কারাগার যেন অপরাধের কেন্দ্র না হয়
Published: 11th, December 2025 GMT
দেশের সবচেয়ে ‘হাই সিকিউরিটি’ নামধারী দুই কারাগার হলো কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার। এই দুই কারাগার এমন সব অপরাধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যা একই সঙ্গে উদ্বেগজনক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য বড় হুমকি।
এই দুই কারাগারে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের রাখা হয়। তাই তাঁদের নিরাপত্তা ও নজরদারিই সবচেয়ে কঠোর হওয়ার কথা। অথচ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদন এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, কারাগারগুলো এখন বাইরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণের একটি কেন্দ্র।
এসবির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অন্তত ৩৬০টি অবৈধ মুঠোফোন নম্বর এই দুই কারাগার থেকে নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে। কারাগারের ভেতর থেকে ফোনে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী গ্রুপ পরিচালনা, এমনকি রাজনৈতিক নির্দেশনা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। কিছু বন্দী কারাগার ভেঙে পালানোর পরিকল্পনাও করছিলেন, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে কম্বল ছিঁড়ে দড়ি বানানো এবং শৌচাগারের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার ঘটনায়।
‘হাই সিকিউরিটি’ ব্যবস্থার ভেতরেই যখন বন্দীরা এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পান, তখন কারা ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো চক্রটি চালান কিছু অসাধু কারারক্ষী, সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্দী এবং দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ নেটওয়ার্ক। অর্থের বিনিময়ে ফোন, সিম ও মাদক কারাগারে ঢোকে। বন্দীরা পায়ুপথে ছোট আকারের ফোন ঢোকাচ্ছেন; বাইরে থেকে প্যাকেট বানিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে; শৌচাগারের কমোডের ফাটলে লুকানো হচ্ছে ফোন। এসবই হচ্ছে কারাগারের ভেতরে থেকে সহযোগিতা থাকার ফলে।
কারাগারের ভেতরে সিগারেটকে ‘বিকল্প মুদ্রা’ হিসেবে ব্যবহার করার যে তথ্য বেরিয়েছে, তা কারা প্রশাসনের দুর্নীতির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কারাবন্দীরা পিসি কার্ডের টাকা দিয়ে কিংবা সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে ফোন ব্যবহারের অনুমতি কিনছেন। চিত্রটি আরও ভয়াবহ হয়, যখন দেখা যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা পর্যন্ত ফোনে বাইরে যোগাযোগ রাখছেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নির্দেশ দিচ্ছেন, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন, এমনকি হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মগবাজার বা গুলশানের মতো এলাকায় সংঘটিত অপরাধের জন্য কারাগারকেন্দ্রিক এই নেটওয়ার্কের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে।
কারা মহাপরিদর্শক স্বীকার করেছেন, মুঠোফোন ব্যবহার ‘শূন্য’ অবস্থায় নামিয়ে আনা যাচ্ছে না। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, জনবল ঘাটতি, প্রশিক্ষণের অভাব এবং অতীতে অনিয়মে নিয়োগ পাওয়া অনুপযুক্ত কর্মচারীদের কারণে সমস্যা সমাধান কঠিন হচ্ছে। তাঁর এই স্বীকারোক্তির পর প্রশ্ন ওঠে, কারাগারকে ‘অপরাধের নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ হতে দেওয়াই কি স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গেছে?
