ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ও দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করিয়া রাজধানীর ‘ধানমন্ডি ৩২ নম্বর’ বলিয়া পরিচিত সড়কে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনসহ সমগ্র দেশের বিভিন্ন জনপদে যেই ভাঙচুরের অঘটন চলিতেছে, উহাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতিই স্পষ্ট হইয়াছে। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা হইতে বিক্ষোভকারীরা ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী ঐ ভবনের সম্মুখে একত্র হইয়া হস্তচালিত বিভিন্ন দেশীয় সরঞ্জাম দিয়া ভাঙচুর শুরু করে। পরে ‘বুলডোজার’ দিয়া বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ভবনটি ধসাইবার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ভবনটি ভাঙ্গিয়া ফেলিবার অযুত আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্র সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। অনেক সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিতও হয়। তদুপরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলাকারীগণকে নিবৃত্ত করিতে পারিল না কেন– এই প্রশ্ন রহিয়া যাইবে। আমরা জানি, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রথম দফায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার ভবনটি উহার পূর্বে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’রূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছিল, যাহা ঐ দিনের পর হইতে একপ্রকার পরিত্যক্তই ছিল। তাহার পরও উহাতে হামলার ঘটনা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুকতাই তুলিয়া ধরিবে।
কেবল ধানমন্ডির ভবনটি নহে; ইহার সহিত বিভিন্ন জেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁহার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের ম্যুরাল ভাঙচুর, নামাঙ্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামফলক, আওয়ামী লীগের স্থানীয় দপ্তর ও নেতৃবৃন্দের বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চলিয়াছে। বৃহস্পতিবার অত্র সম্পাদকীয় রচনাকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটিয়াছে। এই ধরনের হামলা ও ভাঙচুর যে অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত; বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের এক বিবৃবতিতে তাহা বলা হইয়াছে। উক্ত বিবৃতিতে ৩২ নম্বরের ভবন ভাঙচুরের ঘটনাকে শেখ হাসিনার সহিংস আচরণের প্রতিক্রিয়া আখ্যা দেওয়া হইয়াছে। স্বীকার্য, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাইতে যেই ধরনের গণহত্যা চালাইয়াছিল, সেই ক্ষোভ মানুষের মনে রহিয়াছে। যেই কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যুক্ত হইয়া ছাত্রসমাজের উদ্দেশে ভাষণ দিবার ঘোষণার পরই ছাত্র-জনতার এই প্রতিক্রিয়া আমরা দেখিয়াছি। শেখ হাসিনার বক্তব্যকে ‘উস্কানি’রূপে গ্রহণ করিলেও উহার বিপরীতে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিই প্রত্যাশিত ছিল। হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিকাণ্ড কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নহে।
আমরা মনে করি, দেশে যেহেতু সরকার রহিয়াছে, কোনো পক্ষেরই আইন স্বহস্তে তুলিয়া লইবার অবকাশ নাই। অস্বীকার করা যাইবে না, আওয়ামী লীগের দেড় দশক ধরিয়া মানুষ যেইভাবে জুলুম-নিপীড়নের শিকার ও অধিকারহারা হইয়াছিল, তাহাতে ঐ সরকার পতনের পরপরই দেশজুড়িয়া বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুর অস্বাভাবিক ছিল না। ঐ সময় কোনো সরকার বিদ্যমান না থাকিবার কারণে জনরোষ হইতে ঐগুলি রক্ষারও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ছিল না। ৮ আগস্ট যেহেতু অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার শপথ লইয়াছে, সেহেতু তৎপরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত উন্নতিই প্রত্যাশিত ছিল। ইহাও স্মরণে রাখিতে হইবে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অভ্যুত্থানকারী পক্ষগুলির অভিপ্রায়েই গঠিত হইয়াছে। সরকার যাহাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখিতে পারে, তজ্জন্য সকলের সহযোগিতা কাম্য।
অস্বীকার করা যাইবে না, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর হইতেই নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিয়া আসিতেছে। নানামুখী আন্দোলনসহ দেড় দশকের পুঞ্জীভূত সংকটের মধ্যেও তাহারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করিয়াছে। বুধবারও যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উপযুক্ত ব্যবস্থা গৃহীত হইত, তাহা হইলে খোদ সরকারের ভাষাতেই এইরূপ অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার ঘটনা এড়ানো যাইত। আমরা মনে করি, ভবিষ্যতে এই ধরনের কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নাই।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।