বিএনপির সামনে সুযোগ অনেক, কিন্তু...
Published: 16th, March 2025 GMT
বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। অন্য বড় দল আওয়ামী লীগ রাতারাতি উধাও হয়ে যাওয়ার পর বিএনপির সুযোগ বেড়েছে; সঙ্গে তাদের নতুন চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিএনপির বলয়ের বাইরে গণ্য করার মতো এখন রয়েছে আর মাত্র দুটি দল—নবগঠিত এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী। এনসিপি হাঁটিহাঁটি পা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের দল গোছাতে অনেক কাজ বাকি। জামায়াতে ইসলামী জুলাই বিপ্লবের পর কিছুটা হাঁফ ছাড়লেও, একাত্তরের সত্যগুলো কিছুতেই তাদের পিছু ছাড়ছে না। নির্বাচন যতই কাছে আসবে, এসব দলের অবস্থান নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হবে। তবে আজকের আলোচনা বিএনপির দলীয় অবস্থান নিয়ে। আমরা কথা বলব বিএনপির শক্তি, দুর্বলতা, কৌশল ও ভবিষ্যৎ নিয়ে।
পরিপক্বতা
বিগত বছরগুলোতে বিএনপিকে অনেক প্রতিকূলতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সইতে হয়েছে। বিএনপি রাজনীতির একটা দিক প্রশংসা করার মতো, ১৫ বছর অনবরত মার খাওযার পরও তারা মাঠ ও মাটি কামড়ে ছিল এবং দলকে আঁকড়ে ছিল, রাজনীতি ছাড়েনি। এ দেশে অনেক রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক প্রতিঘাত সইতে না পেরে বা তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় নিজেদের রাজনীতি বিসর্জন দেয়। একটা সময়ে জাসদ এই ভুল করেছিল; কিন্তু বিএনপি করেনি। তারা বিভ্রান্ত হয়নি, তারা বাহিনী করেনি। তারা তাদের রাজনীতির শিকড় কামড়ে পড়ে ছিল। এই পরিপক্বতা বিএনপিকে শক্তি জুগিয়েছে ও স্থিতিশীল করেছে।
নেতৃত্ব
বিএনপি খুব সংগঠিত দল। তাদের অভিজ্ঞ নেতার সংখ্যাও কম নয়। দলের একচ্ছত্র নেতা হলেন তারেক রহমান, যিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তারেক জিয়া নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি লন্ডনে নির্বাসিত অবস্থান থেকেই দল পরিচালনা করছেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম তারেক জিয়ার বৃত্তে থেকেও নিজের জন্য আলাদা পরিচিতি সৃষ্টি করেছেন তাঁর শিষ্টতা ও অসংঘাতপূর্ণ আচরণের জন্য।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা যেমন তারেক জিয়ার থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখেন, তরুণ নেতারা তেমনি তাঁকে ঘিরেই রাজনীতি করছেন। এই রসায়ন নির্বাচনী রাজনীতিতে কী ভূমিকা রাখবে বা বাইরের থেকে মনোনয়ন নিয়ে কোনো উত্তেজনা আদৌ বোঝা যাবে কি না, তা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
বেগম জিয়া ফ্যাক্টর
বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ। তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িত নন, তবে নিশ্চয় রাজনীতির খোঁজখবর রাখছেন। বিগত ক্ষমতার দিনগুলোতে তারেক জিয়ার সঙ্গে দলের প্রবীণ নেতাদের একটা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল। বেগম জিয়া প্রবীণ নেতাদের তখনকার পরিস্থিতিতে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং বিএনপিতে তাঁদের অবস্থান সুনিশ্চিত করেন। এখনো তাঁকে বিএনপির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মান্য করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর শরীর যদি তাঁকে সহায়তা করে, তাহলে বিএনপির যেকোনো নাজুক পরিস্থিতিতে তিনি হস্তক্ষেপ না করলেও, তাঁর মতামত জোরালোভাবে তুলে ধরবেন।
তারেক জিয়া এখনো লন্ডনে কেন
যে প্রশ্নটা প্রায়ই শোনা যায়, তারেক জিয়া এখনো লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করছেন কেন? বিএনপির কাউকে জিজ্ঞেস করলে একটা গৎবাঁধা উত্তর শোনা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশে আসতে পারছেন না। হয়তো মামলা আছে, কিন্তু এসব মামলায় তাঁকে জেলে নেওয়া হবে বা জামিন দেওয়া হবে না, এটা কেউ বিশ্বাস করবেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
তারেক রহমানের এখন পর্যন্ত লন্ডনে থেকে যাওয়ার কারণটা রাজনৈতিক হতে পারে। তিনি লন্ডন থেকে দল চালানোর একটা কার্যকর মডেল খুঁজে পেয়েছেন, অন্য কথায়, ‘কমফোর্ট জোন’ও বলতে পারেন। তিনি ভিডিও মারফত সভা–সমিতি করছেন, তাঁর কাছের লোকদের দ্বারা দেশে দল নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বিরোধ এড়াতে পারছেন। (বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে বিরোধ নব্বই দশকে খুব বড় আলোচনার বিষয় ছিল।)
তা ছাড়া মির্জা ফখরুল ইসলাম তারেক জিয়ার নেতৃত্বকে মেনে নিয়েও দেশে বিএনপির জন্য একটা সম্মানজনক নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছেন, যেটা বিএনপির জন্য খুবই ইতিবাচক। মির্জা ফখরুল ইসলামের ‘লো প্রোফাইল’ বা নিম্নস্বরের উপস্থিতির জন্য তারেক জিয়া কখনো মির্জা ফখরুলকে ‘হুমকিমূলক’ ভাবেননি। যাঁরা এত সব ঘোরপ্যাঁচ শুনতে চান না, তাঁদের জন্য শুধু বলব, যে জিনিসটা ভালো কাজ করছে, সেটাকে বিএনপি নেতা এখনই ভাঙতে চাচ্ছেন না।
তারেকের নতুন উপলব্ধি
দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের উপলব্ধিও বাড়ছে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচারণা জনগণ পছন্দ করেন না। এ বছর তারেক রহমান তাঁর জন্মদিনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আজকের পর থেকে দয়া করে আমার নাম যখন কেউ বলবেন, দেশনায়ক, রাষ্ট্রনায়ক—এই কথাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না।’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এই উত্তরণ দেশের জনগণ অবশ্যই পছন্দ করবেন। ভবিষ্যতের কাজ দিয়েই তাঁর নেতৃত্ব বিচার করা হবে।
