‘এ… সাপ খেলা দেখাই, শিঙা লাগাই, দাঁতের পুক ফালাই, বাতের ব্যথা সারাই...’ কিংবা ‘লেইস-ফিতা, চুড়ি কিনবেন… লেইস-ফিতা…’ সুরে সুরে ডাকতেন বেদে নারীরা। দলবেঁধে আসা নানা বয়সী মানুষ কিনতেন তাদের কাছ থেকে। সেই দিন অতীত হয়েছে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষের। তাদেরই একটি দল বাস করছে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার তালতলায়। গ্রামটি উপজেলার মালখানগর ইউনিয়নের ইছামতী নদীর তীরে। নদীতেই ছোট ছোট নৌকায় বাস করছে অন্তত ৬০টি পরিবার।
বৃহস্পতিবার সিরাজদীখান বাজারে ঝোলা কাঁধে বের হয়েছিলেন রাবেয়া বেগম (৫৭) নামে এক বেদে নারী। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছ থেইক্কা মানুষ আগে চুড়ি-ফিতা কিনলেও এখন বাড়ির বউ-ঝিরা হাটবাজারে গিয়া কিনে। এ ছাড়া যেহানে-সেহানে ডাক্তার থাকায় আমাগো কাছ থাইক্যা শিঙ্গা ও তাবিজ কেউ নেয় না।’ গ্রামেগঞ্জে ঘুরেও তাদের কোনো কাজ জোটে না। বাধ্য হয়ে মানুষের কাছে হাত পাতেন। এভাবেই যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে হয় রাবেয়াদের।
এসব পরিবারের দিন এখন কাটছে অতিকষ্টে। ডিশ অ্যান্টেনা-ইন্টারনেটের যুগে বেদেদের কাছ থেকে সাপ খেলা দেখায় আগ্রহ নেই কারও। অথচ এক সময় বেদে নারী-পুরুষ এলে গ্রামজুড়ে হুল্লোড় পড়ে যেত। তাদের অনেকে ঝুড়িভর্তি করে নিয়ে আসতেন লেইস-ফিতা, চুড়ি, আয়না ও নানা প্রসাধনসামগ্রী। এখন গ্রামের বাজারে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। যে কারণে বেদে নারীদের কাছ থেকে কেউ কিনতে চান না।
বংশপরম্পরায় ইছামতী নদীর তালতলায় বসবাস করে আসছে বেদে পরিবারগুলো। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আরাকানরাজ বল্লার সঙ্গে পালিয়ে বেদেরা মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে আসে। তখন ইছামতীর পুরো যৌবন ছিল। মাছ পাওয়া যেত অনেক, চারপাশ ছিল বিশাল গাছের ছায়ায় ঢাকা। প্রচুর পাখি পাওয়া যেত, যা শিকার করে বেদেরা বিক্রি করত। কালের আবর্তে এই নদীর নানা জায়গায় এখন চর।
৭০ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগমের স্মৃতিতে সোনালি দিনের কথা ঝিলিক দেয়। পূর্বপুরুষের মতো তাঁর জন্মও নৌকায়। খুব ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে গ্রাম থেকে গ্রামে, গঞ্জ থেকে গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেখানে ফেরি করে বিক্রি করেছেন চুড়ি-ফিতা ও তাবিজ। শিঙা লাগানো ও সাপখেলা দেখিয়েই শৈশব-কৈশোর কেটেছে মনোয়ারার। এখন তাদের তেমন উপার্জন নেই বললেই চলে। মনোয়ারা বলেন, বিভিন্ন গ্রামে যে স্বল্প আয়োজনে মেলা হয়, সেখানেই ছুটে যান। মাটির তৈরি সামগ্রী, চুড়ি-ফিতা-নেইলপালিশ নিয়ে যান। এসব বিক্রি করেই যে আয় হয়, এ দিয়েই কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাতে হয়। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা এখন মাছ ধরেন। এতেও কিছুটা আয় হয়। যদিও নদীতে তেমন মাছ নেই।
তালতলা বেদেপল্লির সর্দার মিনহাজ উদ্দিনের ভাষ্য, তাদের অনেকের নাম ভোটার তালিকায় উঠেছে। এরপরও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা। দেশের অন্য নাগরিকদের মতো সমান সুযোগ-সুবিধার দাবি করেন তিনি।
সিরাজদীখানের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনা আক্তার বলেন, বেদেদের অনেকেই ভোটার হচ্ছে। এতে করে তাদের পরিচয় নির্দিষ্ট হচ্ছে। এ সম্প্রদায়ের সদস্যদেরও চিহ্নিত করা যায়। এতে তাদের মধ্যে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, গর্ভকালীন ভাতাসহ নাগরিক সুবিধা দেওয়া সহজ হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধাই তাদের দেওয়া হচ্ছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
একজন চা শ্রমিকের দিনে আয় ১৭৮ টাকা
হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলেয়ে চা বাগানের সংখ্যা প্রায় ৪১টি। এসব বাগানের বাসিন্দা প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে, স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ চা পাতা উত্তোলনে জড়িত।
চা বাগানে একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়। এর বিনিময়ে মজুরি পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো বাগানে নিয়মিত এই মজুরিও দেওয়া হয় না।
শ্রমিকদের দাবি, দৈনিক মজুরি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করতে হবে। বর্তমানে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলে না। প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে চা শ্রমিকদের নৈমিত্তিক ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে।
আরো পড়ুন:
বৈষম্য কেন? নারী শ্রমিকেরা পান না সমান মজুরি
ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা
সরেজমিনে কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকরা ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করেন। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, দু-বেলা পেটভরে খেতে পারেন না।
শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘‘দুই বছর অন্তর চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি ও সমস্যা নিয়ে চা বাগান মালিক পক্ষের সংগঠনের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিনিধির বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে বৈঠক হয়েছে। সে সময় ৮ টাকা ৫০ পয়সা বৃদ্ধি পেয়ে মজুরি ১৭৮ টাকা ৫০ নির্ধারিত হয়েছে।’’
শ্রমিকদের কষ্টের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই টাকায় চলা যায় না। দেশের কোথাও এতো সস্তা শ্রমের দাম নেই। বর্তমানে একজন কৃষিশ্রমিক দিনে ৫০০-১০০০ টাকা আয় করেন, একজন রিকশাচালকের প্রতিদিনের আয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেখানে একজন চা শ্রমিক পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। এজন্য তাকে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়।’’
চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নাটক ও গানের মাধ্যমে দাবি জানিয়ে আসা জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘দৈনিক ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা মজুরিতে শ্রমিকদের চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অচিরেই মজুরি ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক। এছাড়া, শ্রমিকদের আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’’
ঢাকা/রাজীব