বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। অন্য বড় দল আওয়ামী লীগ রাতারাতি উধাও হয়ে যাওয়ার পর বিএনপির সুযোগ বেড়েছে; সঙ্গে তাদের নতুন চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিএনপির বলয়ের বাইরে গণ্য করার মতো এখন রয়েছে আর মাত্র দুটি দল—নবগঠিত এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী। এনসিপি হাঁটিহাঁটি পা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের দল গোছাতে অনেক কাজ বাকি। জামায়াতে ইসলামী জুলাই বিপ্লবের পর কিছুটা হাঁফ ছাড়লেও, একাত্তরের সত্যগুলো কিছুতেই তাদের পিছু ছাড়ছে না। নির্বাচন যতই কাছে আসবে, এসব দলের অবস্থান নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হবে। তবে আজকের আলোচনা বিএনপির দলীয় অবস্থান নিয়ে। আমরা কথা বলব বিএনপির শক্তি, দুর্বলতা, কৌশল ও ভবিষ্যৎ নিয়ে।

পরিপক্বতা

বিগত বছরগুলোতে বিএনপিকে অনেক প্রতিকূলতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সইতে হয়েছে। বিএনপি রাজনীতির একটা দিক প্রশংসা করার মতো, ১৫ বছর অনবরত মার খাওযার পরও তারা মাঠ ও মাটি কামড়ে ছিল এবং দলকে আঁকড়ে ছিল, রাজনীতি ছাড়েনি। এ দেশে অনেক রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক প্রতিঘাত সইতে না পেরে বা তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় নিজেদের রাজনীতি বিসর্জন দেয়। একটা সময়ে জাসদ এই ভুল করেছিল; কিন্তু বিএনপি করেনি। তারা বিভ্রান্ত হয়নি, তারা বাহিনী করেনি। তারা তাদের রাজনীতির শিকড় কামড়ে পড়ে ছিল। এই পরিপক্বতা বিএনপিকে শক্তি জুগিয়েছে ও স্থিতিশীল করেছে।

নেতৃত্ব

বিএনপি খুব সংগঠিত দল। তাদের অভিজ্ঞ নেতার সংখ্যাও কম নয়। দলের একচ্ছত্র নেতা হলেন তারেক রহমান, যিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তারেক জিয়া নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি লন্ডনে নির্বাসিত অবস্থান থেকেই দল পরিচালনা করছেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম তারেক জিয়ার বৃত্তে থেকেও নিজের জন্য আলাদা পরিচিতি সৃষ্টি করেছেন তাঁর শিষ্টতা ও অসংঘাতপূর্ণ আচরণের জন্য।

বিএনপির সিনিয়র নেতারা যেমন তারেক জিয়ার থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখেন, তরুণ নেতারা তেমনি তাঁকে ঘিরেই রাজনীতি করছেন। এই রসায়ন নির্বাচনী রাজনীতিতে কী ভূমিকা রাখবে বা বাইরের থেকে মনোনয়ন নিয়ে কোনো উত্তেজনা আদৌ বোঝা যাবে কি না, তা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।

বেগম জিয়া ফ্যাক্টর

বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ। তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িত নন, তবে নিশ্চয় রাজনীতির খোঁজখবর রাখছেন। বিগত ক্ষমতার দিনগুলোতে তারেক জিয়ার সঙ্গে দলের প্রবীণ নেতাদের একটা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল। বেগম জিয়া প্রবীণ নেতাদের তখনকার পরিস্থিতিতে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং বিএনপিতে তাঁদের অবস্থান সুনিশ্চিত করেন। এখনো তাঁকে বিএনপির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মান্য করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর শরীর যদি তাঁকে সহায়তা করে, তাহলে বিএনপির যেকোনো নাজুক পরিস্থিতিতে তিনি হস্তক্ষেপ না করলেও, তাঁর মতামত জোরালোভাবে তুলে ধরবেন।

