‘৫৪ বছর ধরে ভাত খাই না, চোখের সামনে বীভৎস সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে’
Published: 15th, December 2025 GMT
‘চারদিকে রাস্তায় কুকুর-শিয়াল আর শকুন লাশ নিয়ে টানাটানি করছে। গর্ত খুঁড়ে কোনোরকমে লাশগুলো মাটিচাপা দিয়েছি। ধর্মীয় রীতি মেনে সৎকারের সুযোগও পাইনি। সেদিন সেই ভয়ংকর দৃশ্য দেখার পর আর কখনো ভাত খেতে পারিনি। এরপর ৫৪ বছর ধরে ভাত খাই না, ভাত খেতে গেলে বমি আসে, চোখের সামনে বীভৎস সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। কলা-রুটি–বিস্কুট খেয়ে বেঁচে আছি।’
১৯৭১ সালের ২১ মে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে ১৭৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনা স্মরণ করে কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরজিৎ দাশ (৭১)। চট্টগ্রাম নগরে তিনি পরিচিত ‘শুনু মামা’ নামে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আনোয়ারায় সংঘটিত এই ঘটনা ‘পরকৌড়া গণহত্যা’ নামে পরিচিত। ইউনিয়নের বাথুয়াপাড়া, পূর্ব কৈন্যারা ও পরৈকোড়ায় চালানো হয় এই হত্যাযজ্ঞ। ওই দিন সুরজিৎ দাশের বাড়িতে ঢুকে তাঁর বাবা রমনীমোহন দাশসহ নয়জনকে হত্যা করা হয়।
পরৈকোড়ার এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ মেলে লেখক জামাল উদ্দিনের ‘আনোয়ারা একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইতে। ওই দিন ১৭৬ জন নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করে ওই বইতে লেখা হয়েছে, ‘১৯ মে ভিংরোল গ্রামের সাবেক এমএনএ জামাল ছত্তার গোপন সূত্রে খবর পান পরৈকোড়া গ্রামে পাকিস্তানি আর্মি অপারেশন চালাবে। তিনি গ্রামের মুরব্বিদের জানান বিষয়টি। অন্যত্র সরে যাওয়ার পরামর্শ দেন।…২১ মে সকাল নয়টায় পাকিস্তানি বাহিনীর বহর কালিগঞ্জ ব্রিজে এসে পৌঁছায়। তাদের স্বাগত জানান মুসলিম লীগ নেতা খয়রাতি মিয়া ও সহযোগীরা।’
ওই দিনের ঘটনায় বাবাসহ স্বজন হারানো সুরজিৎ দাশের সঙ্গে গত শনিবার চট্টগ্রাম নগরের একটি বাসায় কথা হয়। তিনি জানান, তাঁর বাবা, ভগ্নিপতি, বোনের শ্বশুর, ভাগনেসহ নয়জনকে ওই দিন হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
সুরজিৎ দাশ বলেন, ‘আমরা চার ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে স্যার আশুতোষ কলেজে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলাম। ছাত্র অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে বোয়ালখালীতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী শেলিং শুরু করে তখন আমরা নৌকায় করে চলে যাই আনোয়ারায় আমাদের গ্রামে। আমরা ২৫ থেকে ৩০ মুক্তিযোদ্ধা থ্রি নট থ্রি রাইফেল, বন্দুক, পিস্তল ইত্যাদি নিয়ে গ্রামে পাহারা দিতাম’
তাঁদের কিছু অস্ত্র চট্টগ্রাম নগরে অস্ত্র বিক্রির দোকান থেকে লুট করা বলে জানান সুরজিৎ দাশ। তিনি বলেন, ‘পরৈকোড়া গ্রামের পাশেই আমাদের বাথুয়াপাড়া গ্রাম। সেখানে তখন শহর এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আত্মীয়স্বজন প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। পাড়াপড়শি ও আশ্রয় নেওয়া আত্মীয়দের পাহারায় দল গঠন করি আমরা।’
সুরজিৎ বলেন, ‘১৯ মে কালিগঞ্জ সেতু পার হয়ে ভাঙা ইটের রাস্তা ধরে পাঞ্জাবিদের জিপ ও ট্রাকের বহর ঢুকে এলাকায়। সেখানে তাদের সঙ্গে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। পরে আমরা খাল পার হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাই। এরপরেই শুরু হয় তাণ্ডব।’ তিনি বলেন, ‘ঘরে ঘরে আগুন দেওয়া হয়। আমার বাড়িতে ঢুকেও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে হানাদাররা। নিজের হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও ওই দিন আমি বাবা ও স্বজনদের রক্ষা করতে পারিনি। ঘটনার পরে বাড়ি ফিরে দেখি উঠানে-রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লাশ পড়ে আছে।’
