শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলসহ কয়েকটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা। আজ রোববার তাঁরা সহ–উপাচার্যের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া এবং পদত্যাগের দাবি জানান।

রাত সাড়ে নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি কাটা পাহাড় সড়ক হয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রদক্ষিণ করে প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে বিভিন্ন স্লোগান দেন। সমাবেশটি সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো.

ইয়াসিন।

সমাবেশে চাকসু ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আয়ুবুর রহমান বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। যে আসনে আজ সহ–উপাচার্য বসে আছেন, সেটিও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, ১৯৭১ ও সাম্প্রতিক গণ–আন্দোলনের চেতনা ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে।’

আয়ুবুর রহমান বলেন, ‘যেখানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারাই বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা স্বীকার করেছেন, সেখানে এই হত্যাকাণ্ডকে অবান্তর বলা ইতিহাস অস্বীকারের শামিল।’ তিনি আরও বলেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করেছে এবং নতুন কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিতে দেওয়া হবে না। এ জন্য সহ–উপাচার্যকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে পদত্যাগ করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন বলেন, ‘১৯৭১ সালের বিজয়ের প্রাক্কালে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। আজ আমরা তাঁদের স্মরণ করি। অথচ সেই ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই বক্তব্যের জন্য সহ–উপাচার্যের পদত্যাগ জরুরি।’

গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সংগঠক ধ্রুব বড়ুয়া বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। রাও ফরমানের ডায়েরিতেই পরিকল্পনার কথা উল্লেখ আছে। এ বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ১৯৭১ ও সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থানের অর্জনকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ক্ষমা চেয়ে নিঃশর্তভাবে পদত্যাগ করতে হবে।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি জশদ জাকির বলেন, ‘১৯৭১ সালে শিক্ষক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের হত্যা করে দেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মূল হোতা ছিল দেশের আল-বদর ও আল-শামসরা। আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উত্তরসূরি; প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেও আমরা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করে যাব।’

বিক্ষোভ মিছিলে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জালাল সিদ্দিকী ও মাহবুবুল হাসান, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মোশরেফুল হক রাকিব এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সংগঠক রিশাদ আমীনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা–কর্মী।

আরও পড়ুনপাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে, এটা অবান্তর: চবি সহ–উপাচার্য৫ ঘণ্টা আগে

এর আগে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সহ–উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেন, ‘যে সময় আমি (পাকিস্তানি বাহিনী) দেশ থেকে পালানোর জন্য চেষ্টা করছি, আমি জীবিত থাকব না মৃত থাকব, সে বিষয়ে কোনো ফয়সালা হয়নি, সে সময় পাকিস্তানি যোদ্ধারা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে, এটি আমি মনে করি রীতিমতো অবান্তর।’

তবে সভায় উপস্থিত বিএনপিপন্থী শিক্ষকনেতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আল আমিন এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বলে জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে জাতিকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব দ ধ জ ব দ র হত য ছ ত রদল র পদত য গ ন বল ন

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাবিতে প্রামাণ্য আলোকচিত্র ও দলিলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ ছাত্র ইউনিয়নের

প্রামাণ্য আলোকচিত্র ও দলিলের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শুরু হয়েছে বিশেষ প্রদর্শনী। ‘রক্তের দলিল’ শিরোনামে চার দিনব্যাপী এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সবুজ চত্বরে আয়োজিত এ প্রদর্শনী চলবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

আয়োজকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে যে বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর বয়ান ছড়ানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই এ উদ্যোগ। টিএসসির এই আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন পত্রিকা ও নথিপত্র উপস্থাপনার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস, গণহত্যার সাক্ষ্য এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

প্রদর্শনীর একটি অংশে ‘গণহত্যার সম্মতি উৎপাদন’ শিরোনামে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত গোলাম আযমের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে একাত্তরে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকা প্রামাণ্য দলিলের সাহায্যে উপস্থাপন করা হয়েছে।

গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া প্রদনর্শনীতে স্থান পেয়েছে ১৯৭১ সালের ৭ জুন মুসলিম বিশ্বের প্রতি মাওলানা মওদুদীর পাঠানো একটি স্মারকলিপি। সেখানে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানের পর বিদেশে প্রচার চালানো হচ্ছে যে সেনাবাহিনী নিরাপরাধ বাঙালি মুসলমানদের হত্যা করছে। এমন অভিযোগকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের প্রচারণা’ বলে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের ২০ জুন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রধান গোলাম আযমের আরেকটি বক্তব্যও প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রদর্শনীর অন্যান্য অংশের মধ্যে রয়েছে ‘অপূর্ণ গণযুদ্ধ’, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে জনগণের চলমান সংগ্রামের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘যাঁরা ছিলেন, যাঁরা আছেন’ অংশে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ হওয়া বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের জীবন ও অবদান তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ‘গণহত্যার সাক্ষ্য’ অংশে পাকিস্তানি বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার দলিল এবং মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন ও তাঁদের প্রতিরোধের ইতিহাস প্রামাণ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

আয়োজনের বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে একদলীয়করণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের গণযুদ্ধের অঙ্গীকারটি সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া হয়েছিল। সেটিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধকে এক কাতারে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল।

বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মেঘমল্লার বসু বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি রাজাকার, আলবদর, জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রসংঘের উত্তরসূরি ছাত্রশিবির মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামকে সংখ্যা ও মাহাত্ম্যের দিক থেকে খাটো করার জন্য অনলাইন ও অফলাইনে বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা কখনো বলছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা হাজার, আবার কখনো বলছে বিহারিরাই মূলত গণহত্যার শিকার হয়েছিল।

মেঘমল্লার বসু আরও বলেন, ‘মূলত সেই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ গড়ার জায়গা থেকেই আমরা এ আয়োজনটি করেছি। আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণার মাধ্যমে গণযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ সামনে এনেছি। একই সঙ্গে গণহত্যার বিষয়টি এবং রাজাকারদের গণহত্যার পক্ষে সম্মতি আদায়ও সামনে এনেছি।’

শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অভ্যুত্থানের পর থেকে একটি সংঘবদ্ধ চক্র পূর্ব বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইন্টেরিম (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) একদিকে স্বীকৃত রাজাকারদের বেকসুর খালাস দিচ্ছে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরগুলোকে অবহেলায় ফেলে রেখেছে। সেই জায়গা থেকে আমরা এ সময়টাকে যেমন সংকট হিসেবে দেখি আবার দেখি অপার সম্ভাবনার সুযোগ হিসেবে।

মাঈন আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা এ সময়টাকে সংকট ও সম্ভাবনা—দুভাবেই দেখি। স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কুক্ষিগত করা ন্যারেটিভ (বয়ান) থেকে মুক্তিযুদ্ধকে বের করে আনা এবং জামায়াত-শিবিরগোষ্ঠীর মিথ্যাচারের সমুচিত জবাব দিয়ে জনযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সামনে আনতেই বিজয়ের মাসে আমাদের এই আয়োজন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঢাবিতে প্রামাণ্য আলোকচিত্র ও দলিলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ ছাত্র ইউনিয়নের
  • পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে, এটা অবান্তর: চবি সহ–উপাচার্য
  • কণ্ঠহীনের কণ্ঠস্বর হওয়াই বুদ্ধিজীবীর কাজ
  • মৃত্যুতেও হয়রানির শেষ হয়নি
  • অরক্ষিত বেলতলী বধ্যভূমি, চলে মাদকের আড্ডা
  • চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে বুদ্ধিজীবী হত্যা
  • বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যাশার বাংলাদেশ গড়ার ডাক তারেক রহমানের
  • আকাশপথে কিলো ফ্লাইটের আক্রমণ
  • পাকিস্তানে বাঙালি বন্দিশিবিরের গোপন ইতিহাস