সামনে কী? জাতীয় নির্বাচন? কত দূর?
Published: 12th, March 2025 GMT
হঠাৎই মনে হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন কিছু হতে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বেশ কিছুদিন ধরে বলছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য প্রথম দেশের বাইরে এ কথা বলেছিলেন। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে তিনি এ কথা বলে যাচ্ছিলেন। প্রায় সবাই, এমনকি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো পর্যন্ত এ কথা বিশ্বাস করছিল। গ্রামগঞ্জে, চায়ের টেবিলেও এ কথাগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ তিনি বললেন, ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যখন এ কথা বলছিলেন, তখন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান প্রথমে বললেন, ‘ডিসেম্বর থেকে জুনের’ মধ্যেই নির্বাচন হবে। এর পরপরই নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা ইংরেজিতে এনসিপির নতুন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বললেন, দেশে এখনো নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। প্রশাসন ও পুলিশের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বললেন, এই পুলিশ নির্বাচন করার মতো হয়ে ওঠেনি।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা রাইট টু ফ্রিডমের প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এবং নির্বাহী পরিচালক সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিচের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় বলেন, ছয়টি কমিশন সংস্কার বিষয়ে যে প্রস্তাবগুলো রেখেছে, সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। সংলাপ শেষে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ (জুলাই চার্টার) স্বাক্ষর করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার এই সনদের সুপারিশগুলোর কিছু অংশ বাস্তবায়ন করবে এবং বাকি অংশ বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ–ও বলেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে কম সংস্কারে সম্মত হয়, তবে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে পারে। অন্যথায় জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।
ব্যাপারটা কেমন একটু হলো না? জুলাই চার্টার ও সংস্কার নিশ্চয়ই এক জিনিস নয়। কিন্তু মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা যে রকম করে বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য হলে পরে সেটা সংস্কার–সংক্রান্ত ঐকমত্য হবে। ব্যাপারটা একটু বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার।
পাঠকদের নিশ্চয়ই জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ সম্পর্কে স্মরণ আছে। তখন এটাকে প্রক্লেমেশন বলা হয়েছে। ছাত্ররা ব্যাপারটাতে তখন খুবই সিরিয়াস। জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর একটি প্রক্লেমেশন যে নেই, তাতে তাঁরা খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। সে জন্য তাঁরা সরকারকে দোষারোপও করছিলেন। সরকার তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বলেছিল, প্রক্লেমেশন তো আর একা একা করা যাবে না। এ জন্য ঐকমত্য দরকার। সরকার সেই ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলা শুরু করবে।