তারেক জিয়া এখনো লন্ডনে কেন

যে প্রশ্নটা প্রায়ই শোনা যায়, তারেক জিয়া এখনো লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করছেন কেন? বিএনপির কাউকে জিজ্ঞেস করলে একটা গৎবাঁধা উত্তর শোনা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশে আসতে পারছেন না। হয়তো মামলা আছে, কিন্তু এসব মামলায় তাঁকে জেলে নেওয়া হবে বা জামিন দেওয়া হবে না, এটা কেউ বিশ্বাস করবেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

তারেক রহমানের এখন পর্যন্ত লন্ডনে থেকে যাওয়ার কারণটা রাজনৈতিক হতে পারে। তিনি লন্ডন থেকে দল চালানোর একটা কার্যকর মডেল খুঁজে পেয়েছেন, অন্য কথায়, ‘কমফোর্ট জোন’ও বলতে পারেন। তিনি ভিডিও মারফত সভা–সমিতি করছেন, তাঁর কাছের লোকদের দ্বারা দেশে দল নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বিরোধ এড়াতে পারছেন। (বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে বিরোধ নব্বই দশকে খুব বড় আলোচনার বিষয় ছিল।)

তা ছাড়া মির্জা ফখরুল ইসলাম তারেক জিয়ার নেতৃত্বকে মেনে নিয়েও দেশে বিএনপির জন্য একটা সম্মানজনক নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছেন, যেটা বিএনপির জন্য খুবই ইতিবাচক। মির্জা ফখরুল ইসলামের ‘লো প্রোফাইল’ বা নিম্নস্বরের উপস্থিতির জন্য তারেক জিয়া কখনো মির্জা ফখরুলকে ‘হুমকিমূলক’ ভাবেননি। যাঁরা এত সব ঘোরপ্যাঁচ শুনতে চান না, তাঁদের জন্য শুধু বলব, যে জিনিসটা ভালো কাজ করছে, সেটাকে বিএনপি নেতা এখনই ভাঙতে চাচ্ছেন না।

তারেকের নতুন উপলব্ধি

দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের উপলব্ধিও বাড়ছে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচারণা জনগণ পছন্দ করেন না। এ বছর তারেক রহমান তাঁর জন্মদিনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আজকের পর থেকে দয়া করে আমার নাম যখন কেউ বলবেন, দেশনায়ক, রাষ্ট্রনায়ক—এই কথাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না।’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এই উত্তরণ দেশের জনগণ অবশ্যই পছন্দ করবেন। ভবিষ্যতের কাজ দিয়েই তাঁর নেতৃত্ব বিচার করা হবে।

সংস্কার নিয়ে ভিন্নমত

বিএনপি বারবার মত দিয়েছে, নির্বাচিত সরকারই রাষ্ট্রের সংস্কার ভালো করতে পারবে। তারা সংস্কারের প্রয়োজনে নির্বাচন পেছানোর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান জানিয়েছে। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রীয় সংস্কারকে বিএনপি খুব গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না। তারেক জিয়া বলেছেন, ‘সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। বিএনপি দায়িত্ব পেলে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করবে।’ তারেক জিয়া ১১ মার্চ এক অনুষ্ঠানে নিজের আট সংস্কার ভাবনা নিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁর রাষ্ট্রীয় সংস্কার ভাবনা অন্য রকম—রাষ্ট্রীয় সংস্কারের চেয়ে জনগণের উন্নয়নের জন্য পলিসি উন্নয়নের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন; যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধ, চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, কীভাবে শিল্প গড়ে তোলা যায় ইত্যাদি।

বিএনপির মাঠ পরিস্থিতি

বিএনপির জন্য একটা বিব্রতকর অবস্থা হলো, মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ওপর দলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশের প্রতিটি আনাচকানাচে আওয়ামী লীগের পরিত্যক্ত দখলদারি, চাঁদাবাজি এর মধ্যেই বিএনপির ক্যাডারদের দখলে চলে গেছে। প্রতিদিনই এ নিয়ে খবরাখবর ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে। কিছু ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু এর ব্যাপ্তি এত বেশি যে সেটা থামানো যাচ্ছে না। এস আলমের গাড়ির ঘটনাতেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়। বিএনপি এসব দিক এখন থেকে সামাল না দিলে তারা দ্রুত জনগণের আস্থা হারাবে।

বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাদের নিজেদের মধ্যে সংঘাত বিএনপির জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। এই বিবাদ এখন থেকে মেটাতে না পারলে নির্বাচনী সময়ে প্রার্থিতা ও ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন হুমকির মধ্যে ফেলবে।

ভবিষ্যৎ

ভবিষ্যতে তারেক জিয়াকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজনীতি তুঙ্গে উঠবে, তাঁর বিরুদ্ধে পুরোনো অভিযোগগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। হাওয়া ভবন থেকে সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা চালানো এর মধ্যে একটি। তিনি যদি সাহস করে তাঁর পুরোনো ভুলগুলো স্বীকার করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন, সেটা তাঁর জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হবে এবং বিএনপির জন্যও সুফল আনবে।

জুলাই বিপ্লবের পর বিভিন্ন শক্তি একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অবমূল্যায়ন করে যখন কথাবার্তা বলতে শুরু করেছিল, বিএনপি দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির নেতারাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো ভাষায় কথা বলেন। এটা বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক।

একক বড় দল হিসেবে বিএনপির সুযোগ রয়েছে পরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার। তবে সামনে যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের দায়িত্ব হবে অনেক বেশি এবং কঠিন।

সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র জন য ব এনপ র স র জন ত ক র জন ত র ব যবস থ অবস থ ন করছ ন ইসল ম ক ষমত ফখর ল

এছাড়াও পড়ুন:

লন্ডন বৈঠকে অবিশ্বাস দূর, সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের পথ সুগম হবে: সাইফুল হক

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক দেশে আগামী সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর করবে বলে আশা করছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। আজ শনিবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন তিনি।

লন্ডনে দুই নেতার বৈঠকের বিস্তারিত সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করারও আহ্বান জানিয়েছেন সাইফুল হক।

সরকারের এই উদ্যোগ বিলম্বিত বোধদয়ের ফল বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। সাইফুল হক বলেন, আরও আগে সরকারের এই বোধদয় হলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক ও রাজনৈতিক বিরোধ এড়িয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ মৌলিক কাজে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া যেত।

সব অংশীজনকে আস্থায় নিয়ে সরকারকে কাজ করার আহ্বান জানান সাইফুল হক। তিনি বলেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের রাস্তা সুগম হলো।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাইফুল হক বলেন, দেশের মানুষের অধিকার ও মুক্তি অর্জনে তাঁর দল জনগণের ভালোবাসা নিয়ে আগামীতে আপসহীন ধারায় সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে।

সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, আকবর খান, আবু হাসান টিপু, আনছার আলী দুলাল ও মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাক। সমাবেশে সংহতি জানান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিষদের আহবায়ক শেখ আবদুর নূর।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম মীর, রেজাউল আলম, ফিরোজ আলী, কেন্দ্রীয় সংগঠক আইয়ুব আলী, বাবর চৌধুরী, ঢাকা মহানগর কমিটির নেতা মো. সালাউদ্দীন, মিজারুল রহমান ডালিম, আরিফুল ইসলামসহ পার্টির ঢাকা মহানগরের নেতারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইরানের শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান সাবেক শাহের পুত্রের
  • আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন ইশরাক হোসেন
  • আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলেন ইশরাক হোসেন
  • আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা ইশরাকের
  • রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়
  • লন্ডন বৈঠকে অবিশ্বাস দূর, সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের পথ সুগম হবে: সাইফুল হক
  • বাজেটের ত্রুটি সংশোধনের আহ্বান
  • ড. ইউনূসকে দেশের কাজে যুক্ত রাখতে চায় বিএনপি
  • জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ইরানের প্রেসিডেন্ট
  • সহসাই রাজনীতির কালো মেঘ কেটে যাবে: ডা. জাহিদ