‘এই জমি না দিলে বিষ দেন, খেয়ে মরি’
Published: 29th, January 2025 GMT
টিনশেডের ভাঙা ঘরগুলোর নানা অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মাটিতে। বাসিন্দাদের কেউ ত্রিপল টানিয়ে আছেন; কেউ আশ্রয় নিয়েছেন পাশের রাইস মিলের বারান্দায়; কেউ ভাঙা বেড়ার ঘরেই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। এ দৃশ্য কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সদকী ইউনিয়নের বাটিকামারায়।
সোমবার বিনা নোটিশে প্রশাসনের কর্মকর্তারা তিনটি ঘর পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেন। বাকি দুটির চালা ছাড়া বাকি সব খুলে ফেলা হয়। এ সময় উত্তেজিত জনতার ধাওয়ায় পালিয়ে যান কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদিত্য পাল।
ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে ওই পরিবারের সদস্যদের দুর্ভোগ দেখা যায়। এ সময় তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে স্বজন ও প্রতিবেশীদের। স্থানীয় কিছু উৎসুক জনতাও সেখানে ভিড় করেন। এ সময় বিলাপ করতে করতে দিনমজুর আবু
সাইদের স্ত্রী সালমা খাতুন বলেন, ‘সোমবার দুপুরে হুট করে প্রতিবেশী রাজিবুনের ছেলে রাজিব হোসেন প্রশাসনের লোকজন নিয়ে ঘরবাড়ি ভাঙে মালামাল সব ফেলা দেছে বাইরে। আমারে রাঁধাবাড়া বন্ধ। মানুষ এসে এসে খাবার দিচ্ছেন, তাই খাচ্ছি। আমাদের তো আর কোনো জাগা-জমি নাই। এই জমি না দিলে বিষ দেন, খেয়ে মরি। তা ছাড়া যাব কোনে?’
ওই পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার তরুণ মোড়-তারাপুর সড়কের বাটিকামারা এলাকায় সরকারের এক নম্বর খতিয়ানভুক্ত ১০ শতাংশ খাস জমি আছে। এর ৫ শতাংশ জমিতে প্রায় ৩০ বছর আগে ওই গ্রামের দিনমজুর ইসমাইল শেখ থাকতে শুরু করেন। প্রায় পাঁচ বছর পর বাকি ৫ শতাংশে বসবাস শুরু করেন মৃত আছাম উদ্দিনের স্ত্রী বুলু খাতুন। ওই নারী আওয়ামী লীগের এক সাবেক সংসদ সদস্যের বাড়িতে কাজ করতেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ১০ শতাংশ জমিই নিজের নামে স্থায়ী বন্দোবস্ত করেন বুলু খাতুন। ২০০২ সালে সেখান থেকে ২৫ হাজার টাকায় ৫ শতাংশ জমি কিনে নেন ইসমাইল শেখ। সেখানে ইসমাইলের স্ত্রী আমিরন নেছা ও তাদের পাঁচ সন্তান সাজু শেখ, রাজু শেখ, সাইদ শেখ, লালন শেখ ও কুতুব উদ্দিন বসবাস করছেন। ২০১৭ সালে কুষ্টিয়া আদালতে বুলু খাতুনকে দিয়ে ৫ শতাংশ জমি থেকে ওই পরিবারটিকে উচ্ছেদের জন্য মামলা করান তাঁর নাতি রাজিব হোসেন। আদালত গত ২৭ অক্টোবর পাঁচ ভাইকে জমি থেকে উচ্ছেদের আদেশ দেন। তাদের উচ্ছেদের বিষয়ে কোনো নোটিশ না দিয়েই প্রশাসন সোমবার অভিযান চালায়।
ইসমাইলের স্ত্রী আমিরন নেছা বলেন, ‘রাজিব ক্ষমতা খাটিয়ে ও ব্যাটাদের (প্রশাসনের কর্মকর্তা) ঘুষ দিয়ে ঘরবাড়ি সব ভেঙে দিছে। গতকালকের (সোমবার) তে খাওয়া দাওয়া বন্ধ। এহন নাতি, পুতি, ব্যাটা, ব্যাটার বউ নিয়ে রাইস মিলের বারান্দায় আছি। যাওয়ার কোনো জাগা নেই। তাঁবু টানা হলিও যেম্বায় (যেভাবেই) হোক, হেনেই থাকব।’
তাঁর ছেলে কুতুব উদ্দিন বলেন, জনগণের ভয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে তারা ইউএনও অফিসে যান। ইউএনও তাদের বিষয়টি লিখিতভাবে জানাতে বলেছেন।
রাজু শেখের স্ত্রী জাহিরন খাতুন বলেন, ‘শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি আমরা।’ থাকার একটি ব্যবস্থা করতে সংবাদকর্মীদের প্রতি আকুতি জানান তিনি।