আরও পড়ুননির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন এত তাড়া২২ নভেম্বর ২০২৪জুলাই সনদ বা চার্টার মানে তো কেবল জুলাইয়ের অভ্যুত্থান নয়, এটা একটা ইতিহাস। এ জন্যই এর অতীত আছে, বর্তমান আছে এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা থাকবে। যাঁরা আন্দোলনে ছিলেন, তাঁরা সবাই এ জন্যই বলছেন, এ হচ্ছে একটা ধারাবাহিকতা। বায়ান্ন থেকে আজ পর্যন্ত সে ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। অনেকে, এমনকি ভারত বিভক্তির মধ্যেও আজকের বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকনির্দেশনা খুঁজে পান।
যদি সুনির্দিষ্ট করে বলি, তবে প্রক্লেমেশন হলো সেই জিনিস, যা ওই ভাঙাচোরার সময়টাকে ব্যাখ্যা করে এবং ভবিষ্যতের গড়ার আশা জাগিয়ে দেয়। এটা তাই আশাজাগানিয়া একটি বিশ্লেষণ, রাষ্ট্রসংস্কারের রূপরেখা নয়।
ডিসেম্বরের শেষেই ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা একটি প্রক্লেমেশনের জন্য জোর চাপ তৈরি করেছিল। তারা একটি সনদের খসড়াও তৈরি করে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীদের কাছে পাঠিয়েছিল। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ছাত্রদের এই উদ্যোগে তখন বিভিন্ন অংশীজন তেমন আগ্রহ দেখায়নি। না, ছাত্রদের প্রতি কোনো অবহেলা নয়; বিষয়টাকে নিজেদের মতো করে গ্রহণ করার প্রশ্ন।
যেহেতু এটি বড়মাপের রাজনৈতিক প্রশ্ন, এই সনদের সঙ্গে সামগ্রিক রাজনীতিকে মিলিয়ে দেখার প্রশ্ন। কেউ প্রস্তাবিত সনদের সঙ্গে একমত হতে পারে, কেউ আংশিকভাবে একমত হতে পারে, আবার কেউ এমন হতে পারে যে সামগ্রিক ধারণার সঙ্গেই সে একমত নয়।
সাত মাস পর সমগ্র জাতি আজ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে মনে করছে ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা। যেমন নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মনে করছেন, দেশের পুলিশ বাহিনী একটি কোয়ালিটি নির্বাচন করার জন্য মোটেই তৈরি হয়নি। কথাটার সঙ্গে আমি একমত। প্রশ্ন হলো গত সাত মাসে পুলিশকে কি কমপক্ষে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত না। এখনো সাত মাসের মধ্যে নেওয়া যায় না?রাষ্ট্রসংস্কারের বিষয়টি সনদের সমার্থক নয়। সংস্কার, বিশেষ করে বর্তমান সময়ে সংবিধান এবং নির্বাচন পদ্ধতির ওপর একটি গুণগত পরিবর্তনের কর্মসূচি। এটা কোনোক্রমে জুলাই অভ্যুত্থানের সনদ নয়। সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে, যারা তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে। এই ছয় কমিশন ছয়টি স্প্রেডশিট তৈরি করেছে, যার ওপর অংশীদার হ্যাঁ–না অথবা খানিকটা পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখতে পারবে। এখানে (টিক) দেওয়ার অথবা প্রস্তাব দেওয়ার পরামর্শ আছে। দুটির পদ্ধতি আলাদা।
দুটিকে কি এক করে দেখা হচ্ছে? এর তো কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া দলগুলো যদি অল্প সংস্কারে রাজি হয়, তবে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে, আর না হলে মার্চে বা জুনে হবে নির্বাচন, এটাও কী রকম কথা! এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সংস্কার সম্পর্কেই একটি ধোঁয়াশা তৈরি হয়ে যায় না কি? কম সংস্কার বা বেশি সংস্কার ব্যাপারটা কি এ রকম?
সাত মাস পর সমগ্র জাতি আজ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে মনে করছে ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা। যেমন নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মনে করছেন, দেশের পুলিশ বাহিনী একটি কোয়ালিটি নির্বাচন করার জন্য মোটেই তৈরি হয়নি। কথাটার সঙ্গে আমি একমত। প্রশ্ন হলো গত সাত মাসে পুলিশকে কি কমপক্ষে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত না। এখনো সাত মাসের মধ্যে নেওয়া যায় না?
