সীমাহীন যন্ত্রণার ভেতরেই কাতারে আরব ফুটবল কাপে জাতীয় দলের টানা জয় ফিলিস্তিনিদের ভেতর জাগিয়ে তুলেছে এক বিরল ঐক্যের অনুভূতি। ফিলিস্তিনের জয়ের উচ্ছ্বাস গাজায় বৃষ্টিভেজা বাস্তুচ্যুত মানুষের তাঁবু থেকে শুরু করে পৌঁছে যায় লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়ার শরণার্থীশিবিরে। একই সঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বের ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ে।

ফিলিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ইহাব আবু জাজার নিবাস রাফায়। কোচের পরিবারের বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, তাঁর মা আশ্রয় নিয়েছেন মাওয়াসি এলাকার একটি তাঁবুতে। তিনিই হয়ে উঠেছেন ফিলিস্তিনের আশা ও অনুপ্রেরণার প্রতীক। সব বাস্তবতার বিপরীতে তাঁর দল মাঠে এনে দিয়েছে বিজয়ের স্বাদ, উত্তীর্ণ হয়েছে পরের রাউন্ডে। এই জয় তাঁরা প্রথমেই উৎসর্গ করেছেন গাজাকে। এরপর পৃথিবীর পুরো ফিলিস্তিনকে।

আরও পড়ুনট্রাম্পের চাপের মুখেও কেন ইসরায়েল প্রশ্নে সৌদি যুবরাজের ‘না’০৪ ডিসেম্বর ২০২৫

‘ফিদায়ি’ নামে পরিচিত এ দলের পেছনে তৈরি হয়েছে এক যৌথ মনোভাব। এ নামের অর্থ যোদ্ধা। এটি শুধু খেলা নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের গভীর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যেখানে তারা বিভক্তি ও হতাশার দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে আবারও এক অখণ্ড পরিচয় ফিরে পেতে চায়।

ক্যামেরার ফ্রেমে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলোয় দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বয়সের নারী, গৃহিণী, প্রবীণ—সবাই সীমাহীন উচ্ছ্বাসে উল্লাস করছেন। কেউ স্টেডিয়ামে, কেউ ক্যাফেতে, কেউবা নিজের ঘরে।

ফুটবল বিশ্বজোড়া এক নেশা, কিন্তু আজ ফিলিস্তিনিদের জন্য এর অর্থ সাধারণ খেলার চেয়ে অনেক বেশি। এ দলের প্রতিটি জয় প্রতিরোধের মতো, গাজায় চলমান গণবিধ্বংসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক প্রতীকী ওঠে দাঁড়ানো। প্রতিটি গোল যেন ঘোষণা দেয়, ‘আমরা এখনো আছি।’ অনেক ফিলিস্তিনের কাছেই এটা ঠিক ছাই থেকে উঠে দাঁড়ানো ফিনিক্স পাখির মতো বিষয়।

ফিলিস্তিনের জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্র এখন সম্মিলিত সচেতনতা এবং পরিচয়ের একটি স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। এটি এমন এক দিকনির্দেশনা দেয়, যা মাতৃভূমির একত্বর দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে সবাই রাজনৈতিক পরিচয় ঝেড়ে ফেলে এক জায়গায় মিলিত হতে পারে।

ইসরায়েল যখন মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনকে মুছে দিতে চায়, তখন এই খেলোয়াড়দের পায়ের জবাব যেন বলে দেয়, ফিলিস্তিনিরা বিরাজমান এবং অটল। এটি তাদের জন্য একধরনের প্রতীকী চপেটাঘাত। প্রতীকের এই শক্তি গভীর। বহুদিন পর ফিলিস্তিনের নাম ও পতাকা ভেসে উঠছে এমন এক রূপে, যেখানে কোনো দলীয় রং বা রাজনৈতিক বোঝা নেই।

আরব বিশ্বজুড়ে সমর্থক ও খেলোয়াড়েরা ফিদায়ি দলের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে যে সংহতি বহুদিন চাপা রাখা হয়েছিল, তা এখন উন্মোচিত হয়েছে খেলার ময়দানে।

এটি একভাবে আরব ঐক্যের পুনরুত্থানও বটে, যা রাজনৈতিক সীমানা পেরিয়ে আরবদের একত্র করে। কাতারের সাম্প্রতিক বিশ্বকাপেও আমরা এমন অনুভূতির প্রকাশ দেখেছি।

তিউনিসিয়ার এক খেলোয়াড় ফিলিস্তিনের বিপক্ষে গোল করার পর দৌড়ে গিয়ে ফিলিস্তিনি কোচকে জড়িয়ে ধরেন, যেন ক্ষমা চান। আরব দর্শকেরা নিজেদের পতাকার পাশাপাশি ফিলিস্তিনি পতাকাও উড়িয়ে সমর্থন জানান।

আরও পড়ুনফিলিস্তিন নামের ক্ষতকে পৃথিবী আর আড়াল করতে পারবে না ৩১ অক্টোবর ২০২৪

এক ফিলিস্তিনি খেলোয়াড় মাঠ ঘুরে বেড়ান হাতে জড়ানো সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো দৃশ্যটিকে একসূত্রে বেঁধে রাখে কেফিয়াহ।