বাটিকামারার প্রবীণ ব্যক্তি আনছার উদ্দিন এসেছিলেন তাদের দুর্ভোগ দেখতে। তিনি বলেন, ‘শুনলাম গরিব মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙে দেছে। তারা না খেয়ে আছে। সেজন্য কয়ডা খাবার নিয়ে দেখতে এসেছি।’
উচ্ছেদের পর সোমবার বিকেলেই বিক্ষুব্ধ জনতা বুলু খাতুনের নাতি রাজিবের ঘরবাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। পরে কয়েকশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ ভাইকে নিয়ে উপজেলা পরিষদ চত্বরে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। মঙ্গলবার রাজিব হোসেনের আধাপাকা বাড়ি ও আসবাবে ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা যায়। ভাঙা অংশগুলো এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ঘটনার পর থেকেই রাজিব সপরিবারে পালিয়ে যান। এ জন্য তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলামের ভাষ্য, আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসন বাটিকামারায় অভিযান চালিয়েছিলেন। ভুক্তভোগীদের বিষয়টি আদালত ও প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন। লিখিত পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
কার্টুন, মিমে অভ্যুত্থানের ভিন্ন ধারার দৃশ্যায়ন
টাকার বস্তার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে আছেন শুভ্র কেশ, সফেদ দাড়ি, চশমা পরিহিত এক লোক। তাঁর ছবি দেখে তো বটেই, এই বর্ণনা থেকেও তাঁকে চিনবেন দেশবাসী। বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা পতিত স্বৈরশাসকের এই উপদেষ্টা বলছেন, ‘টাকার ওপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।’ এই ছবির পাশেই এক কাটআউট। সেখানে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলতে বলতে দৌড়ে পালাচ্ছেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎপাটিত শেখ হাসিনা।
এমন মজার মজার কার্টুন, মিম, গ্রাফিতি, ভিডিও স্থাপনাকর্মসহ বৈচিত্র্যময় সৃজনসম্ভার নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিদ্রূপে বিদ্রোহ’ নামের ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। আয়োজন করেছে অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার সাময়িকী ‘ইয়ারকি’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দিনের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সবার জন্য প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা।
গত বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল জুলাই। একটি বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নেমেছিলেন অগণিত মানুষ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনেকে। আহত হয়েছেন বেশুমার। রক্তরঞ্জিত রাজপথ বেয়ে এসেছে জনতার বিজয়।
প্রদর্শনীতে প্রবেশপথটির দুই পাশে লাল রঙের পটভূমিতে বড় বড় ডিজিটাল পোস্টার। সেখানে ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশনের রিপোর্ট, ছবি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট—এসব তুলে আনা হয়েছে এ পোস্টারগুলোতে। প্রবেশপথটিও লাল রঙের। ‘জুলাই করিডর’ নামে এই রক্তিম পথটি বেয়ে দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীতে প্রবেশের সময় অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোর উত্তাপ ফিরে পাবেন।