বৈশ্বিক মানদণ্ডে জ্বালানি তেলে সালফারের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ১০ পিপিএম হলেও বাংলাদেশে সরকারিভাবে নির্ধারিত গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৩৫০ পিপিএম। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বিএসটিআই ও বিসিএসআইআরের নমুনা পরীক্ষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলে সালফার পাওয়া গেছে অনুমোদিত মাত্রার চেয়েও সাড়ে ৩ থেকে ৮ গুণ বেশি। জ্বালানি তেলে সালফারের এই মাত্রা যেকোনো বিচারেই ভয়াবহ। ফুসফুসের বিষ হিসেবে পরিচিত সালফার জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সালফার শুধু নিজে দূষণ করে না, বস্তুকণা তৈরি করে আরও কিছু উপাদানের দূষণেও সহায়তা করে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা সতর্ক করছেন, সালফার শ্বাসনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ সৃষ্টি করে ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সালফারের কারণে অ্যাজমা, সিওপিডি, ব্রঙ্কাইটিস, শিশুদের ফুসফুসের রোগ থেকে শুরু করে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকিও বাড়ায়। এ কারণে সারা বিশ্ব পরিশোধন করে জ্বালানি তেলে সালফারের মাত্রা কমিয়ে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি তেলে সালফারের মাত্রা ১০ পিপিএম নির্ধারণ করেছে।

আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে এ দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অন্য দেশের মানুষের তুলনায় বেশি। এই অবৈজ্ঞানিক ও ভিত্তিহীন ধারণার ওপর নির্ভর করে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই উদ্ভট সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, যা বৈশ্বিক নিয়ম ও মান থেকে ভিন্ন। করোনা মহামারির সময়েও দেশের মানুষকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। জ্বালানি তেলে সালফারের অনুমোদিত মাত্রা যে বৈশ্বিক মানদণ্ডের বিচারে ৩৫ গুণ বেশি, তারও একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে এখান থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের সক্ষমতা কি অন্য দেশের মানুষের চেয়ে ভিন্ন?

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কম দামে জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগ তৈরি করতে সালফারের মাত্রা ৩৫০ পিপিএম নির্ধারণ করেছিল। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ঘাটতির অজুহাতে নাগরিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ১৬ মাসেও কেন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলো?

বায়ুদূষণে বিশ্বের তৃতীয় শহর ঢাকা আর দেশগত বিচারে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। বায়ুদূষণে তৃতীয় বড় অবদান যানবাহনের কালো ধোঁয়ার। এর উৎস নিম্নমানের ডিজেল, পেট্রল ও অকটেনের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে অনুমোদিত মানের থেকেও কয়েক গুণ বেশি সালফারমিশ্রিত জ্বালানি তেল বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এর মূল দায় অবশ্যই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং পরিবেশকদের ওপর বর্তায়। কেননা জ্বালানি তেল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্ব রয়েছে বিপিসির ওপর। সরকারি তিন সংস্থা পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মাধ্যমে বিপিসি তেল বিক্রি করে। জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন, এসব সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকে তেল চুরি ও ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব একটা দেখা যায় না।

জ্বালানির মতো কৌশলগত পণ্যে বছরের পর বছর ধরে বিপুল অঙ্কের মুনাফা করছে বিপিসি। কিন্তু চুরি ও অদক্ষতা বন্ধে উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। আবার বাংলাদেশের একমাত্র তেল পরিশোধনাগারটি ৫৭ বছরের পুরোনো এবং সালফার পরিশোধনের ব্যবস্থা সেখানে নেই। নতুন পরিশোধনাগার তৈরির প্রকল্পটিও ঝুলে আছে। সব মিলিয়ে জ্বালানি খাতের ভুল নীতি, পুরোনো অবকাঠামো আর বিপিসির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চুরির বলি হতে হচ্ছে জনসাধারণকে।

উচ্চ সালফারযুক্ত ভেজাল তেল বিক্রি বন্ধে সরকারকে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তেল চুরি ও ভেজাল মেশানোর সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। জ্বালানি তেলে সালফারের মাত্রা বৈশ্বিক মানে নামিয়ে আনতেই হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প প এম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নীতি পাল্টান, ভেজাল তেল বিক্রি বন্ধ করুন

