমে বলেন, ‘আল্লাহর কিতাবে তোমার জন্য কোনো নির্দিষ্ট অংশ পাই না; আর এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর কোনো সিদ্ধান্তও আমার জানা নেই।’
এরপর তিনি উপস্থিত সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলে মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বলেন, তিনি রাসুল (সা.)-কে দেখেছেন, রাসুল (সা.) একজন নানিকে সম্পদের ছয় ভাগের এক ভাগ (ষষ্ঠাংশ) দিতে দেখেছেন। আবু বকর (রা.) তাঁর কথার সাক্ষ্য চাইলেন। তখন মাসলামা (রা.) সাক্ষ্য দিলে তিনি ওই মহিলার জন্য ষষ্ঠাংশের নির্দেশ দিয়ে দেন। ( জাহাবি, তাজকিরাতুল হুফফাজ, দারুল ইলমিয়্যা, বৈরুত, ১/২)
এ ঘটনার মাধ্যমে আবু বকর (রা.)-এর বিচারনীতির একটি মূলনীতি স্পষ্ট হয়, বিচারক শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জ্ঞানের ওপর ভরসা করে ফয়সালা দেবেন না; বরং নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য বা প্রমাণ থাকা আবশ্যক। তাঁর আরেকটি বক্তব্য হলো, ‘আমি যদি কাউকে এমন কোনো অপরাধে লিপ্ত দেখি, যাতে শরয়ি হদ প্রযোজ্য হয়, তবু পরিষ্কার দলিল বা সাক্ষী ছাড়া আমি শাস্তি কার্যকর করব না।’ (সাবহি মিহমাসানি, তুরাসুল খুলাফাইর রাশিদিন, দারুল ইলিম বৈরুত, পৃ. ১৮৬)
আরও পড়ুনকিয়ামতের দিন প্রথম বিচার কার হবে২১ জানুয়ারি ২০২৫আবু বকর (রা.)-এর শাসনকালে সংঘটিত কয়েকটি বিচারের রায় তুলে ধরা হলো :
১. বেত্রাঘাতের নির্দেশ : ইমাম মালেক রাহ. নাফে থেকে বর্ণনা করেন, সাফিয়া বিনতে উবায়েদ তাঁকে বলেছেন, এক ব্যক্তিকে আবু বকর সিদ্দিকের কাছে উপস্থিত করা হয়। লোকটি একটি বাঁদির সঙ্গে ব্যভিচার করে এবং বাঁদিটি গর্ভবতী হয়ে যায়। লোকটি নিজেই দোষ স্বীকার করায় সাক্ষীর প্রয়োজন হয়নি। সে অবিবাহিত ছিল; তাই আবু বকর (রা.) তার ওপর ১০০ বেত্রাঘাত কার্যকর করেন এবং তাকে ফিদাক অঞ্চলে নির্বাসিত করেন। (মুওয়াত্তা ইমাম মালেক, কিতাব আল-হুদুদ, হাদিস: ৮৪৮)
আরেক বর্ণনায় বলা হয়েছে—বাঁদি নারীর ব্যাপারে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি, কারণ তার সঙ্গে জোরপূর্বক ব্যভিচার করা হয়েছিল। পরে আবু বকর (রা.) পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই নারীকে সেই ব্যক্তির সঙ্গেই বিবাহবন্ধনে যুক্ত করে দেন।
আবু বকর (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘কেউ যদি ব্যভিচারের পর কোনো নারীকে বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তখন কী করা উচিত?’ তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে উত্তম তাওবা আর নেই; সে যেন তাকে বিয়ে করে নেয় এবং ব্যভিচারের পথ থেকে সরে আসে।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ১২৭৯৬)
২. প্রতিবিধানমূলক ফায়সালা: আলি ইবনে মাজিদা সাহমি (রা.) বলেন, আমি এক ব্যক্তির সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে তার কানের একটি অংশ কেটে ফেলি। পরে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় এলে ঘটনাটি তাঁর সামনে পেশ করা হয়। তিনি উমর (রা.)-কে লক্ষ করে বললেন, ‘উমর, এর কিসাস বা প্রতিবিধানমূলক দণ্ড সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?’ উমর (রা.) একইভাবে তার কান কাটার কথার বললে আবু বকর বললেন, তিনি নবীজিকে বিনিময়ে একটি দাস দেওয়ার কথা বলতে শুনেছেন। (ওয়াকি, আখবারুল কাজা, ২/১০২)
৩. পিতার খরচের ভার সন্তানের ওপর: কায়েস ইবনে আবু হাজিম (রা.) বলেন, আমি আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর পাশে বসে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁর পিতার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা! আমার এই পিতা আমার পুরো সম্পদ নিতে চান, যদিও তাঁর প্রয়োজন আছে।’ আবু বকর (রা.) পিতাকে লক্ষ করে বললেন, ‘তোমার যতটুকু প্রয়োজন, তুমি তোমার সন্তানের সম্পদ থেকে ততটুকুই নিতে পারো।’
এ কথা শুনে লোকটি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা, রাসুল (সা.) কি বলেননি, “তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার জন্য?”’ জবাবে আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ যা পছন্দ করেন, তুমিও তা-ই পছন্দ করো।’ অন্যান্য বর্ণনায় আছে, এখানে সম্পদ নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো ভরণ-পোষণের খরচ, যা সন্তানের ওপর পিতার ন্যায্য অধিকার। (আস-সুনানুল কুবরা, ৭/৪৮১)
উপরের ঘটনাগুলোই সিদ্দিকি যুগে সংঘটিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার উদাহরণ। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর শাসনামলের বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল দুর্বলদের সহায়তা, মজলুমের হক আদায় এবং সমতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত। ফায়সালা যার ব্যাপারেই হোক—খলিফা, গভর্নর বা সমাজের বড় কেউ—বিচারক নিরপেক্ষভাবে রায় দিতেন এবং তা সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবায়ন করা হতো। (মুস্তফা জুহাইলি, তারিখুল কাজা ফিল ইসলাম, পৃ. ১৬০)
আরও পড়ুনবনি কুরাইজা যুদ্ধের বিচার২৯ আগস্ট ২০২৩