এসবি কিছু যৌক্তিক সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কার্যকর জ্যামার ও উন্নত স্ক্যানার স্থাপন, সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি এবং সরবরাহকারীদের শনাক্তকরণ। কিন্তু এসবই বহু বছরের পুরোনো কথা। প্রশ্ন হলো এখনো কেন এসব বাস্তবায়িত হয়নি? ক্ষমতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের জটিল জাল কি কারা প্রশাসনকে স্থবির করে দিয়েছে? কারাগার এমন একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা, যেখানে অপরাধের সংশোধন হবে। কিন্তু সেখান থেকে যদি অপরাধের নির্দেশনা যায় কিংবা পরিকল্পনা হয়, তাহলে তা খুবই উদ্বেগজনক।
দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন, কারা প্রশাসনের কার্যকর সংস্কার এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পেশাদার ও জবাবদিহিসম্পন্ন কাঠামো গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কারাগার যেন কোনোভাবেই অপরাধের কেন্দ্র না হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক অপর ধ র র ভ তর ব যবস ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
কারাগার যেন অপরাধের কেন্দ্র না হয়
দেশের সবচেয়ে ‘হাই সিকিউরিটি’ নামধারী দুই কারাগার হলো কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার। এই দুই কারাগার এমন সব অপরাধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যা একই সঙ্গে উদ্বেগজনক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য বড় হুমকি।
এই দুই কারাগারে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের রাখা হয়। তাই তাঁদের নিরাপত্তা ও নজরদারিই সবচেয়ে কঠোর হওয়ার কথা। অথচ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদন এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, কারাগারগুলো এখন বাইরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণের একটি কেন্দ্র।
এসবির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অন্তত ৩৬০টি অবৈধ মুঠোফোন নম্বর এই দুই কারাগার থেকে নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে। কারাগারের ভেতর থেকে ফোনে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী গ্রুপ পরিচালনা, এমনকি রাজনৈতিক নির্দেশনা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। কিছু বন্দী কারাগার ভেঙে পালানোর পরিকল্পনাও করছিলেন, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে কম্বল ছিঁড়ে দড়ি বানানো এবং শৌচাগারের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার ঘটনায়।
‘হাই সিকিউরিটি’ ব্যবস্থার ভেতরেই যখন বন্দীরা এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পান, তখন কারা ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো চক্রটি চালান কিছু অসাধু কারারক্ষী, সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্দী এবং দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ নেটওয়ার্ক। অর্থের বিনিময়ে ফোন, সিম ও মাদক কারাগারে ঢোকে। বন্দীরা পায়ুপথে ছোট আকারের ফোন ঢোকাচ্ছেন; বাইরে থেকে প্যাকেট বানিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে; শৌচাগারের কমোডের ফাটলে লুকানো হচ্ছে ফোন। এসবই হচ্ছে কারাগারের ভেতরে থেকে সহযোগিতা থাকার ফলে।
কারাগারের ভেতরে সিগারেটকে ‘বিকল্প মুদ্রা’ হিসেবে ব্যবহার করার যে তথ্য বেরিয়েছে, তা কারা প্রশাসনের দুর্নীতির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কারাবন্দীরা পিসি কার্ডের টাকা দিয়ে কিংবা সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে ফোন ব্যবহারের অনুমতি কিনছেন। চিত্রটি আরও ভয়াবহ হয়, যখন দেখা যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা পর্যন্ত ফোনে বাইরে যোগাযোগ রাখছেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নির্দেশ দিচ্ছেন, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন, এমনকি হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মগবাজার বা গুলশানের মতো এলাকায় সংঘটিত অপরাধের জন্য কারাগারকেন্দ্রিক এই নেটওয়ার্কের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে।
কারা মহাপরিদর্শক স্বীকার করেছেন, মুঠোফোন ব্যবহার ‘শূন্য’ অবস্থায় নামিয়ে আনা যাচ্ছে না। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, জনবল ঘাটতি, প্রশিক্ষণের অভাব এবং অতীতে অনিয়মে নিয়োগ পাওয়া অনুপযুক্ত কর্মচারীদের কারণে সমস্যা সমাধান কঠিন হচ্ছে। তাঁর এই স্বীকারোক্তির পর প্রশ্ন ওঠে, কারাগারকে ‘অপরাধের নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ হতে দেওয়াই কি স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গেছে?
এসবি কিছু যৌক্তিক সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কার্যকর জ্যামার ও উন্নত স্ক্যানার স্থাপন, সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি এবং সরবরাহকারীদের শনাক্তকরণ। কিন্তু এসবই বহু বছরের পুরোনো কথা। প্রশ্ন হলো এখনো কেন এসব বাস্তবায়িত হয়নি? ক্ষমতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের জটিল জাল কি কারা প্রশাসনকে স্থবির করে দিয়েছে? কারাগার এমন একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা, যেখানে অপরাধের সংশোধন হবে। কিন্তু সেখান থেকে যদি অপরাধের নির্দেশনা যায় কিংবা পরিকল্পনা হয়, তাহলে তা খুবই উদ্বেগজনক।
দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন, কারা প্রশাসনের কার্যকর সংস্কার এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পেশাদার ও জবাবদিহিসম্পন্ন কাঠামো গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কারাগার যেন কোনোভাবেই অপরাধের কেন্দ্র না হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।