মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে
Published: 15th, December 2025 GMT
দেশে মাদকাসক্তি পরিস্থিতি এমনিতেই ভয়াবহ। এর মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) মালয়েশিয়া থেকে আসা একটি নতুন ও ভয়ংকর সিনথেটিক মাদক ‘এমডিএমবি’র চালান জব্দ করেছে, চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছে। এ ঘটনায় নতুন মাদকের বিস্তারের বিষয়টি সামনে এল। মাদকটি ভেপ এবং ই-সিগারেটের ই-লিকুইডের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে, যা আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য এক নতুন ধরনের নীরব হুমকি।
এমডিএমবি হলো অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি তরল সিনথেটিক মাদক। ডিএনসি মহাপরিচালকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর মাত্র কয়েক ফোঁটা স্নায়ুতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা হ্যালুসিনেশন, আক্রমণাত্মক আচরণ এবং হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা ঘটায়। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো ভেপ ডিভাইস ও ই-সিগারেট এখন তরুণসমাজে একটি ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ হিসেবে জনপ্রিয় এবং মাদক কারবারিরা সেই জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়েই এই বিষ ছড়াচ্ছে।
ফেসবুকের ক্লোজড গ্রুপ, রিভিউ পেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমকে ‘অদৃশ্য বাজার’ হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। সংকেতপূর্ণ পোস্ট, বিশেষ ইমোজি এবং লাইভ ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন হওয়ায় সাধারণ ব্যবহারকারী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে এটি মাদক লেনদেন বলে শনাক্ত করা কঠিন। এটি প্রমাণ করে, মাদক কারবারিরা গতানুগতিক পথের পাশাপাশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকেও কাজে লাগাচ্ছে।
এই মাদকের জাল ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষিত শ্রেণির তরুণদের মধ্যে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও উচ্চশিক্ষিত পেশাদার ব্যক্তির উপস্থিতি। এই মাদকের বিস্তার রোধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানের পাশাপাশি সরকারের একাধিক স্তরে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। ভেপ ডিভাইস, এর ই-লিকুইডের উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। এই ডিভাইসগুলোর অপব্যবহার রোধ করতে দ্রুত কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তা আদান–প্রদানের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সংঘটিত মাদক লেনদেন ট্র্যাক করার জন্য ডিএনসি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে সাইবার নজরদারি ও ডিজিটাল ফরেনসিকের ক্ষেত্রে আরও সক্ষম করে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়া থেকে এই মাদক আমদানির রুট স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভেপ ডিভাইসগুলোর অপব্যবহার এবং এর মাধ্যমে মাদক সেবনের ঝুঁকি সম্পর্কে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপক সচেতনতা ও পরামর্শমূলক কর্মসূচি শুরু করতে হবে। নতুন সিনথেটিক মাদক এবং ডিজিটাল মাধ্যমে এর ব্যবসার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮-কে আরও আধুনিক ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে।
ডিজিটাল যুগে মাদকের নতুন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এখনই দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে তা আমাদের জনস্বাস্থ্য এবং তরুণসমাজের ভবিষ্যৎকে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে ঠেলে দেবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র
এছাড়াও পড়ুন:
‘বোম ফালাইয়া আমার ছেলেরে মাইরা ফেলছে’
সুদানের আবেই এলাকায় শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেসে সন্ত্রাসীদের হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন সদস্য শহীদ হয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (৩০)।
জাহাঙ্গীরের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তার মৃত্যুর খবরে বাড়িতে চলছে মাতম।
আরো পড়ুন:
জাতিসংঘের ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সবুজের বাড়িতে শোকের মাতম
বিজয় দিবসে বর্ণাঢ্য সামরিক ফ্লাইপাস্ট ও প্যারাজাম্পের আয়োজন
শহীদ জাহাঙ্গীর তারাকান্দি গ্রামের মো. হজরত আলী রহমানের ছেলে। জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয়েছে জানার পর থেকে বারবার মুর্চ্ছা যাচ্ছিলেন স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার। তার তিন বছর বয়সী একমাত্র সন্তান ইফরান কী হয়েছে বুঝতেই পারছিল না। সকলের কোলে কোলে ঘুরছিল সে, আর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল সবাইকে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০১৪ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন জাহাঙ্গীর। ৩৭ দিন আগে তিনি সুদানের আবেই অঞ্চলের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে যোগ দেন।
নিহত জাহাঙ্গীর আলমের বাবা হজরত আলী রহমান বলেন, “রাতে আমার এক ভাই ফোন দিয়ে বলছে, সুদানে বোমা ফুটছে তোমরা খবর রাখছো। পরে আমি বাড়িতে আইসা বলি জাহাঙ্গীর যেহানো থাহে, ওইহানো বোমা ফুটছে বুলে। পরে শুনছি, বোম ফালাইয়া আমার ছেলেরে মাইরা ফেলছে।”
তিনি বলেন, “আমার ছেলে যেখানে থাকত এর থেকে একটু দূরে যারা থাকত তারা রাতে জানাইছে। যা হওয়ার তাতো হইয়া গেছে। অহন আমি সরকারের কাছে আমার ছেলের মরদেহ পাইতে হাতজোড় করতাছি।”
সেনা সদস্য জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই মো. শাহীন বলেন, “আমি পেশায় গাড়ি চালক। অনেক রাতে বাসায় ফিরে দেখি, সবাই কান্নাকাটি করতেছে। পরে জানতে পারি, আমার ভাই বোমা হামলায় মারা গেছে।” এ কথা বলেই ভাইয়ের ছেলেকে কোলে নিয়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহীন। তিনি সরকারের কাছে দ্রুত তার ভাইয়ের মরদেহ পাওয়ার দাবি জানান।
নিহত জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই আরিফুর ইসলাম বাধন বলেন, “শনিবার রাতে জাহাঙ্গীরের সহকর্মী মনির হোসেন এবং ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইমরান টেলিফোনে ঘটনাটি আমাদের জানান। এরপর থেকে পরিবারে মাতম চলছে। কান্নায় কান্নায় সবাই পাথর হয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধ বাবা হজরত আলী ছেলের শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রুবাইয়া স্বামীর ছবি বুকে আঁকড়ে কেঁদেই চলেছেন। কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে চিৎকার করে কেঁদে উঠছেন।”
জাহাঙ্গীর আলমের মামা ওয়ালিউল্লাহ বলেন, “অফিসিয়ালি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন ইমরান আমাদের বিষয়টা জানান। এর আগে, শনিবার রাতে আমাদের স্বজনরা জানান, জাহাঙ্গীর মারা গেছেন।”
পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুপম দাস বলেন, “মরদেহ কীভাবে আনা হবে এ ব্যাপারে কোনো সরকারি নির্দেশনা এখনো পাইনি। আমরা যোগাযোগ রাখছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাও হচ্ছে। যে কোন আপডেট পেলেই আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।”
ঢাকা/রুমন/মাসুদ