দেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো ধীরে ধীরে মোকাবিলা করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হিটম্যাপ নামে একটা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে ২০টি প্রতিষ্ঠানের মতামত নেওয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে ১৯টি অগ্রাধিকার খাত নির্বাচন করা হয়েছে। হিটম্যাপ অনুযায়ী এসব খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মঙ্গলবার ‘বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক একটি সেমিনার আয়োজন করে, সেখানে এসব বিষয় তুলে ধরে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিডা।
সেমিনারে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশকে প্রভাবিতকারী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে বিডার পক্ষ থেকে আগামী ৭-১০ এপ্রিল বিনিয়োগ সম্মেলন করার ঘোষণা দেওয়া হয়। সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ইকোনমিক জোনগুলো পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তারা।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন প্রধান অতিথি হিসেবে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারটি রাজধানীর ইআরএফ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত হয়েছিল।
বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক ওই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা। এতে বক্তব্য দেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, এফবিসিসিআই প্রশাসক হাফিজুর রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান, লাফার্স হোলসিম বাংলাদেশের সিইও মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী।
ভ্যাট পরিস্থিতির বিষয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিডার চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘ভ্যাটের বিষয়টি নিয়ে তারা এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করবেন।’’
গ্যাস পরিস্থিতির বিষয়ে বলেন, ‘‘শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ থাকা উচিৎ।’’ মালয়েশিয়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দেশটিতে উৎপাদিত গ্যাসের ৭০ শতাংশই শিল্পে ব্যবহার হয়। গ্যাসের বরাদ্দ শিল্প মন্ত্রণালয়ই করে থাকে।’’
শিল্পে গ্যাস সরবরাহ সংকট নিয়ে উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা আপাতত রাষ্ট্রায়ত্ত বন্ধ শিল্প কারখানাগুলো বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছে ছেড়ে দেওয়া যায় কি না, তা চিন্তা করছি। কারণ, এখানে ইতোমধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ সুবিধা রয়েছে। ফলে কারখানাগুলো দ্রুত উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব।’’
এ কে আজাদ বলেন, ‘‘গ্যাস সরবরাহে সিস্টেম লসের নামে ১০ শতাংশ চুরি বন্ধ করা গেলে নতুন করে গ্যাসের দর বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারই পারে এ চুরি বন্ধ করতে। কারণ, তাদের ভোটের প্রয়োজন নেই।’’
নতুন করে গ্যাসের দর বৃদ্ধি ও ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর সমালোচনা করে এ কে আজাদ বলেন, ‘‘সরকার যে নীতি নিচ্ছে, এগুলো বাস্তবায়িত হলে আমরা কোথায় যাব? গ্যাস ও ভ্যাট বৃদ্ধির আগে অর্থনীতি এবং জনজীবনে এর কী প্রভাব পড়বে, তা খতিয়ে দেখা হয়নি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি।’’
তিনি বলেন, ‘‘পণ্য আমদানি, রপ্তানি এবং মূলধনী যন্ত্রের আমদানি কমেছে। এই চিত্র বলছে, বিনিয়োগ কমেছে। অর্থনীতির এই পরিস্থিতিতে গ্যাস এবং ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তা চিন্তা করা উচিৎ।’’
তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসায়ী মানেই যেন অপরাধী। সবাই চুষে খেতে চায়। অনিয়মে অন্তত ৪০ শতাংশের মতো ব্যয় করতে হচ্ছে।’’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘‘আসলে সব সরকারের চরিত্রই এক। গত সরকার বলেছিল, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করবে। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি।’’
গ্যাস ও ভ্যাট প্রসঙ্গে আবুল কাশেম খান বলেন, ‘‘নীতির ধারাবাহিকতার অভাব বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এসআরও জারি করে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর সুবিধার জন্য ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন করা হয়।’’
তিনি বলেন, ‘‘নীতি গ্রহণে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা হয় না।’’
তিনি বলেন, ‘‘দুর্নীতির কারণে সব খাত নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ভেঙে দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার করতে হবে। দেশের জন্য কাজ করতে হবে। যাতে টেকসই বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি হয়।’’
লাফার্স হোলসিম বাংলাদেশের সিইও মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘‘নতুন বিনিয়োগ আনতে দেশের বাইরে গিয়ে রোড শো করা হয়েছে। অথচ দেশের বিদ্যমান বিনিয়োগের পরিস্থিতি বুঝার প্রয়োজন ছিল। তাদের চ্যালেঞ্জগুলো শনাক্ত করার দরকার ছিল। বিনিয়োগকারীদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেই। অথচ, এই বিনিয়োগকারীরাই বৈদেশিক বিনিয়োগে দেশের পক্ষে কাজ করবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘নীতি ঠিক নেই, আইন-শৃঙ্খলা ঠিক নেই, নতুন একটা উদ্যোগ নিতে গেলে ২৩ থেকে ২৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিতে হয়। ট্রেড লাইসেন্সের মত কাজগুলো করা সময় সাপেক্ষ। এসব অসুবিধা দূর করতে হবে।’’
এফবিসিআই-এর প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘স্টক মার্কেটে বিনিয়োগকরলে দস্যুরা নিয়ে যায়। দোকান দিলে চাঁদাবাজরা মিইয়ে যাবে। এই অনিশ্চয়তা নিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়।’’