জনপ্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন সম্পর্কেও প্রায় একই কথা বলা যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সংস্কার কথাটার মানে কী? অবশ্যই সংস্কার মানে প্রায় খোলনলচে বদলে ফেলার কথা বলা যায়। আবার পুলিশ প্রো-অ্যাকটিভ না হয়ে মোটামুটি অ্যাকটিভ হয়েও কাজ চালিয়ে নিতে পারে। যাঁরা এখন দায়িত্বে আছেন, তাঁরা এইভাবে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করার কথা ভাবতে পারছেন বলে মনে হয় না। এ জন্যই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পাওয়ার এক মাস পর যতটুকু সংস্কার (?) করেছেন, তার কথা বলছেন; আবার সেদিন বললেন, এখন পর্যন্ত সংস্কার শুরুই করেননি। হঠাৎ এভাবে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলায় দেশ কি একটু থমকে গেছে? আমার মনে হয়।
শেখ হাসিনার হৃদয়হীন ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে ছাত্র–জনতা যে বিজয় অর্জন করেছিল, তার কারণে এ দেশের জনগণ, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের ওপর শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিশীল। ছাত্ররা যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, সেটি তাঁরা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং সেটিই স্বাভাবিক।
আর রাজনৈতিক দলগুলো তো নতুন রাজনৈতিক দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখবে। নতুন গঠিত এই দলের আচরণ বা উচ্চারণ তারা শুরু থেকেই মনোযোগের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে এবং করবে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে এই দল এবং দলের সংগঠকদের প্রতি বিশেষভাবে অনুভূতিশীল, সেটা তো আর গোপন নেই। তাঁদের কথা যে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষভাবে শোনেন, তা তাঁরা মনে করেন। তাঁরা এ–ও মনে করেন যে সরকার তাঁদের রাজনৈতিকভাবে বিশেষ সুবিধা দিতে পারে। যেমন দল গঠন করতে তাঁদের সময়ের প্রয়োজন, এ জন্যই তাড়াতাড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচি থেকে সরকার পিছিয়ে যেতে পারে। এ জন্যই হয়তো ডিসেম্বর থেকে একবারেই জুনে চলে যাওয়া। প্রয়োজনে আরও পিছিয়ে যাওয়া যাবে।
আগামী দিনের রাজনীতি তাই সার্বিকভাবে আরও গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।
● মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন ত ক জ ল ই সনদ ড স ম বর সনদ র স ঐকমত য অন ষ ঠ এ জন য র ওপর বলল ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট, একমত ইউনূস ও তারেক
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিতে টানাপোড়েন যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছিল, লন্ডন বৈঠকে তা অনেকটা কেটেছে।
গতকাল শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা আসে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের রমজান মাসের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে লন্ডন বৈঠক নিয়ে দেশে যে কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা ছিল, সেটার সমাপ্তি ঘটেছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। এর মধ্যেই ৬ জুন ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারপ্রধানের এই ঘোষণা বিএনপি মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে দলটির নেতারা প্রকাশ্যেই অসন্তুষ্টির কথা জানান। অবশ্য সরকার–ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের জন্য উপদেষ্টাদের কেউ কেউ জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে অধ্যাপক ইউনূসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এপ্রিলকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের এক সপ্তাহের মাথায় লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নতুন ঘোষণা এল। ধারণা করা হচ্ছে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট হতে পারে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ঘটনাকে বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। দলগুলো বলেছে, এর মাধ্যমে জাতি ‘স্বস্তির বার্তা’ পেয়েছে।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে অনেকের দুর্ভাবনা ছিল। সেটা কেটে গেছে, গোটা জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। অধ্যাপক ইউনূস দুঃসময়ে জাতির অভিভাবক হিসেবে নিজের বিশালত্ব, গভীরতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি নেতা তারেক রহমানও যথোচিত সৌজন্যবোধ, পরিণত বুদ্ধি ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বলেন, বিচার বা সংস্কার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির বড় ধরনের মতপার্থক্য নেই। মতপার্থক্য ছিল নির্বাচনের সময় নিয়ে। দুজনের (ইউনূস-তারেক) বৈঠকের পর এই মতপার্থক্যও অনেকটা কমে এসেছে।
যদিও লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে যে প্রক্রিয়ায় সমঝোতা হয়েছে এবং সেটি যেভাবে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের ভিন্নমত নেই। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের সমঝোতায়ও তাঁরা অসন্তুষ্ট নন। তাঁদের প্রশ্ন এক জায়গায়। সেটি হচ্ছে, সরকার এভাবে একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দিতে পারে কি না? এটা কতটা নৈতিক।
লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে এনসিপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচনসংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
এ বিষয়ে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
