কথা ছিল নওগাঁ যাওয়ার। ঢাকা থেকে বগুড়া হয়ে কমবেশি ২২৮ কিলোমিটার পথ। রাস্তায় কোনো গ্যাঞ্জাম না থাকলে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মামলা। কাকডাকা ভোরে রওনা দিয়ে রাতের মধ্যেই ফেরা সম্ভব। কিন্তু বিধিবাম! আজকাল যতই দিনক্ষণ মেনে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে যাত্রা করেন না কেন, যাত্রানাস্তি না হওয়ার কোনো গ্যারান্টি নেই। কুয়াশার কারণেই হোক আর চালকদের ঘুম এসে যাওয়ার কারণেই হোক, দুই ট্রাকের মুখোমুখি ‘আলাপ’ হয়ে যাওয়ায় রাস্তা বন্ধ টাঙ্গাইলের অগেই। চিতকাত হয়ে ভূঞাপুর ছুঁয়ে যমুনা সেতুর মুখে যেতে যেতে ঘণ্টা দেড়েক সময় খসে গেল।

যমুনা সেতু পার হয়ে স্থানীয় মানুষদের কাছে সামনের রাস্তার হালহকিকত জানতে চাইলে আমাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে গেল। একজন মুরব্বি লজ্জা দিলেন, ‘যাবেন আত্রাই, জিগান নওগাঁর পথ! হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া হয়ে নাটোরের নলডাঙ্গা দিয়ে আহসানগঞ্জ (আত্রাই) পৌঁছে যাবেন আড়াই ঘণ্টায় আর এখান থেকে বগুড়া হয়ে নওগাঁ যেতে লাগবে তিন ঘণ্টা, তারপর সেখান থেকে আত্রাই আরও ৫০ মিনিট মিনিমাম।’

মুরব্বির পরামর্শে পথ কমার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ফসল আর চাষবাদের একটা আন্দাজ পাওয়া গেল। হাইওয়ে দিয়ে গেলে সেটা হতো না।

রাস্তার দুদিকে আলু আর আলু। গত ১০ বছরে নওগাঁয় আলুর আবাদ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। জেলায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় কার্ডিনাল, এস্টোরিক, গ্রানোলা ও দেশি জাতের লাল আলু। হেক্টরপ্রতি কার্ডিনাল উৎপাদিত হয় ২০ থেকে ২২ মেট্রিক টন পর্যন্ত। এ ছাড়া হেক্টরপ্রতি এস্টোরিক ১৮ থেকে ২০, গ্রানোলা ১৭ থেকে ১৮ ও দেশি জাতের আলু উৎপাদিত হয় ১৬ থেকে ১৭ মেট্রিক টন। উৎপাদন বেশি হওয়ায় জেলার অধিকাংশ চাষিই কার্ডিনাল আলু চাষে বেশি আগ্রহী। জেলার সমতল জমির পাশাপাশি আত্রাই, ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গা নদীর চরেও আলু আবাদ হয়েছে।

চলতি (২০২৪-২৫) রবি মৌসুমে ২১ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কৃষকেরা তাঁদের জমিতে আলু চাষ করেছেন। সারা নওগাঁ জেলার মধ্যে আলু উৎপাদনে বদলগাছী আর মান্দা উপজেলার পরই আত্রাইয়ের স্থান। সেখানে এবার আলুর আবাদ হচ্ছে ২ হাজার ৭২৫ হেক্টর জমিতে।

নওগাঁর কৃষি কার্যালয়ের ধারণা, প্রতি হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১৮ দশমিক ৮২ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই হিসাবে চলতি রবি মৌসুমে জেলায় মোট ৪ লাখ ৩০১ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হবে।