পরিবারের লোকজনকে হারিয়ে অনেকটা উন্মাদ হয়ে পড়েন জানিয়ে সুরজিৎ দাশ বলেন, নৃশংস এই ঘটনার পর ভাত মুখে ওঠে না। এখনো সেই স্মৃতি তাড়া করে ফেরে। এক দিনের জন্যও সেই ঘটনা ভুলতে পারেন না।
সুরজিৎ দাশ অকৃতদার। তিনি চট্টগ্রাম নগরে এক ভাগনের বাসায় থাকেন। লেখক জামাল উদ্দিন বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরজিৎ দাশের বাবা রমনীমোহন দাশ ছিলেন গ্রাম চিকিৎসক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের অন্যতম এক যোদ্ধা তিনি। যেসব বিপ্লবী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হতেন, তাঁদের গোপনে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব পালন করতেন রমনীমোহন।
জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকার রমনীমোহনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারেও পাঠিয়েছিল। দীর্ঘ সময় পর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করলেও ১৯৭১ সালে ৮৫ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন।’
সুরজিৎ দাশের প্রতিবেশী সজল ভট্টাচার্য বলেন, ‘সুরজিৎ দাশকে আমরা বহুবার চেষ্টা করেছি ভাত খাওয়াতে। তাঁকে কিছুতেই রাজি করানো যায় না। তিনি ভাত না খেয়ে কেবল কলা-রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে আসছেন।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
তারেক রহমান দেশে ফিরছেন ২৫ ডিসেম্বর
আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজ শুক্রবার রাতে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মির্জা ফখরুল বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী ২৫ ডিসেম্বর ঢাকার মাটিতে এসে পৌঁছাবেন। দলের পক্ষ থেকে তাঁকে স্বাগত জানানো হচ্ছে।
তারেক রহমান ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর গ্রেপ্তার হন। ২০০৮ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান। এর পর থেকে তিনি সে দেশেই আছেন।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর বিভিন্ন মামলায় তারেক রহমানের সাজার রায় বাতিল এবং কোনো কোনো মামলায় আইনি প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি পান। এর পর থেকে তাঁর দেশে ফেরার আলোচনা শুরু হয়। তারেক রহমান শিগগিরই ফিরবেন—এমন কথা বিএনপি নেতারা কয়েক মাস ধরেই বলে আসছেন। তবে কেউ সুনির্দিষ্ট দিন তারিখ বলেননি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠলে ধারণা করা হচ্ছিল তারেক রহমান দ্রুতই দেশে ফিরছেন। এই প্রেক্ষাপটে লন্ডন থেকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন তারেক রহমান। সেখানে তিনি লেখেন, ‘এমন সংকটকালে মায়ের স্নেহ-স্পর্শ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যেকোনো সন্তানের মতো আমারও রয়েছে। কিন্তু অন্য আর সবার মতো এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।’ ওই পোস্টে তিনি আরও লেখেন, ‘স্পর্শকাতর বিষয়টির বিস্তারিত বর্ণনার অবকাশও সীমিত। রাজনৈতিক বাস্তবতার এ পরিস্থিতি প্রত্যাশিত পর্যায়ে উপনীত হওয়ামাত্রই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আমার সুদীর্ঘ উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে বলেই আমাদের পরিবার আশাবাদী।’
এরপর সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার বলা হয়েছে, তারেক রহমানের দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই।