বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি: প্রেক্ষাপট প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য
Published: 15th, December 2025 GMT
চর্যাগীতির ভাষাকে যদি আদি বাংলা হিসেবে গণ্য করা যায় তাহলে বলা চলে, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের দোঁহা রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু। ভাষাতত্ত্বের মতে, ‘চর্যার ভাষার সঙ্গে মৈথিলী, ওড়িয়া ও অসমীয়া ভাষার কিছু সম্পর্ক আছে।’ চর্যাপদের রচনাকাল অষ্টম শতক থেকে শুরু, যদিও এ সম্পর্কে ভিন্নমত রয়েছে। কাল বিচারে তাই আদি বাংলা কাব্যগীতি ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান আদি কাব্য থেকে পিছিয়ে নেই। চর্যাগীতির চরিত্র বিচারে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে চর্যার ভাষা যেমন লৌকিক, তেমনি তাতে রয়েছে বাঙালি জনজীবনের প্রতিফলন, এর অন্তর্নিহিত মানবিক আবেদনও অনস্বীকার্য। আর চর্যাগীতির রচয়িতাদের অধিকাংশই যে ছিলেন নিম্নবর্গীয় শ্রেণির অন্তর্গত, এ তথ্যের তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ।
চর্যাগীতির উর্বরকাল পেরিয়ে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ও পদাবলি সাহিত্যে লৌকিক চেতনার পাশাপাশি মানবিক চেতনার প্রকাশও সত্য। পরবর্তী পর্যায়ে ধর্মীয় কাহিনি, পুরাণকথা এবং অনুরূপ কাহিনি কাব্যে সমন্বয়ের মানসিকতা স্পষ্ট, যেমন স্পষ্ট লৌকিক ধর্মবিযুক্ত প্রেমকাহিনিতে মানবিক চেতনার আভাস। এ যুগের সাহিত্য প্রচেষ্টা হিন্দু-মুসলমান কবিদের অবদানে সমৃদ্ধ। বাংলার বাউলসাধনা পূর্বোক্ত মরমিয়া, সহজিয়া ধারার পরিমুক্ত রূপ, যা সামাজিক ধর্মসাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে মনের মানুষ খুঁজে ফেরার আকুতি নিয়ে গানের তানে সুরে-স্বরে পরিস্ফুট। তাদের মিলন সাধনা যেমন পরমের সঙ্গে তেমনি মানুষে-মানুষে।
উনিশ শতকে পাশ্চাত্য আধুনিকতায় উদ্বুদ্ধ ধর্মসামাজিক নবজাগরণের মধ্যেই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনার পাশাপাশি মানবিক চেতনার ধারাও প্রকাশ পায়, যদিও প্রথমটি ছিল অধিকতর শক্তিমান। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তখন একই সঙ্গে বিভাজিত সম্প্রদায়-চেতনার প্রতিফলন ঘটে। বিশ শতকের প্রথম দিকে সাহিত্যে আধুনিকতার চরিত্রবদল সত্ত্বেও ওই বিভাজন-চেতনা মুছে যায়নি। তবু পূর্বোক্ত ধারাবাহিকতায় সমন্বয়বাদী মানসিকতা সমাজের একাংশে রাজনীতি-সংস্কৃতির চর্চায় প্রকাশ পেয়েছে।
তা না হলে প্রথম বঙ্গবিভাগ (১৬ অক্টোবর, ১৯০৫) পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির আর্থসামাজিক স্বার্থের অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও মুসলমান সমাজের কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবদুল হালিম গজনভি, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, আবুল হুসেন, লিয়াকত হোসেন, আবুল কাসেম, দেদার বকস, দীন মহম্মদ, ডা.
এ বিষয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়েই বলা যায়, বঙ্গবিভাগের শাসনতান্ত্রিক ঘোষণার আগেই ১৯০৪ সালের ১৮ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী জনসভায় গৃহীত বঙ্গবিভাগ রোধের যে প্রস্তাব সরকারি দরবারে পাঠানো হয়, তাতে মুসলমান স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে নবাব সৈয়দ আমীর হোসেন, নবাব সৈয়দ আবদুস সোবহান, খান বাহাদুর, মোহাম্মদ ইউসুফ, মাওলানা শামসুল হুদা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
চর্যাপদের রচনাকাল অষ্টম শতক থেকে শুরু, যদিও এ সম্পর্কে ভিন্নমত রয়েছে। কাল বিচারে তাই আদি বাংলা কাব্যগীতি ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান আদি কাব্য থেকে পিছিয়ে নেই। চর্যাগীতির চরিত্র বিচারে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে চর্যার ভাষা যেমন লৌকিক, তেমনি তাতে রয়েছে বাঙালি জনজীবনের প্রতিফলন।আরও উল্লেখ্য, ওই বছরই জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে বঙ্গবিভাগবিরোধী জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জমিদার আনোয়ার আলী খান এবং বগুড়ায় অনুরূপ জনসভায় (২২ জুলাই, ১৯০৫) সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় ভূস্বামী সৈয়দ হাফিজুর রহমান চৌধুরী। সর্বোপরি বঙ্গবিভাগের দিন সমন্বিত জাতীয়তার প্রতীক হিসেবে ফেডারেশন হল নির্মাণ এবং স্বদেশি শিল্প ও শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে গঠিত ‘ন্যাশনাল ফান্ড’-এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সোবহান চৌধুরী, আবদুর রসুল, আবদুল হালিম গজনভি (অন্যতম সেক্রেটারি) প্রমুখ।
আহমদ রফিক (১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯–২ অক্টোবর ২০২৫)উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চর য গ ত র ম সলম ন ম নব ক ত র চর