গতকাল যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে সেখানকার সময় সকাল নয়টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটা) অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। তাঁরা প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলেন। এর মধ্যে বড় একটি সময় অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান একান্তে বৈঠক করেন। পরে ওই হোটেলেই যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। একান্ত আলোচনায় দুই নেতা ‘সন্তুষ্ট’ হয়েছেন বলে তাঁরা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে যৌথ বিবৃতি (সরকার ও বিএনপি) পড়ে শোনান নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। তাতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।
প্রশ্নোত্তরে যা বললেন সরকার ও বিএনপির প্রতিনিধিপরে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক সাংবাদিক জানতে চান, তাহলে কি সরকার এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা থেকে সরে আসছে? জবাবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ ঘোষণায় এই বিষয়টি সুস্পষ্টই বলা আছে। আপনারা শুনেছেন। যদি সব কাজ সময়মতো আমরা করতে পারি এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা করা যেতে পারে।’
তাহলে নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণে সমস্যাটা কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। নির্বাচন সম্পর্কে আজকে যৌথ বিবৃতিতে আমরা বলে দিয়েছি দুই পক্ষই। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ছাড়া লন্ডন বৈঠকে আর কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এ ছাড়া সংস্কার, বিচার, জুলাই ঘোষণা নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি।
তবে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সব বিষয়ে আলোচনা তো হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা তো নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। আমরা সবাই চাই, দেশ গড়ার যে প্রত্যয় আমরা নিয়েছি, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই কাজটা করব। বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে আমরা সবাই ঐকমত্যে এসেছি, শুধু নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও সেটা আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে জুলাই সনদ নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে তো ইতিমধ্যে আলোচনা চলছে দেশে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত আছে যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে। সংস্কারের ব্যাপারেও একই উত্তর আমাকে দিতে হয় যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা সংস্কার ও জুলাই সনদ—দুটোই করব। সবার ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং আমি নিশ্চিত, খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না? জবাবে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখানে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’ এ প্রশ্নে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘এটা তাদের (এনসিপি) জিজ্ঞেস করুন। প্রতিটি দলের নিজস্ব মতামত আছে। তবে আমরা সবাইকে নিয়ে নির্বাচনটা করতে চাচ্ছি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার হত্যাযজ্ঞের বিচারপ্রক্রিয়া তিনি শেষ করতে চান এবং পরে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না, সেটা হয়ে থাকলে নির্বাচনের রূপরেখায় এর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ বিবৃতিতে এর উত্তর দেওয়া আছে। সংস্কার এবং বিচার; দুই বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে এবং আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী) যে এই অগ্রগতি আমরা নির্বাচনের আগেই দেখতে পাব।’
তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না বা তিনি কবে দেশে ফিরতে পারেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আলোচনার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না। তারেক রহমান সাহেব যখনই ইচ্ছা দেশে ফিরে যেতে পারবেন। সুতরাং এটার সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন, সময়মতো।’
সংবাদ সম্মেলনে শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘বৈঠকে আলোচনায় আপনারা কি সন্তুষ্ট?’ সমস্বরে এ প্রশ্নের জবাব দেন খলিলুর রহমান ও আমীর খসরু মাহমুদ। দুজনই বলেন, ‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট।’ এর সঙ্গে আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা তো বলছি নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ এরপর খলিলুর রহমান বলেন, ‘সন্তুষ্ট না হলে তো যৌথ ঘোষণা আসার কথা নয়।’
‘চারদিকে যে অনিশ্চয়তা ছিল, সেটা কেটেছে’অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর ঢাকায় বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বৈঠক সফল হয়েছে। সবকিছু যে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থাকে কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।
মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনের বৈঠকের পর তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। এ সময় তারেক রহমান দলের নেতা–কর্মীদের অভিনন্দন ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। একই সঙ্গে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য তাঁর মা ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানান।
বিএনপির মহাসচিব দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি (ইউনূস) তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সবকিছু একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থা কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনের দিকে ও আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।