তিনি বলেন, ‘‘দেশে বিনিয়োগের পথ সুগম করতে ট্যাক্স হ্যাভেন না হলেও একটু সুবিধা দিতে হবে। যাতে ব্যবসা করতে গিয়ে কিছু পুঁজি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে না হয়।’’
সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন, বিডার হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট নাহিয়ান রহমান রচি।
ঢাকা/হাসনাত/এনএইচ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর স থ ত সরবর হ ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
রপ্তানিতে চার শিল্পপ্রতিষ্ঠান পেল এইচএসবিসি সম্মাননা
রপ্তানি বাণিজ্য ও টেকসই উন্নয়নে অবদানের জন্য ‘এইচএসবিসি এক্সপোর্ট এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে দেশের চার শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বহুজাতিক দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন বা এইচএসবিসি নবমবারের মতো সেরা রপ্তানিকারকের এই সম্মাননা দিয়েছে। আজ রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সম্মাননাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
এ বছর মোট চারটি শ্রেণিতে এই চার প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেওয়া হয়। সম্মাননা পাওয়া সব প্রতিষ্ঠানকে রপ্তানি খাতে অবদানের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। পোশাক খাতের জন্য এক্সপোর্ট এক্সিলেন্স পদক পেয়েছে ডিবিএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ফ্লামিংগো ফ্যাশনস। বছরে রপ্তানি আয় ১০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি, এমন শ্রেণিতে এই পদক দেওয়া হয়েছে। রপ্তানি আয় বছরে ৫ কোটি ডলারের বেশি, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের এমন সংযোগ শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে পদক পেয়েছে এনজেড টেক্স গ্রুপ।
এ ছাড়া রপ্তানি আয় বছরে এক কোটি ডলারের বেশি, উৎপাদনশীল শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদীয়মান ও অসনাতন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পদক পেয়েছে আকিজবশির গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জনতা জুট মিলস ও সাদাত জুট ইন্ডাস্ট্রিজ। সেবা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রপ্তানি খাতে উদীয়মান প্রতিষ্ঠান হিসেবে পদক পেয়েছে উল্কাসেমি প্রাইভেট লিমিটেড। এ শ্রেণিতে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ছিল ৫০ লাখ ডলার।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ফ্লামিংগো ফ্যাশন রপ্তানিনির্ভর প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের ৫০টি দেশের প্রধান ব্র্যান্ডগুলোর কাছে পোশাক সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে ১১৮ উৎপাদন লাইন। ফ্লামিংগো ফ্যাশনের ৬০ শতাংশ কাঁচামাল স্বনির্ভর। ফ্লামিংগো বছরে ৪ কোটি ৪০ লাখ পিস পোশাক সরবরাহ করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পানির পুনর্ব্যবহারসহ নানা টেকসই উদ্যোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
এনজেড টেক্স গ্রুপ বৈশ্বিক পোশাক ব্র্যান্ডগুলোর জন্য উচ্চমানের সুতা এবং কাপড় সরবরাহ করে থাকে। গ্রুপটি বছরে ৫২ হাজার টন সুতা উৎপাদন করে।
আকিজবশির গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জনতা জুট মিলস ও সাদাত জুট ইন্ডাস্ট্রিজ প্রচলিত পাটপণ্য থেকে সরে এসে উচ্চমূল্যের বৈচিত্র্যময় পণ্যের দিকে প্রসারিত হয়েছে। প্রায় ৯০টি দেশে পাটপণ্য রপ্তানি করছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
উল্কাসেমি প্রাইভেট লিমিটেড প্রযুক্তিভিত্তিক পরিষেবানির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান। ঢাকায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের সেমিকন্ডাক্টরের নকশা সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, তাইওয়ান ও ভারতের শীর্ষস্থানীয় গ্রাহকদের কাছে উন্নত নকশা পরিষেবা দেয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ও বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের উদ্যোক্তারা সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন। আমরা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছি। তাঁদের পাশে আছি আমরা।’
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এ দেশের উদ্যোক্তাদের রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে কাজ করতে হবে। আমাদের অনেক সুযোগ আছে।’
এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. মাহবুব উর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি বাজার বড় করার সঠিক লক্ষ্য ও উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার–সুবিধা, সঠিক রপ্তানি গন্তব্য ঠিক করা ও বাণিজ্য কূটনীতির দিকে জোর দিতে হবে।’
যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক বলেন, যুক্তরাজ্য দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম বিশ্বস্ত অংশীদার—অর্থনীতি, ফ্যাশন, জ্বালানি, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে এই অংশীদারি রয়েছে। ব্যবসা সহজীকরণে যুক্তরাজ্য বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত উদ্যাক্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় এখন কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। জবাবে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। প্রতিদিন কিছু ব্যক্তি মামলা করছেন, সেখানে ব্যবসায়ীদের আসামি করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার বলেন, নির্বাচন হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নির্বাচনই এখন আমাদের একমাত্র চাওয়া।