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি: প্রেক্ষাপট প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য
চর্যাগীতির ভাষাকে যদি আদি বাংলা হিসেবে গণ্য করা যায় তাহলে বলা চলে, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের দোঁহা রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু। ভাষাতত্ত্বের মতে, ‘চর্যার ভাষার সঙ্গে মৈথিলী, ওড়িয়া ও অসমীয়া ভাষার কিছু সম্পর্ক আছে।’ চর্যাপদের রচনাকাল অষ্টম শতক থেকে শুরু, যদিও এ সম্পর্কে ভিন্নমত রয়েছে। কাল বিচারে তাই আদি বাংলা কাব্যগীতি ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান আদি কাব্য থেকে পিছিয়ে নেই। চর্যাগীতির চরিত্র বিচারে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে চর্যার ভাষা যেমন লৌকিক, তেমনি তাতে রয়েছে বাঙালি জনজীবনের প্রতিফলন, এর অন্তর্নিহিত মানবিক আবেদনও অনস্বীকার্য। আর চর্যাগীতির রচয়িতাদের অধিকাংশই যে ছিলেন নিম্নবর্গীয় শ্রেণির অন্তর্গত, এ তথ্যের তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ।
চর্যাগীতির উর্বরকাল পেরিয়ে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ও পদাবলি সাহিত্যে লৌকিক চেতনার পাশাপাশি মানবিক চেতনার প্রকাশও সত্য। পরবর্তী পর্যায়ে ধর্মীয় কাহিনি, পুরাণকথা এবং অনুরূপ কাহিনি কাব্যে সমন্বয়ের মানসিকতা স্পষ্ট, যেমন স্পষ্ট লৌকিক ধর্মবিযুক্ত প্রেমকাহিনিতে মানবিক চেতনার আভাস। এ যুগের সাহিত্য প্রচেষ্টা হিন্দু-মুসলমান কবিদের অবদানে সমৃদ্ধ। বাংলার বাউলসাধনা পূর্বোক্ত মরমিয়া, সহজিয়া ধারার পরিমুক্ত রূপ, যা সামাজিক ধর্মসাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে মনের মানুষ খুঁজে ফেরার আকুতি নিয়ে গানের তানে সুরে-স্বরে পরিস্ফুট। তাদের মিলন সাধনা যেমন পরমের সঙ্গে তেমনি মানুষে-মানুষে।
উনিশ শতকে পাশ্চাত্য আধুনিকতায় উদ্বুদ্ধ ধর্মসামাজিক নবজাগরণের মধ্যেই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনার পাশাপাশি মানবিক চেতনার ধারাও প্রকাশ পায়, যদিও প্রথমটি ছিল অধিকতর শক্তিমান। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তখন একই সঙ্গে বিভাজিত সম্প্রদায়-চেতনার প্রতিফলন ঘটে। বিশ শতকের প্রথম দিকে সাহিত্যে আধুনিকতার চরিত্রবদল সত্ত্বেও ওই বিভাজন-চেতনা মুছে যায়নি। তবু পূর্বোক্ত ধারাবাহিকতায় সমন্বয়বাদী মানসিকতা সমাজের একাংশে রাজনীতি-সংস্কৃতির চর্চায় প্রকাশ পেয়েছে।
তা না হলে প্রথম বঙ্গবিভাগ (১৬ অক্টোবর, ১৯০৫) পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির আর্থসামাজিক স্বার্থের অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও মুসলমান সমাজের কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবদুল হালিম গজনভি, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, আবুল হুসেন, লিয়াকত হোসেন, আবুল কাসেম, দেদার বকস, দীন মহম্মদ, ডা. গফুর ইসমাইল, মহম্মদ ইউসুফ বা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ বঙ্গবিভাগ রোধের প্রতিবাদে অংশ নেবেন কেন? হয়তো জাতিসত্তার বিভাজন তাঁরা চাননি।
এ বিষয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়েই বলা যায়, বঙ্গবিভাগের শাসনতান্ত্রিক ঘোষণার আগেই ১৯০৪ সালের ১৮ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী জনসভায় গৃহীত বঙ্গবিভাগ রোধের যে প্রস্তাব সরকারি দরবারে পাঠানো হয়, তাতে মুসলমান স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে নবাব সৈয়দ আমীর হোসেন, নবাব সৈয়দ আবদুস সোবহান, খান বাহাদুর, মোহাম্মদ ইউসুফ, মাওলানা শামসুল হুদা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
চর্যাপদের রচনাকাল অষ্টম শতক থেকে শুরু, যদিও এ সম্পর্কে ভিন্নমত রয়েছে। কাল বিচারে তাই আদি বাংলা কাব্যগীতি ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান আদি কাব্য থেকে পিছিয়ে নেই। চর্যাগীতির চরিত্র বিচারে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে চর্যার ভাষা যেমন লৌকিক, তেমনি তাতে রয়েছে বাঙালি জনজীবনের প্রতিফলন।আরও উল্লেখ্য, ওই বছরই জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে বঙ্গবিভাগবিরোধী জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জমিদার আনোয়ার আলী খান এবং বগুড়ায় অনুরূপ জনসভায় (২২ জুলাই, ১৯০৫) সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় ভূস্বামী সৈয়দ হাফিজুর রহমান চৌধুরী। সর্বোপরি বঙ্গবিভাগের দিন সমন্বিত জাতীয়তার প্রতীক হিসেবে ফেডারেশন হল নির্মাণ এবং স্বদেশি শিল্প ও শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে গঠিত ‘ন্যাশনাল ফান্ড’-এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সোবহান চৌধুরী, আবদুর রসুল, আবদুল হালিম গজনভি (অন্যতম সেক্রেটারি) প্রমুখ।
আহমদ রফিক (১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯–২ অক্টোবর ২০২৫)