এত আলু রাখবে কোথায়

প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের বিপরীতে জেলায় রয়েছে মাত্র ৭০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ৮টি বেসরকারি হিমাগার। তার ওপর এবার হিমাগারের মালিকেরা আলু সংরক্ষণের দাম দ্বিগুণ করে দিয়েছে। বুঝলাম না কেন তারা তাদের দাম বাড়ার প্রজ্ঞাপনে হিটলারের মতো এসএসএস সাইন ব্যবহার করেছে। দামটা যে তারা হিটলারের মতো একতরফাভাবে বাড়িয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আত্রাইয়ের আগে আলু ওঠে নীলফামারী এলাকায়। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার আলুচাষিদের মাথায় হাত! কিশোরগঞ্জের এক চাষি বলেন, ‘বর্তমানে আলুর দাম কম হওয়ার কারণে না পারছি বেচতে, আবার না পারছি হিমাগারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে।’ তিনি একটা হিসাব দিলেন। হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করতে গেলে ৫০ কেজির একটি বস্তার দাম ৫৫ টাকা, আলু প্রসেসিংয়ে খরচ বস্তাপ্রতি ২০ টাকা, হিমাগারের ভাড়া প্রতি কেজি ৮ টাকা হিসাবে ৪০০ টাকা, হিমাগারে নিয়ে যাওয়ার পরিবহন খরচ বস্তাপ্রতি ৪০ টাকা—সব মিলিয়ে হিমাগারে সংরক্ষণ করতে গেলেও প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় ব্যয় হবে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। অনেকেই তাই বাধ্য হয়ে কম দামে মাঠেই আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন। কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১২ টাকায় নেমে এসেছে আলুর দাম। তার ওপর আছে এত দিনের না খাওয়া পার্টিদের যন্ত্রণা। নগদে আলু বেচলেই তারা ঘুরঘুর করছে।

সম্প্রতি ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া ও জয়পুরহাটের চাষিরা জানিয়েছেন, কেজিপ্রতি আলুর দাম এখন ১১ টাকার কম। এবার প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ১৩ টাকা। চাষিরা উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না। তাঁরা আলুর দাম বাড়াতে বা তাঁদের সহায়তার জন্য সরকারি উদ্যোগ আশা করছেন।

এরমধ্যেই লাল মনিরহাটের চাষিরা গত শনিবার ১ মার্চ ২০২৫ রাস্তায় আলু ফেলে সড়ক অবরধ করে বসেন। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, ২০২৪ সালে ৬০ কেজির এক বস্তা আলু সংরক্ষণে হিমাগারের ভাড়া ছিল ৩৫০ টাকা। চলতি বছর হিমাগার কর্তৃপক্ষ ভাড়া ৪৮০ টাকা নির্ধারণ করেছে। এই একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাদের সড়ক অবরোধ। বর্তমানে বাজারে আলুর কেজি ১০ টাকা। ১০ টাকার মধ্যে যদি ৮ টাকাই হিমাগার মালিক নিয়ে নেয় তাহলে কৃষকরা পাচ্ছেন মাত্র ২ টাকা। অবরোধকারীদের দাবি আলু সংরক্ষণে হিমাগারের বাড়তি ভাড়া বাতিল করে আগের ভাড়া বহাল রাখা হোক।

তাঁরা জানান আলুর দাম পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি চলতি মৌসুমে আলু উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। আলুর বীজ, সার, কীটনাশক কিনে উৎপাদন করতে গিয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি খরচ পড়েছে। তার ওপর হিমাগারের ভাড়া বাড়ানো কৃষকদের জন্য আলু সংরক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

প্রথম আলোর লালমনিরহাটের প্রতিনিধি জানালেন আলুচাষীদের সড়ক অবরোধের কথা জানতে পেরে বেলা ২টার পর ঘটনাস্থলে আসেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিজিৎ রায় ও সদর থানার ওসি মোহাম্মদ নুরনবী। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আশ্বাসে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর কৃষকরা সড়ক অবরোধ তুলে নেন। আজ ২ মার্চ চাষি প্রতিনিধিদের সাথে জেলা প্রশাসক কথা বলেছেন । জেলা প্রশাসক হিমাগার মালিকদের সাথে আলাদা করে কথা বলেছেন। তিনি চাষিদের স্মারক লিপি গ্রহন করেছেন। আলোচনা চলবে।