সংস্কার নিয়ে ভিন্নমত
বিএনপি বারবার মত দিয়েছে, নির্বাচিত সরকারই রাষ্ট্রের সংস্কার ভালো করতে পারবে। তারা সংস্কারের প্রয়োজনে নির্বাচন পেছানোর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান জানিয়েছে। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রীয় সংস্কারকে বিএনপি খুব গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না। তারেক জিয়া বলেছেন, ‘সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। বিএনপি দায়িত্ব পেলে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করবে।’ তারেক জিয়া ১১ মার্চ এক অনুষ্ঠানে নিজের আট সংস্কার ভাবনা নিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁর রাষ্ট্রীয় সংস্কার ভাবনা অন্য রকম—রাষ্ট্রীয় সংস্কারের চেয়ে জনগণের উন্নয়নের জন্য পলিসি উন্নয়নের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন; যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধ, চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, কীভাবে শিল্প গড়ে তোলা যায় ইত্যাদি।
বিএনপির মাঠ পরিস্থিতি
বিএনপির জন্য একটা বিব্রতকর অবস্থা হলো, মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ওপর দলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশের প্রতিটি আনাচকানাচে আওয়ামী লীগের পরিত্যক্ত দখলদারি, চাঁদাবাজি এর মধ্যেই বিএনপির ক্যাডারদের দখলে চলে গেছে। প্রতিদিনই এ নিয়ে খবরাখবর ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে। কিছু ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু এর ব্যাপ্তি এত বেশি যে সেটা থামানো যাচ্ছে না। এস আলমের গাড়ির ঘটনাতেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়। বিএনপি এসব দিক এখন থেকে সামাল না দিলে তারা দ্রুত জনগণের আস্থা হারাবে।
বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাদের নিজেদের মধ্যে সংঘাত বিএনপির জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। এই বিবাদ এখন থেকে মেটাতে না পারলে নির্বাচনী সময়ে প্রার্থিতা ও ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন হুমকির মধ্যে ফেলবে।
ভবিষ্যৎ
ভবিষ্যতে তারেক জিয়াকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজনীতি তুঙ্গে উঠবে, তাঁর বিরুদ্ধে পুরোনো অভিযোগগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। হাওয়া ভবন থেকে সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা চালানো এর মধ্যে একটি। তিনি যদি সাহস করে তাঁর পুরোনো ভুলগুলো স্বীকার করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন, সেটা তাঁর জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হবে এবং বিএনপির জন্যও সুফল আনবে।
জুলাই বিপ্লবের পর বিভিন্ন শক্তি একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অবমূল্যায়ন করে যখন কথাবার্তা বলতে শুরু করেছিল, বিএনপি দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির নেতারাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো ভাষায় কথা বলেন। এটা বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক।
একক বড় দল হিসেবে বিএনপির সুযোগ রয়েছে পরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার। তবে সামনে যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের দায়িত্ব হবে অনেক বেশি এবং কঠিন।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র জন য ব এনপ র স র জন ত ক র জন ত র ব যবস থ অবস থ ন করছ ন ইসল ম ক ষমত ফখর ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।
এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?
আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?
হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!
মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’
আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!
তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।
একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।
টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।
একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!
যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।
যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।
আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।
তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’
যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?
যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।
সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।
হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।
এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।
এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।
এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।
আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।
কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।
ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।
বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।
নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।
বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।
ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব