পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের বর্বর এবং নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মকে এই ইতিহাস সম্পর্কে আরও বেশি করে জানাতে হবে। বর্তমান সময়ে বুদ্ধিজীবীদের দমিয়ে রাখাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এখন সব বৈষম্য দূর করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে; যার প্রতিফলন চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে দেখা গেছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে দুই দিনব্যাপী সেমিনারের প্রথম দিনে আজ রোববার এসব কথা বলেন বক্তারা। আজ একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ‘বুদ্ধিজীবীর জবান ও জীবন: ইতিহাসের আলোকে, আখেরি ফ্যাসিবাদের জমানায়’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন লেখক ও গবেষক তাহমিদাল জামি।

প্রবন্ধে বলা হয়, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে যে প্রক্রিয়াটি সক্রিয় ছিল সেটিকে একপ্রকার ফ্যাসিবাদ বলে আমরা শনাক্ত করতে পারি। আর সেই ফ্যাসিবাদের পেছনে ছিল প্রজা বা বান্দাকে সুনির্দিষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের ছাঁচে ঢালাই করে তার বান্দা গঠনের নির্ধারণের প্রকল্প। মুক্তিযুদ্ধকালে যে ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে আর বুদ্ধিজীবীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার দুইটিই মূলত সামাজিক পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সহিংস হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা বলেই শনাক্ত করা যায়।’

আরও বলা হয়, ‘আমাদের যুগে ফ্যাসিবাদ কাকে বলে তা নিয়ে নানা বিতর্ক দেখতে পাচ্ছি। বিগত শাহিকে ফ্যাসিবাদ বলে অনেকেই অভিহিত করলেও ফ্যাসিবাদ কোন অর্থে, তা নিয়ে কোনো পরিণত বিতর্ক বা আলোচনা খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়নি। আবার ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদ নামক পরিভাষাটি নিয়েও সম্প্রতি নানা বিতর্ক হচ্ছে। এসব আলোচনাতেও গভীর কোনো তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত পাওয়া মুশকিল।’ পাক শাহি এবং তাদের সহযোগী আলবদর গোষ্ঠীগুলো যে ফ্যাসিস্ট, এ ব্যাপারটি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বুদ্ধিজীবী আলমগীর কবির তাঁর বেতার কথিকায় উল্লেখ করেছিলেন বলে প্রবন্ধে বলা হয়।

প্রবন্ধের শেষের দিকে বলা হয়, ফলে আজও বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে অবদমিত, নিপীড়িত, নিশানায়িত। আমরা একাধিক কবি ও লেখককে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিধনযোগ্য হয়ে উঠতে দেখেছি। বুদ্ধিজীবীর তৎপরতাকে প্রত্যাহার করে নেওয়াই একালে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার। আপাতদৃষ্টিতে মৃত বুদ্ধিজীবীরা নিরাপদ। তবে মৃতরাও সবাই নিরাপদ তা বলার উপায় নেই। কিছুদিন আগে এক পীরের গোর খুঁড়ে লাশ দাহ করা হয়েছে। লিবারাল নিয়ম ও ফ্যাসিবাদের যম একই সঙ্গে হাজির থাকলে, জবানের স্বাধীনতা খণ্ডিত ও জীবনের নিরাপত্তা বিপর্যস্ত থাকে।’

সেমিনারে সভাপ্রধান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ১৪ ডিসেম্বর এবং তারপরও অনেক বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত জহির রায়হান। যাঁরা মারা গেছেন, শহীদ হয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকি। কিন্তু অন্য সবগুলো ব্যাপারের মতো এই ব্যাপারও যখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, তখনই নানা ধরনের প্রশ্ন, দ্বিধা ইত্যাদি দেখা যায়। যেমন কে মেরেছে, কারা মেরেছে এসব প্রশ্ন কেউ কেউ উত্থাপন করে। আমি মনে করি যে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করা খুবই জরুরি। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের যেন সব সময় মনে থাকে যে তাঁরা জীবন দিয়েছেন। এবং তাঁদের জীবন গিয়েছে। তাঁদের জীবন নেওয়া হয়েছে।

স্বাগত বক্তব্যে বাংলা একাডেমির সচিব মো.

সেলিম রেজা বলেন, বাংলা একাডেমির সঙ্গে অনেক বুদ্ধিজীবীর গভীর এবং নিবিড় সম্পর্ক এবং এখানে তাঁদের পদচারণ ছিল। বাংলা একাডেমি তাঁদের জীবন নিয়ে বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ এবং সারক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। ১৪ খণ্ডে স্মৃতি একাত্তর সিরিজ প্রকাশ করেছে। তাদের জীবনী নিয়ে রচনাবলি প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকের ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে এখানে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

‎জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ‘আমরা কখনো এটা ভাবি নাই যে বুক পেতে দেওয়া যায় বন্দুকের সামনে। বন্ধুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছে। তবে এটা একজন না। একজন বুক পেতে দেওয়ার পরে তো বুকের কোনো অভাব নাই। ১৫ বছর ২০ বছর ধরে চেষ্টা করে যেগুলো কিছুই নড়ানো যায়নি, সেগুলো ৩৫ দিন–৩৬ দিনে সবকিছু ওলটপালট করে দেওয়া গেছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাভিন মুরশিদ বলেন, ‘এই যে আজকের বুদ্ধিজীবী দিবস। আমি আজকে ভাবছিলাম যে এত বড় ক্ষতি করে গেছে যেটা সেটা থেকে কিন্তু আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি এবং সেটাও আমাদের ভাবতে হয়। এই যে ১৪ ডিসেম্বর, সেই সময় কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা জানে যে যুদ্ধটা শেষ, ওদের আর জিতে আসার সুযোগ নাই। কিন্তু যাওয়ার আগে তারা দেশটাকে পঙ্গু করে দিতে চাইল। কথাটা কিন্তু সেটাই এবং সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয় তারা কিন্তু সফল। তারা আমাদের কিন্তু পঙ্গু করেই গেছে।’

‎সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন শিল্পী ও লেখক অরূপ রাহী। তিনি বলেন, সমাজের একটা অংশ মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা—এই পুরো ব্যাপারটাকেই একধরনের অস্বীকার করার একটা চিন্তা এবং তৎপরতার মধ্যে বাস করে।

আয়োজনের দ্বিতীয় দিন ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার গতিপথ এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিসর শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন লেখক ও গবেষক সহুল আহমদ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র জ বন এক ড ম র প রবন ধ আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

পরিস্থিতির উন্নতির জন্য নির্বাচন হতেই হবে

বাংলাদেশে নির্বাচনপূর্ব সময়ে সব সময় কিছু বিশৃঙ্খলা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়। তবে এবারের পরিস্থিতি অন্যবারের চেয়ে বেশি নাজুক। এর কারণ বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে পর্যায়ে নেমেছে, সেখান থেকে বর্তমান সরকার দেড় বছর সময় পেলেও খুব দৃশ্যমান কোনো উন্নতি ঘটাতে পারেনি।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এবং এর আগে থেকে পরিস্থিতির ওপর যে ধরনের পর্যালোচনা বা অনুধাবনের প্রয়োজন ছিল, সেখানে ঘাটতি ছিল। কাজেই প্রস্তুতিও সেভাবে নেওয়া হয়নি। বিপুলসংখ্যক অস্ত্র এর আগে খোয়া গিয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো উদ্ধার করার জন্য জোর তৎপরতা চালানোর মতো দৃশ্যমান কিছু দেখা যায়নি। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত ছিল, সেখানে বড় ধরনের ঘাটতি আমরা দেখতে পেয়েছি।

আমরা এটাও জানি যে আওয়ামী লীগ (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ), বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেত্রী এবং অন্য যে নেতারা ভারতে পালিয়ে গেছেন, তাঁরা সেখান থেকে বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে উসকানি দিয়েছেন। এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর আগাম প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন ছিল। সে ধরনের কোনো প্রস্তুতি যদি তারা নিয়ে থাকে, তাহলে অবস্থার অবনতি হতো না বা হওয়ার কথা নয়।

যেসব বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেই বাহিনীগুলোর কর্মদক্ষতায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষ করে পুলিশ সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত হয়নি। এই বাহিনীকে সরকার সম্পূর্ণভাবে আগের জায়গাতে ফিরিয়ে নিতে পারেনি বা তৈরি করতে পারেনি।

বিশেষ করে অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে আমরা কোনো কিছু দেখতে পাইনি। একই সঙ্গে যে ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতা বা আগাম তথ্য থাকা উচিত, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তারা আগাম তথ্য পাচ্ছে না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তাদের তৎপরতা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগাম তথ্য ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ রাখাটা দুরূহ হয়ে পড়ে।

তবে আমরা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। নির্বাচন যেকোনো মূল্যে হতে হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনোভাবেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না। নির্বাচনই একমাত্র পন্থা, যার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের স্বপ্ন, যার জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, সেই লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারব। কাজেই নির্বাচন হতে হবে।

নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে, যাতে পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যতটুকু অবনতি হয়েছে, সেটিকে প্রারম্ভিক পর্যায় বলা যায়। তবে এটা একটা অশনিসংকেত। উচিত হবে এখনই এটাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। পুরো পরিস্থিতির ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার লক্ষণকে একেবারে নির্মূল করে দেওয়া।

আমরা আশা করব, আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে যেসব দায়িত্বশীল ব্যক্তি আছেন, বিশেষ করে যাঁরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন, যাঁরা পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের সঠিক ভূমিকাটা রাখবেন। কোনোভাবেই যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে এবং দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন, এটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে ঝুঁকিপূর্ণ প্রার্থীদের চিহ্নিত করা এবং তাঁদের জন্য এখন থেকেই বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।

মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পরিস্থিতির উন্নতির জন্য নির্বাচন হতেই হবে