কী হতে পারে সরকারি উদ্যোগ

আত্রাইয়ের আহসানগঞ্জ ইউনিয়নের শুকটিগাছা গ্রামের এক আলুচাষির উঠানে বসে উপায় নিয়ে আলাপ হচ্ছিল কয়েকজনের সঙ্গে। একজন বললেন, ‘হুট করে আলু রাখার খরচ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল হিমাগারের মালিকেরা। এটা একটা স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত। আমরা ভেবেছিলাম, দেশ থেকে স্বৈরাচারী কাজকাম নির্মূল হবে। বলি, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, হয়তো আরও বাড়বে, তাই তারা একটু বাড়তি দাম চাইছে। “ডেভিলস অ্যাডভোকেসি” করতে গিয়ে ধরা খেলাম।’ আরেকজন বললেন, ‘এসব দালালিমার্কা যুক্তি। সরকার ইচ্ছা করলেই কোল্ড স্টোরেজের জন্য একটা আলাদা বিদ্যুতের দর ঠিক করে দিতে পারে। আলোচনা চলতে থাকে। অন্য একজন বলেন, ‘সরকার এখনই আলু কিনে নিক, তারপর কোল্ড স্টোরেজে রাখুক। আজকাল শুনি, আলু নাকি রপ্তানি হয় নানা দেশে। সরকার সেখান থেকে সরাসরি রপ্তানি করতে পারে।’ মনে পড়ে গেল গায়েবি রপ্তানির তালিকা আলু নিয়ে অনেক দিন থেকেই আলোচনা চলছে। গত বছর চট্টগ্রাম থেকে এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছিলেন মাসুদ মিলাদ (‘গায়েবি’ রপ্তানি, আলুতে আত্মসাৎ ৩০ কোটি টাকা, প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারি ২০২৪)। আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন।

রপ্তানি করুক না করুক, সরকারকে আলুচাষিদের রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার অন্যতম স্তম্ভ আলু নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। দেরি না করে বসতে হবে হিমাগারের মালিকদের সঙ্গে।

নওগাঁর আলুচাষি সোলাইমানের বিকল্প আলু সংরক্ষণের ঘর.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ট র ক টন সড়ক অবর আল র দ ম উৎপ দ ত আল চ ষ ক অবর অবর ধ উপজ ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

করিডোরের জন্য দু’দেশের সম্মতি লাগবে: জাতিসংঘ 

রাখাইন রাজ্যের বেসামরিক নাগরিকের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠাতে করিডোরের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্মতি প্রয়োজন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। 

ঢাকার জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় সমকালকে এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশে জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা।

জাতিসংঘ অন্য অংশীদারকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন জোরদার করবে। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে যে কোনো মানবিক সহায়তা বা সরবরাহের জন্য প্রথমে দুই সরকারের মধ্যে সম্মতি প্রয়োজন। সীমান্ত অতিক্রম করে সহায়তা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর অনুমতি নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটি ছাড়া জাতিসংঘের সরাসরি ভূমিকা সীমিত।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত রোববার এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোরের ব্যাপারে সম্মত। কারণ এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ 

এ খবর চাউর হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নের শঙ্কা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সরকার কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তথাকথিত মানবিক করিডোর স্থাপন নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা হয়নি বলে দাবি করছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

গত অক্টোবরে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে ১২ পাতার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে রাখাইনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়। রাখাইনের পণ্য প্রবেশের জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সীমান্ত বন্ধ রয়েছে, আয়ের কোনো উৎস নেই। ভয়াবহ মূল্যস্থিতি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে ধস, জরুরি সেবা এবং সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা করছে জাতিসংঘ। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