অনেকের কাছে স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে সেই একমাত্র জায়গা, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে এমন কিছু প্রকাশ করতে পারে, যা কিছু আরব দেশে কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। স্টেডিয়ামে পতাকা আর ফিলিস্তিনের ধ্বনি অবাধে প্রবাহিত হয়। আর সেখানেই অগণিত প্রতিকূলতার পরও ফিলিস্তিনি দল উপহার দেয় দুর্দান্ত মানের ফুটবল।

অথচ ফিলিস্তিনের দল গঠন করা ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। অনুশীলনের সুযোগ ছিল খুবই কম, আর সম্পদ প্রায় ছিল না বললেই চলে। দেশের ঘরোয়া লিগ বহু বছর ধরে বন্ধ। ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে স্টেডিয়াম ও ক্রীড়া–সুবিধা। এই বাস্তবতা তাদের সাফল্যকে আরও বিস্ময়কর করে তুলেছে। মনে হয় শুধু ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ় মনোভাব এবং ফিদার আত্মা প্রতিটি প্রযুক্তিগত ঘাটতিকে পুষিয়ে দিচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর সহায়তায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে দুই বছরের নির্মম গণহত্যার ভয়াবহতার পরও কীভাবে এই দল আবার একত্র হয়ে এমন পারফরম্যান্স দেখাল! এই প্রশ্নটাই নিজেই অনেক কিছু বলে দেয়।

আরও পড়ুনগাজা যুদ্ধ থামিয়েও ট্রাম্প নোবেল পেলেন না কেন১২ অক্টোবর ২০২৫

ফিলিস্তিনি সমাজতাত্ত্বিক জামিল হিলাল দীর্ঘদিন ধরে লিখে আসছেন যে সংস্কৃতি একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি পরিচয় রক্ষায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই পরিচয় রাজনীতি, দল এবং গোষ্ঠীর সীমা ছাড়িয়ে যায়। সাহিত্য, কবিতা, শিল্প, সংগীত, নৃত্য, লোকগীতি, রান্না, সূচিশিল্প, প্রতীক, ঐতিহ্য, পুরোনো এবং আধুনিক সব মিলেই গড়ে ওঠে একটি সম্মিলিত চেতনার ভিত্তি। এই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে রক্ষা করাই ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা।

আমরা জানি কীভাবে বারবার ফিলিস্তিনির সংস্কৃতি, প্রতীক, সূচিশিল্প এমনকি কুনাফা এবং খাবার পর্যন্ত ইসরায়েলের বলে দাবি করা হয়েছে। একটি জাতির সাংস্কৃতিক ভিত্তি ভেঙে গেলে তারা দিগ্‌বিদিক ছড়িয়ে যায়, তাদের জাতীয় পরিচয় এবং সামাজিক সংহতি বিপদের মুখে পড়ে।

ফিলিস্তিনের জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্র এখন সম্মিলিত সচেতনতা এবং পরিচয়ের একটি স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। এটি এমন এক দিকনির্দেশনা দেয়, যা মাতৃভূমির একত্বর দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে সবাই রাজনৈতিক পরিচয় ঝেড়ে ফেলে এক জায়গায় মিলিত হতে পারে। দলটির খেলাগুলোয় সারা বিশ্বের কোটি ফিলিস্তিনি শুধু কয়েকজন খেলোয়াড়কে দেখছিল না। তারা দেখছিল ফিদাইয়িনদের, যোদ্ধাদের। তারা দেখছিল ইতিহাসের বাহকদের, যারা শুধু একটি খেলা জেতার ইচ্ছার চেয়ে অনেক বড় বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে।

খালেদ হরুব শিক্ষক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ

মিডিল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ইসর য় ল ফ টবল র একত

এছাড়াও পড়ুন:

কেনিয়া: মাউ মাউ বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার গর্জন

আফ্রিকার দিগন্তজোড়া সাভানা আর বন্য প্রকৃতির দেশ কেনিয়া। কিন্তু এই শান্ত প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে আছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের এক উত্তপ্ত ইতিহাস। আজ ১২ ডিসেম্বর কেনিয়ার ‘জামহুরি দিবস’ (Jamhuri Day)। সোয়াহিলি ভাষায় ‘জামহুরি’ শব্দের অর্থ ‘প্রজাতন্ত্র’। এই দিনটি কেনিয়াবাসীর কাছে দ্বিগুণ আনন্দের—কারণ, ১৯৬৩ সালের এই দিনে তারা ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ঠিক এক বছর পর ১৯৬৪ সালের একই দিনে দেশটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

কেনিয়ার এই বিজয়ের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। ১৯৫০-এর দশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘মাউ মাউ বিদ্রোহ’ (Mau Mau Uprising) ছিল এই স্বাধীনতার মূল চালিকাশক্তি। জঙ্গল ও পাহাড়ের আড়াল থেকে সাধারণ কৃষকেরা ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে দা, কুড়াল আর পুরোনো বন্দুক নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশরা হাজার হাজার স্বাধীনতাকামীকে বন্দী করে, হত্যা করে ও নির্যাতন চালায়। কিন্তু মাউ মাউ যোদ্ধাদের সেই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাদের সেই রক্তস্রোতই শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের কেনিয়া ছাড়তে বাধ্য করে।

কেনিয়াবাসী ঘটা করে উদ্‌যাপন করে ‘জামহুরি দিবস’

সম্পর্কিত নিবন্ধ