বৈশ্বিক মানদণ্ডে জ্বালানি তেলে সালফারের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ১০ পিপিএম হলেও বাংলাদেশে সরকারিভাবে নির্ধারিত গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৩৫০ পিপিএম। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বিএসটিআই ও বিসিএসআইআরের নমুনা পরীক্ষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলে সালফার পাওয়া গেছে অনুমোদিত মাত্রার চেয়েও সাড়ে ৩ থেকে ৮ গুণ বেশি। জ্বালানি তেলে সালফারের এই মাত্রা যেকোনো বিচারেই ভয়াবহ। ফুসফুসের বিষ হিসেবে পরিচিত সালফার জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সালফার শুধু নিজে দূষণ করে না, বস্তুকণা তৈরি করে আরও কিছু উপাদানের দূষণেও সহায়তা করে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা সতর্ক করছেন, সালফার শ্বাসনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ সৃষ্টি করে ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সালফারের কারণে অ্যাজমা, সিওপিডি, ব্রঙ্কাইটিস, শিশুদের ফুসফুসের রোগ থেকে শুরু করে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকিও বাড়ায়। এ কারণে সারা বিশ্ব পরিশোধন করে জ্বালানি তেলে সালফারের মাত্রা কমিয়ে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি তেলে সালফারের মাত্রা ১০ পিপিএম নির্ধারণ করেছে।

আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে এ দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অন্য দেশের মানুষের তুলনায় বেশি। এই অবৈজ্ঞানিক ও ভিত্তিহীন ধারণার ওপর নির্ভর করে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই উদ্ভট সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, যা বৈশ্বিক নিয়ম ও মান থেকে ভিন্ন। করোনা মহামারির সময়েও দেশের মানুষকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। জ্বালানি তেলে সালফারের অনুমোদিত মাত্রা যে বৈশ্বিক মানদণ্ডের বিচারে ৩৫ গুণ বেশি, তারও একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে এখান থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের সক্ষমতা কি অন্য দেশের মানুষের চেয়ে ভিন্ন?

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কম দামে জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগ তৈরি করতে সালফারের মাত্রা ৩৫০ পিপিএম নির্ধারণ করেছিল। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ঘাটতির অজুহাতে নাগরিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ১৬ মাসেও কেন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলো?

বায়ুদূষণে বিশ্বের তৃতীয় শহর ঢাকা আর দেশগত বিচারে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। বায়ুদূষণে তৃতীয় বড় অবদান যানবাহনের কালো ধোঁয়ার। এর উৎস নিম্নমানের ডিজেল, পেট্রল ও অকটেনের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে অনুমোদিত মানের থেকেও কয়েক গুণ বেশি সালফারমিশ্রিত জ্বালানি তেল বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এর মূল দায় অবশ্যই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং পরিবেশকদের ওপর বর্তায়। কেননা জ্বালানি তেল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্ব রয়েছে বিপিসির ওপর। সরকারি তিন সংস্থা পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মাধ্যমে বিপিসি তেল বিক্রি করে। জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন, এসব সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকে তেল চুরি ও ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব একটা দেখা যায় না।

জ্বালানির মতো কৌশলগত পণ্যে বছরের পর বছর ধরে বিপুল অঙ্কের মুনাফা করছে বিপিসি। কিন্তু চুরি ও অদক্ষতা বন্ধে উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। আবার বাংলাদেশের একমাত্র তেল পরিশোধনাগারটি ৫৭ বছরের পুরোনো এবং সালফার পরিশোধনের ব্যবস্থা সেখানে নেই। নতুন পরিশোধনাগার তৈরির প্রকল্পটিও ঝুলে আছে। সব মিলিয়ে জ্বালানি খাতের ভুল নীতি, পুরোনো অবকাঠামো আর বিপিসির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চুরির বলি হতে হচ্ছে জনসাধারণকে।

উচ্চ সালফারযুক্ত ভেজাল তেল বিক্রি বন্ধে সরকারকে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তেল চুরি ও ভেজাল মেশানোর সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। জ্বালানি তেলে সালফারের মাত্রা বৈশ্বিক মানে নামিয়ে আনতেই হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